আন্তর্জাতিক মঞ্চে হাজারের কাছাকাছি উইকেট। কিংবদন্তি স্পিনার, কারও কারও মতে সর্বকালের সেরাও। কখনও অধিনায়কত্ব করেননি দেশের কিন্তু আইপিএলে প্রথম বছরেই চ্যাম্পিয়ন দলের নেতা। এখন রাজস্থান রয়্যালসেরই ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর’। প্রথম বছরেই ট্রফি জেতার অভিযান কী করে সম্ভব হল? ক্রিকেটে আইপিএলের প্রভাব কী? শুক্রবারেই সেঞ্চুরি করা সঞ্জু স্যামসনকে নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী। দেশ-বিদেশে নানা প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত থাকা শেন ওয়ার্ন একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন আনন্দবাজারকে।
প্রশ্ন: আইপিএলে প্রথম বারের চ্যাম্পিয়ন। এখন রাজস্থান রয়্যালসের ‘অ্যাম্বাসাডর’। সব মিলিয়ে আইপিএল নিয়ে অভিজ্ঞতা কী রকম?
শেন ওয়ার্ন: মনোজ বাদালে (রয়্যালসের অন্যতম মালিক) যখন আমাকে দলটা পরিচালনা করার প্রস্তাব দিলেন, আমি একটা কথাই বলেছিলাম। আমাকে স্বাধীনতা দিতে হবে। উনি বলে দিয়েছিলেন, আমি আমার মতো করেই টিম চালাবো। সেটা শুনেই আমি নেতৃত্ব ভার তুলে নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাই। দ্রুতই জানিয়ে দিই যে, আমি সব চেয়ে বেশি করে চাই সততা এবং মনে করি, এক জন নেতাকে তার সতীর্থদের কাছে সৎ থাকতে হয়।
প্র: আর কী চেয়েছিলেন?
ওয়ার্ন: বলেছিলাম, আমাকে যখন নেতা হিসেবে বেছে নিয়েছেন, দায়িত্বটা সব চেয়ে বেশি আমার। কারণ, নেতাকেই উদাহরণ তৈরি করতে হয় দলের সামনে। এর পর মনোজ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কোচ হিসেবে কাকে চাই? আমি জবাব দিলাম, কাউকে নয়। তার পরেই ওঁকে বললাম, কাউকে চাই না, তার কারণ ইতিমধ্যেই আমাকে নিজের মতো করে দল চালানোর অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন। তখন আমি টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে ফেলেছি। সেই প্রথম এত বড় দায়িত্ব নিতে রাজি হলাম। আসলে মনোজের অগাধ আস্থা দেখেই উৎসাহী হয়েছিলাম।
প্র: রয়্যালস দলটা যখন হল, কোনও বড় নাম ছিল না। একমাত্র আপনি। কী ভাবে দলটা গড়া হল?
ওয়ার্ন: মোটেও সহজ কাজ ছিল না। এত ভাল একটা টুর্নামেন্ট। সকলেই খেলতে চায়। কিন্তু সেটা কী করে সম্ভব হবে? কী ভাবে আমি সকলকে খেলাতে পারি? তবে প্রত্যেককে এই ধারণাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম যে, দলের মধ্যে কোনও বড়-ছোট ব্যাপার নেই। কেউ যেন নিজেকে অপ্রয়োজনীয় বা অপ্রাসঙ্গিক মনে না-করে, সে দিকে আলাদা করে নজর দিতে চেয়েছিলাম। মনে আছে, প্রত্যেক ক্রিকেটারের সঙ্গে সুইমিং পুলের ধারে আলাদা করে বৈঠক করেছিলাম। প্রত্যেক নেট সেশনে আমি নিজে প্রচুর বল করতাম। যাতে সকলে উদ্বুদ্ধ হয়। বিশেষ করে প্রথম হারটার পরে আমাদের জেদ বেড়ে গিয়েছিল। দলটা ঐক্যবদ্ধ হয়ে গেল খুব তাড়াতাড়ি। মুহূর্তে ওদের চোখে যেন আগুন জ্বলে উঠতে দেখলাম। রয়্যালসের মন্ত্র তৈরি হয়ে গেল, ‘আমরা যে কোনও জায়গা থেকে জিততে পারি’। নিজে যখন খেলেছি, একটা ব্যাপার সবার আগে মাথায় রাখার চেষ্টা করেছি— দলটাকে সব চেয়ে বেশি সম্মান করো। দলের জন্য তুমি, তোমার জন্য দল নয়। রয়্যালসে প্রথম বছরে সেটাই ছেলেদের বোঝানোর চেষ্টা করতাম।
প্র: রয়্যালসের সেই দলটা থেকে বেশ কিছু ভাল প্রতিভা বেরিয়ে এল। যেমন রবীন্দ্র জাডেজা, ইউসুফ পাঠান। তরুণদের উত্থানের রহস্য কী ছিল?
ওয়ার্ন: ওই মন্ত্রটা খুব কাজে দিয়েছিল— ‘যে কোনও জায়গা থেকে জিততে পারি’। খুব তাড়াতাড়ি সেই মন্ত্র ছেলেদের হৃদয়ে গেঁথে গিয়েছিল। তৈরি প্রতিভা ধরে আনার চেয়ে ম্যানেজমেন্টও জোর দিয়েছিল নতুন প্রতিভা আবিষ্কারের উপরে। আমরা একটা পরিবেশ গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম রয়্যালস ক্রিকেট পরিবারে। যেখানে গাছকে বড় করে তোলার মতো প্রতিভাকে লালনপালন করে গড়ে তোলা যাবে। পিছন ফিরে তাকালে সেটাই সব চেয়ে তৃপ্তি দেয়।
প্র: প্রথম বারেই চ্যাম্পিয়ন। এবং, সম্পূর্ণ আন্ডারডগ হিসেবে শুরু করে। কী ভাবে ‘মিশন’ সম্পন্ন হয়েছিল?
ওয়ার্ন: প্রথম ম্যাচটাই আমরা হেরে যাই। সেই হার আমাদের ভেঙে দিতে পারেনি, বরং আরও তাতিয়ে দিল। পশ্চাদ্দেশে যে-লাথিটা দরকার ছিল, সকলকে দৌড় করানোর জন্য, সেটা প্রথম ম্যাচই দিয়ে গিয়েছিল। ওই হার থেকে আমরা শিক্ষা নিয়েছিলাম। সবাই বুঝতে পারল, যতই রণনীতি বানাও আর পরিকল্পনা করো, মাঠে নেমে কার্যকর করতে না-পারলে কোনও লাভ নেই। ছেলেরা খুব দ্রুত পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল এবং একটা সোনার দৌড় শুরু হল আমাদের। টানা বেশ কিছু ম্যাচ জিতে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠল দল। কে জানত, সেই সোনার দৌড় থামবে ট্রফি হাতে পেয়ে তবেই। রোমাঞ্চকর!
প্র: রয়্যালসের সেই দলের এক ক্রিকেটার বলেছিলেন, ‘তুমি ম্যাচউইনার’ এমন কথা জীবনে প্রথম শুনেছিলেন আপনার থেকে।
ওয়ার্ন: আগেই বলেছি, নেতা হিসেবে আমি সততায় বিশ্বাসী। মনে করি, সতীর্থদের কাছে সৎ থাকতে হয় নেতাকে। রয়্যালসের অধিনায়ক হিসেবে আমি মনের মধ্যে যেটা আছে, সেটাই প্রকাশ করার চেষ্টা করতাম। সোজাসুজি ক্রিকেটারদের মুখের উপরে বলতাম, সে ভাল করেছে, নাকি প্রত্যাশা মেটাতে পারেনি।
প্র: আইপিএলে এখনকার ক্রিকেটারদের মধ্যে কাদের সম্ভাবনাময় বলে মনে হচ্ছে?
ওয়ার্ন: আমি সব সময়েই সঞ্জু স্যামসনকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি। মনে হয়েছে, ওর মধ্যে একটা এক্স-ফ্যাক্টর আছে। আবারও বলছি, আমার মনে হয়, সঞ্জু এ বার আইপিএলে ‘প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্ট’ হবে। আশা করছি, এই মরসুমটাই দারুণ যাবে ওর। দারুণ উন্নতি করছে। নিজেকে দলের এক জন প্রধান ক্রিকেটার হিসেবে তুলে এনেছে। তিন নম্বরের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ব্যাট করে চাপের মুখেও ভয়ডরহীন ইনিংস খেলতে পারে। বড় ব্যাটসম্যানের গুণ হচ্ছে, তার আগে যে নামে, তাকে ভরসা দিতে পারে যে, এর পরে ও আছে। আবার পরে যে নামবে, তার জন্যও মঞ্চটা তৈরি করে দেবে। সঞ্জু সেটা করতে পারে। আমি সত্যিই খুব আশা করছি, এ বছরের শেষে গিয়ে দেখব, সঞ্জু ভারতের হয়ে সব ধরনের ক্রিকেটে খেলছে।
প্র: আইপিএল কী ভাবে ক্রিকেটকে বদলে দিচ্ছে?
ওয়ার্ন: প্রথমে বলে রাখি, আইপিএলের বিবর্তন দেখে আমি চমৎকৃত। প্রত্যেক বছর যেন খেলাটা আরও টানটান হচ্ছে, আরও রুদ্ধশ্বাস প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি হচ্ছে। আর এই ঝলমলে টুর্নামেন্ট থেকে নতুন নতুন সব প্রতিভা উঠে আসছে। সঞ্জু স্যামসনকে দেখুন। আমাদের দেশের অ্যাশটন টার্নারকে (যিনি ওয়ান ডে সিরিজে কোহালির ভারতকে একটি ম্যাচে হারিয়ে দিয়েছিলেন) দেখুন। তরুণ রক্ত টগবগ করে ফুটছে। আমার তো মনে হয়, ক্রিকেটকেই ‘ফাস্ট ফরোয়ার্ড’ করে দিয়েছে আইপিএল। যে ক্রিকেটটা এমনিতে হয়তো ২০৫০-এ দেখা যেত, তা এখন দেখতে পাচ্ছি। এবং, কী অসাধারণ ভাবনা! সব দেশের ক্রিকেটার খেলতে পারছে সব দেশের সঙ্গে। তাতে প্রত্যেকের গুণগত মান উন্নত হচ্ছে। নতুন ছেলে একই ড্রেসিংরুমে বসে আছে আন্তর্জাতিক তারকার পাশে। তার থেকে পাচ্ছে অমূল্য সব উপদেশ। অবিশ্বাস্য!
প্র: শেষ প্রশ্ন। এ বারের আইপিএল থেকে কী আশা করছেন?
ওয়ার্ন: আশা করছি, আমাদের সেই প্রথম বারের ট্রফি জয়ের স্মরণীয় মুহূর্ত আবার দেখতে পাব। আমার মনে হয়, রাজস্থান রয়্যালসের বারো বছরের ইতিহাসে এ বারেরটাই সব চেয়ে শক্তিশালী দল। রয়্যালসে আমরা সবাই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। মালিক থেকে শুরু করে কোচেরা, সকলে এই স্বপ্নটা দেখছেন। প্লে-অফে যেতে না-পারলে আমরা প্রত্যেকে আশাহত হব। আমি এ বার বড় কিছুই আশা করছি ছেলেদের থেকে।