Advertisement
E-Paper

নেই-রাজ্য আটকে দিচ্ছে সিন্ধু হওয়ার স্বপ্ন

কোথাও অল্প আলোয় শাটলকক খুঁজে পেতেই কষ্ট। কোথাও বৃষ্টি পড়লে মাথার উপর ছাদ ফেটে জল পড়ে। সাইয়ের একটা কোর্টে খেলা চললে কাঁপতে থাকে পাশের কোর্ট।

কলকাতার অ্যাকাডেমিতে এ ভাবেই চলে প্রশিক্ষণ। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।

কলকাতার অ্যাকাডেমিতে এ ভাবেই চলে প্রশিক্ষণ। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।

দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০১৬ ০৩:৩১
Share
Save

কোথাও অল্প আলোয় শাটলকক খুঁজে পেতেই কষ্ট। কোথাও বৃষ্টি পড়লে মাথার উপর ছাদ ফেটে জল পড়ে।

সাইয়ের একটা কোর্টে খেলা চললে কাঁপতে থাকে পাশের কোর্ট। কোনও কোনও ক্লাবে আবার সিমেন্টের কোর্টে খেলতে হয় প্লেয়ারদের। খেলতে খেলতে পায়ের পেশি হয়ে যায় শক্ত।

কেউ কেউ আবার শাটলকক নষ্ট হয়ে যাবে বলে ‘স্ম্যাশ’ করতেই ভয় পান। নিজেকে নিখুঁত করে তোলার ইচ্ছে শেষ হয়ে যায় অনেক, অনেক আগে। শাটলকক না থাকলে খেলা সম্ভব কী ভাবে?

এর সঙ্গে জুড়ে দিন রাজ্য সংস্থার প্রবল গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। তীব্র খেয়োখেয়ি। প্রতিভার উন্নতিসাধনে যে পরিবেশ প্রয়োজন, তা নেই। তাই তো প্রতিভারা চলে যান। ঋতুপর্ণা দাস তেলঙ্গানায়। জিষ্ণু স্যান্যাল-শুভঙ্কর দে-দের ঠিকানা হয় মহারাষ্ট্র।

পরিবেশ নেই। পরিকাঠামো নেই। যে সব প্রতিভার ক্ষমতায় কুলোচ্ছে, তারা চলে যাচ্ছে অন্য রাজ্যে। যারা পারছে না, তারা পড়ে থাকছে ভয়ে-ভয়ে। মুখ খোলে না কেউ। নির্বাসন নেমে আসবে যে!

এটা বাংলার ব্যাডমিন্টন।

এটা রাজ্য ব্যাডমিন্টন সংস্থার চালচিত্র।

শৌভিক ঘোষ, শেষাদ্রি সান্যালরা কতিপয়দের কেউ কেউ যাঁরা এত অসুবিধে সত্ত্বেও এ রাজ্যে পড়ে আছেন। এঁরা স্বপ্ন দেখেন, একদিন কিদাম্বি শ্রীকান্ত বা পিভি সিন্ধু হবেন। অলিম্পিক্সে গলায় পদক উঠবে। কিন্তু বাস্তব জানতে চান? শেষাদ্রির মা শ্যামলী দেবীকে জিজ্ঞেস করা হল, মেয়েকে টোকিও অলিম্পিক্সে দেখতে পাচ্ছেন কি না? শ্যামলী দেবী বললেন, ‘‘জানি না এই পরিকাঠামোয় মেয়ে কত দিন টানতে পারবে।’’ আর মেয়ে? কথাই বলতে চাইছে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রী শেষাদ্রির আর্তনাদ, ‘‘ওরে বাবা! সাসপেন্ড করাতে চাইছেন নাকি? কোনও মন্তব্য করব না।’’

কিন্তু এ রকম অবস্থা কেন? কেন বাংলা ব্যাডমিন্টন এমন নেই রাজ্যের বাসিন্দা? রাজ্য ব্যাডমিন্টন সংস্থার প্রেসিডেন্ট উষানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘আমাদের সবচেয়ে বড় অসুবিধে হল কোনও অ্যাকাডেমি নেই। ভাল কোচ আমাদেরও আছে। কিন্তু পরিকাঠামো কোথায়?’’ সঙ্গে যোগ করলেন, ‘‘সবার আগে একটা রেসিডেনশিয়াল কমপ্লেক্স দরকার। যা চব্বিশ ঘণ্টা ব্যাডমিন্টনের জন্য বরাদ্দ থাকবে। যেখানে আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকবে। তবে না ভাল কিছু সম্ভব? আমরা সরকারের কাছে জমি চেয়েছি তার জন্য। বছর চারেক আগে চেয়েছি। ওঁরা চেষ্টা করছেন। এখনও ব্যাপারটা হয়নি। আমি বলব, পরিকাঠামোর অভাবেই বাংলা থেকে ঋতুপর্ণা দাসের মতো প্রতিভা বেরিয়ে গিয়েছে।’’

ঋতুপর্ণা শুধু নন, আরও অনেকে বেরিয়ে গিয়েছেন। যেমন রিয়া মুখোপাধ্যায়। জাতীয় সার্কিটে আজ নামেন উত্তরপ্রদেশের হয়ে! রিয়ার বাবা ইন্দ্রজিৎ মুখোপাধ্যায় এক সময়ের রাজ্য কাঁপানো ব্যাডমিন্টন প্রতিভা। মেয়েকে বাইরে পাঠালেন কেন? শুনে উত্তেজিত হয়ে পড়েন ইন্দ্রজিৎ। হায়দরাবাদ থেকে ফোনে বেরোতে থাকে অসূয়া, ‘‘কলকাতায় ব্যাডমিন্টনের নামে কী হয়, সবাই জানে। কাঠের কোর্ট তো আমার রাজ্যে দূরবিন দিয়ে খুঁজতে হবে। তার উপর অসুবিধে করার লোকও প্রচুর। বাধ্য হয়েই মেয়েকে বাইরে পাঠিয়েছি।’’ এটা কি ভাল বিজ্ঞাপন বাংলার জন্য? দিনের পর দিন যে ভাবে বীতশ্রদ্ধ খেলোয়াড়কুল বাংলা ছেড়ে চলে যাচ্ছে? শুনে পশ্চিমবঙ্গ ব্যাডমিন্টন সংস্থার সচিব শেখর বিশ্বাস বলে দেন, ‘‘এটাও কিন্তু সত্যি যে, বাংলা ছেড়ে চলে যাওয়া অরিন্তপ দাশগুপ্তকে আমরা ফিরিয়ে এনেছি। তা ছাড়া ব্যাডমিন্টন ব্যক্তিগত খেলা। কেউ যদি আরও উন্নত পরিকাঠামোর খোঁজে চলে যায়, ধরে রাখব কী ভাবে?’’

হায়দরাবাদের গাচ্চিবোলির গোপীচন্দের দুটো অ্যাকাডেমিতে সতেরোটা কোর্ট আছে শোনা যায়। বাংলার নব্বই শতাংশ ব্যাডমিন্টন ক্লাবে সেখানে একটার বেশি নেই। পুরো তিন গেমের ম্যাচ সিচুয়েশনের প্র্যাকটিস অর্ধেক সময় তাই পাওয়াই যায় না। শনিবার অর্ডিন্যান্স ক্লাবে বেঙ্গল ব্যাডমিন্টন অ্যাকাডেমিতে বসে কোচ সঞ্জয় রায় বলছিলেন, ‘‘সাইনা বা সিন্ধু দিনে হয়তো পাঁচ-ছ’ ঘণ্টা একটা কোর্টে প্র্যাকটিস করতে পারে। সেখানে আমাদের রাজ্যে ছেলে-মেয়েরা দিনে মেরেকেটে তিরিশ মিনিট হয়তো পায়। এ ভাবে হয়?’’ জুনিয়র পর্যায়ে রাজ্য চ্যাম্পিয়ন হওয়া রাজদীপ তীব্র হতাশায় তাই বলে ফেলেন, ‘‘কাঠের কোর্ট প্রায় নেই বললেই চলে। রাজ্য সংস্থার কোনও অ্যাকাডেমি নেই। সিন্ধুদের কিন্তু এই পরিকাঠামোয় বড় হতে হয়নি।’’ যাদবপুরের এক ক্লাবের এক প্লেয়ারের বক্তব্য বেশ অবাক করার মতো। শাটলককের একটা বাক্স পড়ে নাকি বারোশো টাকা মতো। কিন্তু লাফিয়ে দু’তিনটে স্ম্যাশ করলেই শাটলককের দফারফা! অনেক কোচ নাকি সেই ভয়ে স্ম্যাশ প্র্যাকটিসটাই তুলে দিয়েছেন! এটাও শোনানো হল, পশ্চিমবঙ্গ ব্যাডমিন্টন অ্যাসোসিয়েশনের শিবির গত বছরও সিমেন্টের কোর্টে হয়েছে। এ বছর সাইতে হয়েছে। কিন্তু সেখানে আবার আর এক বিপত্তি। সাইয়ের কোর্টে আবার পেরেক উঠে থাকে!

কোচ— তা নিয়েও তো অভিযোগ। পুরো সময়ের পেশাদার কোচ নাকি নেই। যাঁরা কোচিং করান, বেশির ভাগ নাকি চাকরি করেন। ফলে একজন গোপীচন্দ যে সময়টা দেন কোনও এক পিভি সিন্ধুর পিছনে, তা এখানে হয় না। সম্ভবই নয়।

কী দাঁড়াল?

পর্যাপ্ত কাঠের কোর্ট নেই। পূর্ণ সময়ের পেশাদার কোচ নেই। অর্থ—তা-ও নেই। একটা স্ম্যাশ মারতে দু’বার ভাবতে হয়, চিন্তা করতে হয় কোচের শাসানি নিয়ে।

পিভি সিন্ধু এমনি এমনি পিভি সিন্ধু হননি। আর যা-ই হোক, বঙ্গ প্রতিভাদের মতো তাঁকে অন্তত শাটলককের ভাগ্য নিয়ে ঘুরতে হয়নি!

Rio Olympics Badminton

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}