Advertisement
E-Paper

চিনের প্রাচীর উপড়ে নতুন সিন্ধু সভ্যতা

গ্লাসগোতে প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে হংকংয়ের চেং নান ই-এর বিরুদ্ধে বেশ কষ্ট করে জেতেন সিন্ধু। তার পর সুন য়ু-এর সামনে পড়েন। দীর্ঘকায় সুন য়ু ভীষণই কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী।

এন জগন্নাথ দাস

শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৭ ০৪:২২
জুটি: বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের পদক নিয়ে সিন্ধু ও সাইনা। ছবি: টুইটার।

জুটি: বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের পদক নিয়ে সিন্ধু ও সাইনা। ছবি: টুইটার।

গ্লাসগোতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সোনার স্বপ্নভঙ্গ হলেও ব্যাডমিন্টন দুনিয়ায় হইচই ফেলে দিতে পেরেছেন পি ভি সিন্ধু। এতকাল ধরে আধিপত্য দেখানো চিনের দেওয়ালেই তিনি জোরালো ধাক্কা দিয়ে দিতে পেরেছেন।

দেখা যাচ্ছে, বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে চিনা প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে অবিশ্বাস্য রেকর্ড সিন্ধুর। যা দেখে কেউ কেউ মজা করে এমন মন্তব্যও করেছেন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং ওয়েবসাইটে যে, ‘সবাইকে সরিয়ে সিন্ধুকে ডোকলামের সীমান্তে পোস্টিং দিয়ে দাও। ও একাই চিনা সেনাবাহিনীকে উড়িয়ে দেবে’।

২০১৩ থেকে হায়রদাবাদি কন্যা এই টুর্নামেন্টে অংশ নিচ্ছেন। কখনও তিনি চিনা খেলোয়াড়ের কাছে হারেননি। ২০১৩-তেই মাত্র ১৮ বছর বয়সি এক তরুণী হিসেবে সিন্ধু দ্বিতীয় বাছাই চিনের ওয়াং ইউহান-কে হারিয়ে সব চেয়ে অঘটন ঘটিয়েছিলেন। আর সে বার টুর্নামেন্ট হয়েছিল চিনেরই গুয়াংঝৌতে। চমকের সেখানেই শেষ নয়। এর পর কোয়ার্টার ফাইনালে ওয়াং শিজিয়ান-কে হারিয়ে দিলেন সিন্ধু। চিনের ডেরায় চিনকে উড়িয়ে দিয়ে সে দিন বিরাট এক বার্তাই যেন দিয়ে রেখেছিলেন এই মুহূর্তে ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের পোস্টার গার্ল!

আরও পড়ুন: পাড়ুকোন বলছেন, সর্বসেরা সিন্ধু

পরের বছর বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের আসর বসল কোপেনহেগেনে। সিন্ধু ফের হারালেন শিজিয়ান-কে। যে চ্যালেঞ্জের সামনে ভারতের অন্যান্য খেলোয়াড়রা আতঙ্কিত হয়েছেন, সেটাই তাঁকে বাড়তি প্রেরণা যুগিয়েছে। সিন্ধু সে কথা স্বীকারও করেন। কয়েক দিন আগেই তিনি বলছিলেন, ‘‘চিনাদের সামনে দাঁড়ালে কোনও বাড়তি চাপ অনুভব করি না। নিজের স্বাভাবিক ছন্দে খেলতে পারি। সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, চিনা প্রতিপক্ষ দেখলে আমি ভয় পাই না।’’ রবিবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ফাইনালে জাপানের নজোমি ওকুহারার কাছে রুদ্ধশ্বাস ম্যাচে হারলেন সিন্ধু। কিন্তু চিনা খেলোয়াড়রা তাঁকে এ বারও ধরতে পারেননি। সিন্ধু যদিও আত্মতুষ্টিতে ভুগতে চান না। বলছেন, ‘‘আমি জানি ওরা আমাকে হারানোর জন্য আরও মরিয়া ভাবে ঝাঁপাবে। ওরা ট্যাকটিকালি খুব শক্তিশালী। আর সহজে ছাড়ার পাত্রও নয়।’’

গ্লাসগোতে প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে হংকংয়ের চেং নান ই-এর বিরুদ্ধে বেশ কষ্ট করে জেতেন সিন্ধু। তার পর সুন য়ু-এর সামনে পড়েন। দীর্ঘকায় সুন য়ু ভীষণই কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী। উচ্চতার জন্য দারুণ স্ম্যাশ করেন এবং তাঁর বিশেষত্ব হচ্ছে, প্রতিপক্ষের গায়ের মধ্যে স্ম্যাশ করে যেতে পারেন। কিন্তু সিন্ধু এমন কঠিন প্রতিপক্ষকে নিয়েও কার্যত ছেলেখেলা করলেন।

প্রাক্তন জাতীয় কোচ এবং কিংবদন্তি ব্যাডমিন্টন প্রশিক্ষক সৈয়দ মহম্মদ আরিফ মনে করেন, পুরো ব্যাপারটাই আত্মবিশ্বাসের উপর নির্ভর করে। ‘‘কেরিয়ারের শুরু থেকে চিনের বড় বড় নামকে হারিয়েছে সিন্ধু। আমার মনে হয় সেটাই ওকে এতটা আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে,’’ বলেন আরিফ। ছেলেবেলায় প্রথম আরিফ স্যারের কাছেই সিন্ধুকে ভর্তি করেছিলেন তাঁর বাবা, প্রাক্তন ভলিবল খেলোয়াড় রামানা। তাঁর কাছেই ব্যাডমিন্টনের প্রাথমিক পাঠ পান আজকের তারকা। এ বারের কোয়ার্টার ফাইনালে চিনের তারকা সুন য়ু-কে হারানো নিয়ে প্রাক্তন শিক্ষকের মন্তব্য, ‘‘য়ু-এর বিরুদ্ধে খুব আক্রমণাত্মক খেলেছে সিন্ধু। শুরু থেকে আক্রমণ করেই প্রতিপক্ষকে ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছিল।’’

কিন্তু য়ু-কে হারানো দিয়েই চিনা-বধের অভিযান শেষ হয়নি সিন্ধুর। এর পর সেমিফাইনালে তিনি হারান ছেন ইউফিয়াই-কে। প্রাক্তন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন রাচানক ইন্থানন-কে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠেছিলেন চিনের ব্যাডমিন্টনে উদীয়মান তারকা ছেন। মনে করা হয়েছিল, এটাই টুর্নামেন্টের সেরা ম্যাচ হতে যাচ্ছে। কিন্তু সিন্ধু ফের তাঁর চিনা প্রতিপক্ষকে দুরমুশ করে বেরিয়ে যান। ‘‘আমার মনে হয়, উল্টে এখন চিনের খেলোয়াড়রাই ভয়ে ভয়ে থাকছে সিন্ধুর সামনে পড়লে। ও চিনের সব বড় বড় খেলোয়াড়কে হারিয়েছে। সেই কারণে ছেন-এর মতো প্রতিশ্রুতিমানও উদ্বেগে ছিল,’’ বললেন আরিফ। যোগ করেন, ‘‘আমরা কিন্তু বিশ্ব ব্যাডমিন্টনে একটা শক্তি হয়ে উঠেছি।’’

যাঁর সুদক্ষ হাত সিন্ধুর এই চিনা-বধের পিছনে রয়েছে, সেই পুল্লেলা গোপীচন্দ বলছেন, ‘‘চিন সব সময়ই ব্যাডমিন্টনের সুপারপাওয়ার ছিল। কিন্তু আমি বিশ্বাস করে এসেছি যে, ওদের হারানো যায়। ওরা অপরাজেয় নয়। পরিকল্পনা আর পরিশ্রম ঠিক মতো করলেই ওদের হারানো যাবে।’’

কোচ হিসেবে গোপীই প্রথম এই অভিযানে নেতৃত্ব দেন। সাইনা নেহওয়ালের মধ্যে তিনি পেয়ে গিয়েছিলেন এক আদর্শ ছাত্রী। যে ছিল ভয়ডরহীন। গুরুর কথা শুনে প্রাণপাত পরিশ্রম করতে যার কোনও আপত্তি ছিল না। ‘‘আমাদের দেশেও ভাল খেলোয়াড় ছিল। কিন্তু শক্তি আর গতিতে পিছিয়ে ছিলাম আমরা। চিনের প্রাচীর ভাঙাটা তাই একটা সময় হিমালয় অভিযানের মতোই অসাধ্য মনে হতো,’’ বলছেন গোপী।

সাইনাই প্রথম সেই অসাধ্য সাধন করলেন। ২০১০ সালে হং কং ওপেন সুপার সিরিজে সাইনা হারালেন শিজিয়ান-কে। সেটাই ছিল ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের হাতে চিনের একনায়কতন্ত্র শেষ হওয়ার প্রথম ধাপ। গুরু গোপীর মন্ত্রে দীক্ষিত সাইনা বার বার বলেছেন, ‘‘কোর্টে ঢোকার সময় আমি কখনও দেখি না প্রতিপক্ষ কোন দেশের। চিনের খেলোয়াড় কি না, সেটা আমি মাথাতেই নিই না। আমার একমাত্র লক্ষ্য থাকে জেতা আর আমি হারতে ঘৃণা করি।’’ আরও বলেন, ‘‘চিনের থেকে কোনও অংশে আমরা পিছিয়ে আছি বলে কখনও মনে করিনি।’’

সাইনা তবু চিনের বিরুদ্ধে কখনও জিতেছেন, কখনও হেরেছেন। তাঁর আমলেও পুরোপুরি চিনা আধিপত্যের অবসান ঘটেনি। যেটা ঘটছে নতুন সিন্ধু সভ্যতায়। যদিও সাইনার এখনকার কোচ বিমল কুমার মনে করেন, চিনের প্রাচীর ভেঙে ফেলার জন্য সমপরিমাণ কৃতিত্ব দিতে হবে সাইনাকেও। ‘‘ও-ই প্রথম দেখিয়েছে যে, চিনা প্রতিপক্ষদেরও হারানো যায়। শুরুটা অবশ্যই সাইনা করেছিল। তার পর সেটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সিন্ধু। এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, চিনের ব্যাডমিন্টনে যুগ বদলের পর্ব চলছে। ওদের তারকা খেলোয়াড়রা অবসর নিচ্ছে, কয়েক জন চোট-আঘাতেও ভুগছে।’’ স্বীকার করতেই হবে যে, পাল্টা আক্রমণে প্রতিপক্ষের কোর্টে শাট্ল পাঠিয়ে দিয়েছেন সিন্ধুরা। ভারতীয়রা আর চিনকে দেখে আতঙ্কিত হন না, বরং তাঁদের দেখেই এখন চিন ভয় পাচ্ছে।

(লেখক তেলঙ্গানা টুডে-র সহকারী সম্পাদক)

PV Sindhu Saina Nehwal Badminton World Championship Badminton পি ভি সিন্ধু বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy