Advertisement
০৩ মে ২০২৪
Tulsidas Balaram

মাত্র সাতাশে শেষ ফুটবলজীবন, পাননি পদ্ম সম্মান, নীরব অভিমান নিয়েই বিদায় বলরামের

ভারতীয় ফুটবলে তাঁর কীর্তির কোনও শেষ নেই। ১৯৫৬ সালে অলিম্পিক্সে ভারতের যে দল খেলেছিল, তার শেষ জীবিত সদস্য ছিলেন তিনি। পিকে-চুনীর পর এ বার ত্রয়ীর শেষ সদস্য বলরামও প্রয়াত।

প্রয়াত তুলসীদাস বলরাম।

প্রয়াত তুলসীদাস বলরাম। ফাইল ছবি

অভীক রায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৬:১৭
Share: Save:

পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়। চুনী গোস্বামী। তুলসাদাস বলরাম। ভারতীয় ফুটবল এর থেকে ভাল ত্রয়ী কোনও দিন দেখেনি। অদূর ভবিষ্যতে দেখতে পাবে— এমন সম্ভাবনাও কম। প্রথম দু’জন আগেই প্রয়াত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার চলে গেলেন ত্রয়ীর শেষ সদস্য বলরাম। দীর্ঘ দিন ধরেই বিভিন্ন অসুখে ভুগছিলেন। হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছিল ঘন ঘন। বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ কমে আসছিল। বৃহস্পতিবার কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে প্রয়াত হলেন ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার বলরাম।

ভারতীয় ফুটবলে বলরামের কীর্তির কোনও শেষ নেই। ১৯৫৬ সালে অলিম্পিক্সে যে ভারতীয় দল খেলেছিল, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তিনিই ছিলেন তার সর্বশেষ জীবিত সদস্য। ক্রীড়াবিদ বলরামের বহু নজির কলকাতা ময়দানে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তবে আফসোস একটাই। শেষ দিকে কিছুই আর মনে করতে পারতেন না। উত্তরপাড়ার ঘুপচি এক ফ্ল্যাটে সারাদিন শুয়েই কেটে যেত। আগে তবু বাড়িতে শুভানুধ্যায়ীদের আনাগোনা লেগে থাকত। শেষের দিকে সেটাও কমে এসেছিল। একাকীই দিন কাটাতেন। একত্রিশ বছর আগে ফুটবল থেকে সেই যে মুখ ফিরিয়েছিলেন, আর ফিরে তাকাননি। কখনও-সখনও সংবাদপত্রে ফুটবলের ম্যাচ রিপোর্ট লিখতেন। তবে ধীরে ধীরে সবই স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল। চোখে সমস্যা থাকার কারণে একটানা বসে টিভি দেখতে পারতেন না। ম্যাচ দেখার তো প্রশ্নই নেই।

১৯৩৬ সালে ৪ অক্টোবর অধুনা তেলঙ্গানার সেকেন্দরাবাদে আম্মাগুডা গ্রামে জন্ম বলরামের। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবার। সে কারণেই ছেলের ফুটবল খেলার স্বপ্নে বাধা দিয়েছিলেন মা। চেয়েছিলেন, সরকারি করণিক হওয়ার যে স্বপ্ন তাঁর নিজের অপূর্ণ থেকে গিয়েছে, সেটাই পূরণ করুক ছেলে। কিন্তু ছেলের পেটে তো খিদে! তাকে আটকায় কার সাধ্যি! ছোট্ট বলরাম মায়ের কথা শুনল না। স্কুল ফাঁকি দিয়ে দেদার ফুটবল খেলে চলল। বেশির ভাগ সময়েই খেলতে হত খালি পেটে। দু’বেলা, দু’মুঠো খাবার জোটানোর ক্ষমতা ছিল না তার মায়ের। খেলার জন্য ছিল না কোনও সবুজ ঘাসের গালিচা। রাবারের বল নিয়ে কোনও মতে অসমান, এবড়োখেবড়ো জমিতে ফুটবল খেলতে হত বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে। কোনও কারণ ছাড়াই বাচ্চা ছেলেটির স্বপ্নে ছিল সবুজ-মেরুন। ওই রঙের জার্সিই সে পছন্দ করত। আজীবন ছিল সেই ভালবাসা।

সন্তোষ ট্রফিতে হায়দরাবাদের হয়ে দুরন্ত পারফরম্যান্স ১৯৫৬ সালে মেলবোর্ন অলিম্পিক্সের জন্য বলরামকে ভারতীয় দলে জায়গা করে দেয়।

সন্তোষ ট্রফিতে হায়দরাবাদের হয়ে দুরন্ত পারফরম্যান্স ১৯৫৬ সালে মেলবোর্ন অলিম্পিক্সের জন্য বলরামকে ভারতীয় দলে জায়গা করে দেয়। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ

হঠাৎই এক দিন ছোট্ট বলরামের ইচ্ছে হল, দল গড়ে ফুটবল খেলার। কিন্তু দল গড়লে তো শুধু হবে না। জার্সি চাই। সেই সময় জার্সি কিনতে প্রত্যেককে দু’টাকা করে দিতে হত। মায়ের কাছে সত্যি কথা বলে টাকা চাইলে কোনও লাভ হবে না। তাই বলরাম মিথ্যার আশ্রয় নিল। মাকে গিয়ে বলল, স্কুলে বই কিনতে টাকা দরকার। মা টাকা ধার নিলেন অন্য এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে নিয়ে। সেই টাকা দিয়ে স্বপ্নের সবুজ-মেরুন জার্সি কিনে ফেলল বলরাম।

বলরামের ফুটবল জীবনে প্রথম সুযোগ আসে ১৯ বছর বয়সে। তখন ১৯৫৫ সাল। আচমকাই সৈয়দ আব্দুল রহিমের চোখে পড়ে গেলেন বলরাম। রহিম সাহেব তখন অধুনালুপ্ত হায়দরাবাদ ফুটবল সংস্থার সভাপতি। নীচের ডিভিশন লিগের রাইডার্স ক্লাবের হয়ে খেলতে সেকেন্দরাবাদ থেকে হায়দরাবাদে এলেন। বলরামের বল নিয়ন্ত্রণ চোখে পড়ে গিয়েছিল রহিমের। কী ভাবে বল নিয়ে একের পর এক ডিফেন্ডারকে অনায়াসে কাটাতেন, সেটা দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ১৯৫৬ সালের সন্তোষ ট্রফির জন্যে হায়দরাবাদ দলে বলরামকে যোগ দিতে নির্দেশ দেন রহিম। রোজ সেকেন্দরাবাদ থেকে হায়দরাবাদে যাওয়ার মতো টাকা ছিল না বলরামের। রহিম তাঁকে সাইকেল কিনে দিয়েছিলেন।

কোচ বলরামও কম জনপ্রিয় ছিলেন না।

কোচ বলরামও কম জনপ্রিয় ছিলেন না। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ

সন্তোষ ট্রফিতে হায়দরাবাদের হয়ে দুরন্ত পারফরম্যান্স সে বছর মেলবোর্ন অলিম্পিক্সের জন্য বলরামকে ভারতীয় দলে জায়গা করে দেয়। যদিও প্রতিযোগিতার বেশির ভাগ সময় বেঞ্চেই কাটিয়েছিলেন বলরাম। রহিম চেয়েছিলেন, এই ধরনের প্রতিযোগিতায় খেলার অনুভূতি কী রকম, সেটা বুঝে নিক বলরাম। তরুণ বলরামের উপর এতটাই ছিল তাঁর বিশ্বাস।

বলরাম ভারতে ফেরার পর তাঁকে নিতে চেয়েছিল কলকাতার ক্লাব ইস্টবেঙ্গল। তবে শুরুতে বলরাম রাজি ছিলেন না। রহিম সাহেব তাঁকে বলেছিলেন, হায়দরাবাদ তখনই না ছাড়তে। ফলে বলরাম সিদ্ধান্ত নেন, হায়দরাবাদ সিটি পুলিশের হয়ে খেলবেন। সেখানে থাকলে পুলিশ বিভাগে একটা সম্মানজনক কাজ নিয়ে মায়ের স্বপ্ন অন্তত পূরণ করা যাবে। কিন্তু তাঁকে কনস্টেবলের চাকরি দেওয়া হয়। বলরামের স্বপ্ন ভেঙে যায়। তিনি ব্যাগ গুছিয়ে কলকাতার উদ্দেশে রওনা দেন এবং ইস্টবেঙ্গলে যোগ দেন।

এই সিদ্ধান্তই তাঁর জীবনে সবচেয়ে সেরা সিদ্ধান্ত হয়ে ওঠে। তরতর করে উঠতে থাকে কেরিয়ারের রেখচিত্র। ইস্টবেঙ্গলের হয়ে বহু ট্রফি জিতেছেন। ১০৪টি গোল করেছেন। ধীরে ধীরে কলকাতা ময়দানের ভালবাসা, সমীহ পেতে শুরু করেন। তখন থেকে এই শহরকেই নিজের নতুন বাড়ি ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন তিনি।

একটি ম্যাচে তুলসী, বলরাম, চুনী।

একটি ম্যাচে তুলসী, বলরাম, চুনী। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ

১৯৫৬ থেকে ১৯৬২— বলরামের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং ভাল সময়। শুধু ভারত নয়, এশিয়ার অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার ছিলেন তিনি। চুনী গোস্বামী এবং পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে জুটি বেঁধে ভারতীয় ফুটবলের ত্রয়ী গড়ে তুলেছিলেন। এই সময় কালে বলরাম দু’টি এশিয়ান গেমসে অংশ নেন। খেলেছেন অলিম্পিক্সেও। জাকার্তা এশিয়াডে সোনা জেতে ভারত। পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে এশিয়ায় ফুটবলের অন্যতম সেরা শক্তি ছিল ভারত। বলরামের একক দৌড় এবং ড্রিবলিংয়ে মাত হয়ে গিয়েছিলেন জাপান, কোরিয়া, হাঙ্গেরি, ফ্রান্সের ডিফেন্ডাররাও।

রোম অলিম্পিক্স বলরামের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতা। গতি এবং বল নিয়ন্ত্রণের সাহায্যে হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে দুর্দান্ত খেলেছিলেন তিনি। চুনীর থেকে পাস পেয়ে একটি গোলও করেছিলেন। শেষ মুহূর্তে হাঙ্গেরির ফুটবলাররা তাঁর বিরুদ্ধে ‘শারীরিক ফুটবল’ খেলেছিল, ছিঁড়ে দিয়েছিল জার্সি, যাতে বলরাম আর গোল না করতে পারেন।

১৯৬২-তে এশিয়াড জিতে ফেরার পর বলরাম জানতে পারেন তাঁর মায়ের শারীরিক অবস্থা ভাল নয়। তিনি ফিরে যান হায়দরাবাদে। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবকে কিছুই জানাননি। ক্লাব খুশি হয়নি, দয়াও দেখায়নি। তাঁর জরিমানা হয় এবং বেতন থেকে কেটে নেওয়া হয় বিমানভাড়াও। এই ‘সৌজন্য’ বলরাম আমৃত্যু ভুলতে পারেননি। করতে পারেননি ক্ষমাও।

১৯৬২-র এশিয়াডে সোনা জিতেছেন বলরাম।

১৯৬২-র এশিয়াডে সোনা জিতেছেন বলরাম। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ

তবে বাড়ি ফিরে বলরামের জন্যে অপেক্ষা করছিল চমক। তাঁকে দেখে চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি তাঁর মা। রেল স্টেশনেই ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন এবং ছোটবেলায় ফুটবল খেলতে না-দেওয়ার জন্য বার বার ক্ষমা চান। সেই মরসুম শেষ হওয়ার পর ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেন বলরাম। ক্লাবের উপর এতটাই রেগে ছিলেন যে, বছরদুয়েক আগে তাঁর অস্ত্রোপচারের জন্য লাল-হলুদ শিবির সাহায্য করতে চাইলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। ১৯৬৩-তে বেঙ্গল নাগপুর রেলওয় (বিএনআর)-তে খেলতে শুরু করেন বলরাম। আবার এই শহরে ফিরে আসা। সেই বছরই ব্রঙ্কাইটিসে আক্রান্ত হন। দুর্বল ফুসফুস থাকার কারণে বাধ্য হন ফুটবল থেকে অবসর নিতে। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৭। অবসরের পর কয়েক বছর বিএনআরে কোচিং করান। তাঁর প্রশিক্ষণে সংগ্রাম মুখোপাধ্যায়, মেহতাব হোসেন, চন্দন দাসের মতো ফুটবলাররা ছোটবেলায় খেলেছেন।

পরবর্তী জীবনে বলরামকে অর্জুন পুরস্কার দেওয়া হয়। কিন্তু পদ্মশ্রী না পাওয়ার খেদ আমৃত্যু ছিল তাঁর। কোনও দিন প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। কিন্তু ঘনিষ্ঠমহলে অভিমান করেছেন। ১৯৯০ সালে পদ্মশ্রীর জন্যে তাঁর নাম মনোনীত হলেও রহস্যজনক ভাবে সেই ফাইল ‘হারিয়ে’ যায়। বলরামের থেকে ছোট মানের ফুটবলারেরা জাতীয় দলের হয়ে খেলে যে খ্যাতি পেয়েছেন, সেটাও কোনও দিন তিনি পাননি। সেই ক্ষোভও ছিল।

পরে সর্বভারতীয় ফুটবল সংস্থায় জাতীয় নির্বাচক হিসাবে কিছু দিন কাজ করেছেন। তবে ধীরে ধীরে ফুটবল থেকে দূরে চলে যাচ্ছিলেন। পদ্মশ্রী না পাওয়ায় তা পুরোপুরি চলে যায়। শেষের বেশ অনেক বছর তিনি থাকতেন হুগলির উত্তরপাড়ায়। বাড়ি থেকে বিশেষ বেরোতেন না। অকৃতদার ছিলেন। খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন। বাড়িতে গান শুনে সময় কাটত।

পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়। চুনী গোস্বামী। তুলসাদীস বলরাম। তিন নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হয়ে এসেছে ময়দানি ফুটবলে। তবে প্রথম দু’জন বিদায়কাল পর্যন্ত সব দিক থেকেই যে সমাদর পেয়েছেন শেষের জন তা কখনই পাননি। তাতে যদিও কিছুই যায় আসেনি ফুটবলের এই বরপুত্রের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE