Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
লোঢা সংস্কারের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হতে চলেছে বোর্ড

সৌরভ-শাহের পুরো মেয়াদের প্রস্তাব, শ্রীনিও উঠেছেন ভেসে

প্রায় চার বছর ধরে চলা লোঢা কমিটির সুপারিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধং দেহি মনোভাব এখনও ছেড়ে বেরোতে পারছেন না দেশের ক্রিকেট কর্তারা। বোর্ডের ক্ষমতায় ফিরেই তাই লোঢা সংস্কারের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে পাল্টা চ্যালেঞ্জ করে তাঁরা ফের ছুটছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালতে।

নেতৃত্ব: প্রেসিডেন্ট সৌরভকে সামনে রেখেই বোর্ডের গঠনতন্ত্রে আমূল পরিবর্তন আনার উদ্যোগ শুরু। ফাইল চিত্র

নেতৃত্ব: প্রেসিডেন্ট সৌরভকে সামনে রেখেই বোর্ডের গঠনতন্ত্রে আমূল পরিবর্তন আনার উদ্যোগ শুরু। ফাইল চিত্র

সুমিত ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৯ ০৩:১৩
Share: Save:

নাগপুরে যখন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সিরিজ জয়ের লড়াই চালাচ্ছেন শ্রেয়স আইয়ারেরা, মাঠের বাইরে তখন ফের বড়সড় যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে তাঁদের ক্রিকেট বোর্ড।

প্রায় চার বছর ধরে চলা লোঢা কমিটির সুপারিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধং দেহি মনোভাব এখনও ছেড়ে বেরোতে পারছেন না দেশের ক্রিকেট কর্তারা। বোর্ডের ক্ষমতায় ফিরেই তাই লোঢা সংস্কারের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে পাল্টা চ্যালেঞ্জ করে তাঁরা ফের ছুটছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালতে। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, জয় শাহ পরিচালিত নতুন ক্রিকেট বোর্ড তাদের প্রথম বার্ষিক সাধারণ সভা করতে চলেছে আগামী ১ ডিসেম্বর। আর সেখানে সংস্থার গঠনতন্ত্রে বড়সড় রদবদল আনার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে চলেছে। বাংলার ক্রিকেটপ্রেমীদের আশা বাড়িয়ে তুলতে এই প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে, প্রেসিডেন্টের মেয়াদ এবং লোঢা সংস্কারে প্রস্তাবিত ‘কুলিং অফ’ নিয়ম পাল্টে ফেলা। লোঢা সুপারিশে বলা হয়েছিল, রাজ্য সংস্থা বা বোর্ড যে কোনও জায়গায় টানা ছ’বছর কাটিয়ে ফেললেই এক জন প্রশাসককে বাধ্যতামূলক ‘কুলিং অফ’ পর্বে যেতে হবে। আর সেই বিশ্রাম পর্ব হবে তিন বছরের। এই সময়ে রাজ্য বা বোর্ড কোনও সংস্থাতে কোনও পদেই সেই ব্যক্তি থাকতে পারবেন না। এই নিয়ম বলবৎ থাকলে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেয়াদ হবে দশ মাসের। কারণ সিএবি-তে পাঁচ বছরের উপরে তিনি কাটিয়েই ফেলেছেন। যা নিয়ে মুম্বইয়ে সৌরভ মসনদে বসার সময়েই বোর্ড কর্তাদের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হয়ে গিয়েছিল যে, বোর্ডে কখনও কোনও পদে না থাকা কাউকে মাত্র দশ মাস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করে চলে যেতে হবে কেন? সেই আলোচনা আরও চড়া সুর নিতে চলেছে এ বার। বোর্ডের ক্ষমতা ফিরে পাওয়া ক্রিকেট কর্তারা নতুন করে আদালতে আবেদন করবেন যে, প্রেসিডেন্ট এবং সচিবের ক্ষেত্রে বোর্ডের মেয়াদটাই ধরা হোক। অর্থাৎ, সৌরভ বা সচিব জয় শাহ কত দিন তাঁদের রাজ্য সংস্থায় কাটিয়েছেন সেটাকে বাইরে রেখে হিসাব করা হোক, বোর্ডের পদে তাঁরা কত দিন কাটিয়েছেন। নতুন প্রস্তাব হল, বোর্ডের দুই সব চেয়ে প্রভাবশালী কর্তা প্রেসিডেন্ট এবং সেক্রেটারিকে বোর্ডের পদাধিকারী হিসেবে দু’টি মেয়াদ অর্থাৎ ছয় বছর কাটানোর পরেই ‘কুলিং অফে’ পাঠানো হোক।

এ দিকে, লোঢা সুপারিশ অনুযায়ী বোর্ডের নতুন গঠনতন্ত্র তৈরি হয়ে গিয়েছে। সেই গঠনতন্ত্র মেনেই সমস্ত রাজ্য সংস্থায় নির্বাচন হয়েছে। এমনকি, বোর্ডে নির্বাচনহীন পদাধিকারী চয়নও করতে হয়েছে সেই গঠনতন্ত্র মেনে। সুপ্রিম কোর্টে সিওএ সেই গঠনতন্ত্র পাশও করিয়েছে। সব জেনেও বোর্ড কর্তারা ফের দ্বারস্থ হতে চান সর্বোচ্চ আদালতের। নতুন করে আর্জি জানাতে চান যে, লোঢা সুপারিশ মেনে তৈরি হওয়া গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বোর্ড পরিচালনায় বাস্তবগত সমস্যা থেকে যাচ্ছে। ‘‘এখনকার গঠনতন্ত্র মানতে গেলে বোর্ড পরিচালনা করার মতো যথেষ্ট অভিজ্ঞ এবং পাকাপোক্ত লোকই পাওয়া যাবে না। প্রত্যেক বারই নতুন কাউকে আনতে হবে,’’ বললেন ওয়াকিবহাল কয়েক জন কর্তা। সুপ্রিম কোর্ট তাদেরই এক বার পাশ করা নিয়মকে ফের পাল্টানোর ব্যাপারে মত দেবে কি না, তা দেখার। তবে যদি কোনও ভাবে ‘কুলিংঅফ’ নিয়ে তাঁদের আর্জি শোনা হয়, তা হলে সৌরভ এবং অমিত শাহ-পুত্র জয় দু’জনেরই অন্তত তিন বছর করে প্রেসিডেন্ট এবং সচিব পদে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হবে।

শুধু তা-ই নয়, ক্রিকেট প্রশাসনে সরকারি ভাবে অভাবনীয় প্রত্যাবর্তন ঘটানোর দরজা খুলে যেতে পারে এন শ্রীনিবাসনের সামনেও। এমনিতে সিওএ শাসন শেষ করে নতুন যে বোর্ড গঠিত হয়েছে, সেখানে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছেন শ্রীনি। পাঁচ পদাধিকারীর অন্তত তিন জন তাঁর লোক। তাঁরই পছন্দের প্রার্থী ব্রিজেশ পটেলই প্রেসিডেন্ট হয়ে যাচ্ছিলেন। শেষ মুহূর্তের মহানাটকে সৌরভ মসনদে বসেন। কিন্তু নেপথ্যে কলকাঠি নাড়িয়েও প্রকাশ্যে আসার রাস্তা কার্যত বন্ধই হয়ে গিয়েছে শ্রীনির সামনে যে-হেতু তিনি সত্তর পেরিয়ে গিয়েছেন এবং নিজের রাজ্য সংস্থা তামিলনাড়ুতে সরকারি ভাবে আর পদেও থাকতে পারছেন না। নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী, শ্রীনিকে স্বমহিমায় ফিরিয়ে আইসিসি-তে ভারতীয় বোর্ডের প্রতিনিধি হিসেবে পাঠানোর কথা ভাবা হচ্ছে। যে পরিকল্পনার খবর আগেই প্রকাশিত হয়েছে আনন্দবাজারে। সত্তর বছরের ঘেরাটোপ কাটিয়ে শ্রীনিকে যাতে আইসিসি-তে পাঠানো যায়, তা নিয়েও সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করবেন সৌরভ, জয় শাহ-রা। তাঁরা আর্জি জানাবেন, আইসিসি-তে অভিজ্ঞ কাউকে না পাঠালে বিশ্ব ক্রিকেট প্রশাসনে ভারতীয় বোর্ডের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় বোর্ডের প্রাক্তন সর্বময় কর্তারা যত জন আছেন— শ্রীনি থেকে অনুরাগ ঠাকুর— প্রত্যেকের ‘কমন’ শত্রু শশাঙ্ক মনোহর। এঁরা মনে করেন, মনোহর ভুল বুঝিয়ে তাঁদের কোণঠাসা করে দিয়েছেন। কয়েক জনের কথায়, ‘‘বোর্ড প্রেসিডেন্ট হয়ে যা যা বলেছিল, একটাও কথা রাখেনি। উল্টে আইসিসি-তে গিয়ে ভারতের লোক হয়েও ভারতকে কোণঠাসা করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। এখনও সেটা করে চলেছে।’’ শ্রীনি আইসিসি প্রধান হয়ে ত্রিশক্তির জোট তৈরি করেছিলেন ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডকে নিয়ে। ঠিক হয়েছিল, যে-হেতু এই তিনটি দেশ সব চেয়ে বেশি টাকা আনে, লভ্যাংশ থেকেও তারা সব চেয়ে বেশি অংশ পাবে। সেই নকশা অনুযায়ী সব চেয়ে বেশি অর্থ পেত ভারতীয় বোর্ডই। কিন্তু মনোহর আইসিসি প্রধান হয়ে তা পাল্টে দেন এবং ভারতীয় বোর্ডের প্রাপ্ত অর্থ অনেক কমে যায়। শুধু তা-ই নয়, ভারতীয় কর্তাদের সন্দেহ, আইপিএল-কে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলতে মনোহর এখন উঠেপড়ে লেগেছেন, প্রত্যেক বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ করার জন্য। ইতিমধ্যেই ভারতীয় বোর্ড যা নিয়ে আপত্তি তুলে বলেছে, তারা কিছুতেই এই প্রস্তাব মেনে নেবে না। ভিতরে-ভিতরে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গেও কথা বলা শুরু হয়েছে। বাকি দুই বোর্ডও মুখ খুলতে শুরু করেছে। ইংল্যান্ড ইতিমধ্যেই হুঙ্কার ছেড়েছে, তারা আইসিসি-র ফিউচার টুর প্রোগ্রামে (এফটিপি) সই করবে না। ত্রিশক্তিকে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টাও চালু হয়েছে বলে খবর।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট প্রশাসনে ভারতীয় কর্তাদের লক্ষ্য যদি হন মনোহর, তা হলে দেশের ক্ষেত্রে টার্গেট লোঢা কমিশন এবং সিওএ। কয়েক মাস আগে সিওএ দ্বারা নিযুক্ত অম্বাড্‌সম্যান এবং এথিক্স অফিসার পাল্টে ফেলে নতুন ব্যক্তিদের আনা হতে পারে। প্রাক্তন বিচারপতি আর এম লোঢা এমন ভাবে সংস্কারকে সাজিয়েছিলেন যাতে সচিবের ক্ষমতা খর্ব হয়, সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন চিফ এগজিকিউটিভ অফিসার (সিইও)। এই সূত্র ধরে গত কয়েক বছরে ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিলেন বোর্ডের সিওএ রাহুল জোহরি। ক্ষমতায় ফিরে এসেই কর্তারা সেটাকে পাল্টে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র সিইও থেকে ফের সচিবের চেয়ারে নিয়ে যেতে চান। ১ ডিসেম্বরের বৈঠকে তা নিয়েও আলোচনা হবে এবং ধরেই নেওয়া যায়, এই মর্মে ডিসেম্বরেই সুপ্রিম কোর্টে আর্জিও জমা পড়তে চলেছে। এবং, কোনও ভাবেই চোখ এড়ানোর কথা নয় যে, বোর্ডের নতুন সচিব হয়েছেন পরাক্রমশালী বিজেপি নেতা অমিত শাহের পুত্র জয়। সর্বোচ্চ আদালত কর্তাদের আর্জি শুনতে রাজি হলে শাহ-পুত্রের বোর্ডে ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠা শুধু সময়ের অপেক্ষা! তখন আরও জোরে না প্রতিধ্বনি শোনা যায়— চার বছরে এত কাঠখড় পুড়িয়ে লোঢা সংস্কার তা হলে কী হল?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Saurav Ganguly BCCI Cricket
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE