Advertisement
E-Paper

হ্যারি কেনের আলোয় কাপ জয়ের স্বপ্ন ইংল্যান্ডের

মঙ্গলবার রাতেই যে তাঁর অধিনায়ক ছুঁয়ে ফেলেছেন দেশেরই কিংবদন্তি গ্যারি লিনেকারকে। ’৮৬ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে তোলার পথে ছ’টা গোল করেছিলেন লিনেকার।

রতন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৮ ০৫:৫৫
সফল: দলকে শেষ আটে তুলে হ্যারি কেন। ফাইল চিত্র

সফল: দলকে শেষ আটে তুলে হ্যারি কেন। ফাইল চিত্র

নেচেই চলেছেন ওঁরা। অবিরাম, অবিশ্রান্ত, উদ্দাম। ছেলে, মেয়ে, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা কে নেই সেই দলে! কারও যেন বাড়ি ফেরার কোনও তাড়াই নেই। নেই অন্য কোনও কাজ। সঙ্গে চলছিল তালে তালে গান, ‘‘হ্যারি কেন, হ্যারি কেন, উই শ্যাল উইন এগেইন।’’ পুলিশ কিছুতেই তাঁদের স্পাটার্ক স্টেডিয়ামের মেট্রোয় তুলে দিতে পারছে না। বিশ্বকাপে প্রথম বার টাইব্রেকারে জিতে শেষ আটে যাওয়ার অসাধারণ ম্যাচ ওঁদের যেন মঙ্গলবার রাতে নিয়ে গিয়েছে অন্য গ্রহে।

ঘণ্টাখানেক আগেই শুনে এসেছি ইংল্যান্ড অধিনায়ক হ্যারি কেনের গর্জন। ‘‘আমরা ফের ইতিহাস তৈরি করব। অপেক্ষা করুন। এই টিমের সেই ক্ষমতা আছে।’’ সাংবাদিক বৈঠক, তাতে কী! ইংল্যান্ড সাংবাদিকদের মুখ থেকে উচ্ছ্বাসের শব্দগুলো ‘ও....ও....ও’ হয়ে ছড়িয়ে পড়ল পুরো ঘরে। ফিফার সঞ্চালকও কড়া চোখের বদলে কেমন যেন আনমনা। তিনিও কি ইংল্যান্ডের ফুটবলার, সমর্থক, সাংবাদিকদের মতো ১৯৬৬-র ববি মুরের কাপ জয়ী টিমের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন এ বারের গ্যারেথ সাউথগেটের দলে? ‘‘আমার ছেলেরা নতুন ইতিহাস তৈরি করতে পারে আবার। ছুঁতে পারে অর্ধ শতক আগের সম্মান,’’ রাহিম স্টার্লিং, জর্ডন পিকফোর্ডদের কোচ যখন এ সব বলছিলেন তখন তাঁকে কেউ পাল্টা প্রশ্ন করে না। করবেই বা কেন?

মঙ্গলবার রাতেই যে তাঁর অধিনায়ক ছুঁয়ে ফেলেছেন দেশেরই কিংবদন্তি গ্যারি লিনেকারকে। ’৮৬ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে তোলার পথে ছ’টা গোল করেছিলেন লিনেকার। হ্যারি কেন তাঁকে ছুঁয়ে ফেললেন রাশিয়ায়। জিওফ হার্স্টকে (৫) তো বটেই।

আরও পড়ুন: ‘সাহস ও ক্ষিপ্রতায় নজর কেড়েছেন আকিনফেভ’

সেটা মনে করাতেই ইংল্যান্ড অধিনায়ক উচ্ছল। ‘‘ব্যক্তিগত রেকর্ড হলে ভাল লাগে। কিন্তু যে ভাবে আমাদের টিম জিতল তাতে মনে হয় অন্য একটা রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলব আমরা।’’ তাঁর স্পষ্ট ইঙ্গিত ট্রফির দিকে। লিনেকার নিজে দিয়েগো মারাদোনার মতো নাটুকে নন। ব্রিটিশরা অবশ্য তা করেনও না। মেক্সিকোর যে বিশ্বকাপে মারাদোনার ‘হ্যান্ডস অব গড’-এর দৌলতে সেই চমকপ্রদ জয় পেয়েছিল আর্জেন্টিনা, সেখানেই রেকর্ডটা করেছিলেন লিনেকার। তা এ দিন ছুঁয়ে
ফেললেন কেন।

এক অনুজ তাঁর বিশ্বকাপের একটি রেকর্ড ছুঁয়েছেন, ইংল্যান্ডের হয়ে তাঁর বিশ্বকাপে করা গোলের রেকর্ড (১০) হয়তো ভেঙে ফেলবেন এ বার। তা জেনেও টুইটে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন লিনেকার। টিভি ভাষ্য দিতে দিতেই কয়েক মিনিটের মধ্যেই চলে এসেছে তাঁর বার্তা। ‘‘ফুটবলে সব হতেই পারে। এটা কিছুই না। শুভেচ্ছা রইল।’’ আরও চমকপ্রদ ব্যাপার হল, যে জার্সি পরে লিনেকার ছয় গোল করেছিলেন মেক্সিকোতে, ট্রফি ক্যাবিনেট থেকে বের করে সেটা নিয়ে এ দিন মাঠে এসেছিলেন লিনেকারের ছেলে জর্জ। কী অসাধারণ ‘উপহার’ ইংল্যান্ডের নতুন নায়কের জন্য ছিল এ দিন গ্যালারিতে!

কলম্বিয়ার সঙ্গে উত্তেজক, হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচের পরে জয়। এবং সেটা টাইব্রেকারের শেষ কিকের পরে। স্পাটার্ক স্টেডিয়ামের রাতটাকে আরও মায়াবী করে দিল নানা টুকরো টুকরো দৃশ্যে। মাঠে উপস্থিত কলম্বিয়ার হলুদ সমর্থকরা যখন জার্সি আর পতাকা চোখের জলে ভেজাচ্ছেন, তখন দেখা গেল হ্যারি কেন এবং তাঁর সতীর্থরা কেউ বান্ধবীদের কাছে, কেউ পরিবারের সঙ্গে সেলফি তুলতে ব্যস্ত। সেখান থেকে মিক্সড জোনে বা সাংবাদিক বৈঠকে আসতে অনেকটা সময় নিলেন সবাই। ভারতে যখন ভোরের আলো ফুটছে তখন মিডিয়ার সামনে কেন। ‘‘এটা ইংল্যান্ডের জন্য একটা অসাধারণ রাত। এই জয় আমাদের আরও শক্তি জোগাবে।’’ ইংল্যান্ড থেকে আসা দর্শকরা ইতিমধ্যেই ওয়েন রুনির সঙ্গে তুলনা করতে শুরু করেছেন তাঁকে। তবে ডেভিড বেকহ্যামের উপরে উঠতে দিতে চাননি। মেট্রো স্টেশনে প্রেমিকের সঙ্গে হাঁটতে থাকা নটিংহ্যামশায়ার থেকে আসা শার্লিন বলছিলেন, ‘‘হ্যারি যদি সোনার বুট পায় তা হলে ওকে বেকহ্যামের উপরে রাখব আমরা।’’ পেশায় শিক্ষিকা, গায়ে জড়িয়ে রেখেছেন ইংল্যান্ডের পতাকা। ‘‘আজকের অনুভূতিটা অসাধারণ। দারুণ উপভোগ করলাম। তবে আমাদের গোলকিপার আজ দারুণ খেলেছে। অনেক দিন পর একটা ভাল দল পেয়েছি আমরা।’’

হ্যারি কেন এমনিতে একটু মেজাজি। কিন্তু পেনাল্টি মারার সময় তাঁর মাথা থাকে বরফ-ঠান্ডা। মঙ্গলবার রাতের পেনাল্টি ধরলে সাত গোল হয়ে গেল তাঁর। এর মধ্যে চারটে পেনাল্টি থেকে। এক সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করলেন, সবাই বলছে পেনাল্টি মারায় আপনি লিয়োনেল মেসি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর চেয়ে অনেক এগিয়ে? প্রশ্ন শুনে বেশ চটে গেলেন সাউথগেটের টিমের কোহিনুর। ‘‘ওরা দু’জনে কি এখনও বিশ্বকাপে আছে? আমি কিন্তু আছি। আর এটা জেনে রাখুন, অন্য গোলের চেয়ে পেনাল্টি মারা সব সময় কঠিন। কিংবদন্তিরাও নষ্ট করে। সেটা আমি কতটা রপ্ত করেছি দেখে যান। মাঠেই তো দেখাচ্ছি কে সেরা!’’ একটু কাটখোট্টা ধরনের মনে হল কেনকে। হাসেন কম। শরীরী ভাষায় বোহেমিয়ান ভাব। যিনি প্রকাশ্যেই বলতে পারেন ছোট বেলা থেকে যাঁকে প্রেম করেছি তাকেই বিয়ে করব, তিনি ঠোঁটকাটা হবেন সেটাই স্বাভাবিক। ‘‘আমাদের দলটা অনভিজ্ঞ বলে খুব সমালোচনা হচ্ছিল। আজ কী মনে হচ্ছে? আমরা অভিজ্ঞ?’’ সাংবাদিক বৈঠকে দেখে মনে হল ব্রিটিশ মিডিয়া তাঁকে নিয়ে যতই হইচই করুক এখন, সামনের বাস্তবটা তিনি জানেন। সুইডেনের সঙ্গে শেষ আটের লড়াইয়ে কিছু হলেই ছিঁড়ে খাবে সবাই। ‘‘আমি জানতাম পিকার (গোলকিপার পিকফোর্ড) একটা বল সেভ করবেই। আমরা সংঘবদ্ধ ছিলাম। ম্যাচটা জেতার জন্য,’’ বলে দিলেন টটেনহ্যাম তারকা।

অধিনায়কের আগেই অবশ্য মুখোমুখি হয়েছিলেন ইংল্যান্ড কোচ। ব্রাজিল, ফ্রান্স, আর্জেন্টিনাকে এড়াতে তিনি গ্রুপ লিগের শেষ ম্যাচে ইচ্ছে করে বেলজিয়ামের কাছে হেরেছেন, এই অভিযোগে বিশ্ব জুড়ে সমালোচনা হচ্ছিল। ওই ম্যাচে প্রথম দলের সাত ফুটবলারকে খেলাননি তিনি। কলম্বিয়ার কাছে হারলে সাউথগেটের কোচিং জীবনে নেমে আসত অন্ধকার। ম্যাচটা জিতে দেখা গেল, ‘কেমন দিলাম’ গোছের মুখ নিয়ে এলেন কেনদের কোচ। বলে দিলেন, ‘‘পেনাল্টির জন্য যাদের তালিকা তৈরি করে রেখেছিলাম, সেটা পরে বদলাই। তাদের একজনই শেষ কিকটা মেরে ম্যাচ জেতাল।’’

এমনিতে লোকটা বেশ হাসিখুশি। কিন্তু তিনি হর্হে সাম্পাওলি নন। নিজেই সব সিদ্ধান্ত নেন। তিনি দলের ব্যান্ডমাস্টার। এখন যা পরিস্থিতি তাতে সুইডেনের পরে সম্ভাব্য প্রতিপক্ষ হিসেবে ক্রোয়েশিয়া বা রাশিয়ার বাধা টপকাতে পারলেই ফাইনালে চলে যাবে ইংল্যান্ড। তার আগে তাদের ব্রাজিল বা ফ্রান্সের মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ নেই। ট্রফি জেতার এ রকম সোনার সুযোগ শেষ কবে পেয়েছে ইংল্যান্ড? এ জন্য অবশ্যই কৃতিত্ব পাবেন সাউথগেট। ঝুঁকি নেওয়ার ফল পাচ্ছেন।।

রানি এলিজাবেথের হাত থেকে ববি মুরের কাপ নেওয়ার মতো ছবি যদি বাহান্ন বছর পর ফেরে রাশিয়ায়, কেনদের কাপ জেতার স্বপ্ন যদি সত্যি হয়, তা হলে সাউথগেটের ফর্মুলা কোচেদের আরও সাহসী করে তুলবে। সন্দেহ নেই।

Harry Kane England Football FIFA World Cup 2018 বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১৮
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy