কানা ছেলের নাম যেমন পদ্মলোচন হলে প্রতিবেশীরা ভুরু কুঁচকোয় বা কপালে ভ্রুকুটির রেখা পড়ে, তেমনটাই হয়েছিল পুনম চতুর্বেদীর সময়ও। না, তাঁর দৃষ্টিতে কোনও সমস্যা ছিল না। জন্মের সময় মুখের অবয়বে কিছু খামতি ছিল, ঠোঁট দুটো ছিল জোড়া— সেই মেয়ের নাম আবার পুনম! উপহাস করতে ছাড়েননি প্রতিবেশীরা। তবে বজ্রাঘাত এসেছিল এর পরে। পুনমের বাবা-মাকে যখন শুনতে হয়েছিল, “এই রকম মেয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভাল। বৃথা মায়া বাড়াবেন না।”
তখন সবে শেষ হয়েছে ৪৪তম রাজ্য বাস্কেটবল চ্যাম্পিয়নশিপ। মেয়েদের বিভাগে ফাইনালে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পরে রাখী সংঘের বিরুদ্ধে ৭৮-৭০ ফলে জিতেছে পূর্ব রেল। স্কোরবোর্ড দেখে কিন্তু বোঝা যাবে না, এক জন নেমে কী ভাবে একার হাতে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিয়েছেন। সে দিনের মৃত্যুর নিদান পাওয়া সাত ফুটের পুনম। সদ্য গোড়ালির চোট সারিয়ে ফেরায় তেমন স্বচ্ছন্দ নন, পুরো ম্যাচও খেলেননি। তাতে কী! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাস্কেট করেছেন। পুনমের হাতে বল যাওয়া মানে চোখ বুজে স্কোরবোর্ডে তিন পয়েন্ট যোগ করে ফেলা।
কথা এখনও জড়োসড়ো। তবে আলাদা করে নজর কাড়বে তাঁর উচ্চতা। ম্যাচ শেষে ছোট ছোট ভক্তদের নিজস্বীর আবদার মিটিয়ে পুনম কঠিন গলায় বলছিলেন, “বড় হয়ে মায়ের মুখে মৃত্যুর অভিশাপের কথা জানতে পারি। তখন থেকেই জেদ চেপে বসেছিল কিছু করে দেখানোর। আজ আমি সফল।” তবে এই সাফল্যের কাহিনির প্রতিটি অক্ষরে রয়েছে বেদনা, চোখরাঙানি, অবজ্ঞার কথা। মুখের গড়ন ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে এলেও এক থেকে দশ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর ঠোঁটে তিন বার অস্ত্রোপচার হয়। তাতেই ঠোঁট খোলে। সে দিনের কথা মনে করে পুনম বলছিলেন, “ঠোঁট জোড়া থাকায় কিছুই খেতে পারতাম না। মা আমাকে শুধু দুধ খাইয়েবাঁচিয়ে রেখেছিলেন।”
পুনমের পরিবারে মা-বাবা ছাড়াও রয়েছেন দুই দাদা। বাবা পুলিশে চাকরি করতেন। তিনি শৈশব থেকেই চেয়েছিলেন, মেয়ে যেন নিজেকে চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি না করে ফেলে। তাই ভর্তি করিয়ে দেন বাস্কেটবলে। উত্তরপ্রদেশের কানপুরে তাঁর জন্ম হলেও সেখানে সুযোগ না মেলায় পরে পুনম চলে আসেন ছত্তীসগঢ়ে। শুরুর দিনগুলির কথা বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ স্বরে বলছিলেন, “ছোটবেলা থেকেই অনেক বিদ্রুপ ও টিটকিরি শুনতে হয়েছে। মা-বাবা না থাকলে আজ এই জায়গায় পৌঁছতে পারতাম না।”
২০১৭ সালে ২২ বছর বয়সে ভারতের সিনিয়র দলে অভিষেক হয় পুনমের। এখনও পর্যন্ত বাস্কেটবলে ভারতের মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ পুনম। ভারতীয় দলে খেলার সুবাদে চাকরিও পেয়ে যান পূর্ব রেলে। কেরিয়ারে বারবারই চোট তাঁকে ভুগিয়েছে। তাই এখন তিনি খুব বেশি ম্যাচ খেলেন না। শেষ বার জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন ২০২৩ সালের হ্যাংঝাউ এশিয়ান গেমসে।
গোড়ালির চোটে অস্ত্রোপচার হওয়ায় দীর্ঘ দিন তিনি মাঠে নামতে পারেননি। উচ্চতায় নজির গড়লেও তাঁর পেশি তেমন শক্তিশালী নয়। পুনমের কোচ সত্যব্রত নায়েক বলছিলেন, “অধিক উচ্চতার কারণে নীচের বল ধরার সময়ে ওর অসুবিধা হয়। পেশির শক্তি বাড়ানোর জন্য নানা শারীরিক অনুশীলনও শুরু করেছে। ওর প্রধান সমস্যা চোটপ্রবণতা। সে দিকেও আমাদের নজর রাখতে হয়। সদ্য চোট সারিয়ে ফেরায় সম্পূর্ন সুস্থ হতে আরেকটু সময় দরকার। তবে পুনমের হাতে বল পৌঁছলে আমরা জানি, তিন পয়েন্ট আসবেই।”
তাঁর আগামী লক্ষ্য কী? “জানুয়ারিতে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ রয়েছে। সেখানে ট্রফি জেতাই প্রধান লক্ষ্য। জাতীয় দলে নিয়মিত হতে হবে। সেরাটা উজাড় করে দিতে হবে,” দৃপ্ত কণ্ঠে বলে দেন দেশের দীর্ঘতম মহিলা বাস্কেটবল খেলোয়াড়।
যে পরিজনরা এক দিন মৃত্যুর অভিশাপ দিয়েছিলেন, সেই পরিজনদের কাছেই পুনম আজ প্রেরণার অন্য নাম। এখন আর তিনি বিদ্রুপের পাত্রী নন, বরং কানপুরে গেলে আজ সেই প্রতিবেশীরা তাঁকে দেখতে ছুটে আসেন। সন্তানদের বলেন— ‘পুনমদির পথ অনুসরণ করতে হবে।’
হ্যাঁ, নামের প্রতি সুবিচার করে পুনম এখন পূর্ণিমার চাঁদেরমতোই উজ্জ্বল!
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)