Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
ফুঁসতে ফুঁসতে জার্মানদের ফেভারিট বাছলেন রবেন

কোচ মারাদোনার অপমানের জবাব দিতে তৈরি টিম মেসি

রাইট অফ প্যাসেজ হল তিন তলার এত বড় ঘরের চিলেকোঠা টাইপের এক চিলতে জায়গা। সেখানে একটা টেপ চলছে এ দিন দুপুরেও। রোজ যেমন চলে। মারাকানা ফাইনালে ব্রাজিলের চৌষট্টি বছর আগে হেরে যাওয়ার সেই চিরজখমি ফিল্ম ক্লিপিং। কিন্তু বৃহস্পতিবারের পরিস্থিতিটা দেখা গেল একেবারে আলাদা। মুজো দো ফুবল— ব্রাজিলের সরকারি ফুটবল-জাদুঘরে যে দর্শনার্থী হয়ে ঢুকে পড়েছে এক দল আর্জেন্তিনীয়। তারা জাদুঘরে এসে কর্মীদের জিজ্ঞেস করছে, রাইট অফ প্যাসেজ এতটুকু ছোট জায়গায় কী করে হবে? তা হলে বেলোর ১-৭-টা আসবে কোথায়? এদের ব্যঙ্গের সামনে দাঁড়িয়ে জাদুঘর কর্মীরা উত্তেজিত না হয়েই বোঝানোর চেষ্টা করলেন, ওটাও আসবে। তবে পরের বছর।

টিমকে ফাইনালে তুলে রোমেরো। ছবি: উৎপল সরকার।

টিমকে ফাইনালে তুলে রোমেরো। ছবি: উৎপল সরকার।

গৌতম ভট্টাচার্য
সাও পাওলো শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৪ ০৩:০৯
Share: Save:

রাইট অফ প্যাসেজ হল তিন তলার এত বড় ঘরের চিলেকোঠা টাইপের এক চিলতে জায়গা। সেখানে একটা টেপ চলছে এ দিন দুপুরেও। রোজ যেমন চলে। মারাকানা ফাইনালে ব্রাজিলের চৌষট্টি বছর আগে হেরে যাওয়ার সেই চিরজখমি ফিল্ম ক্লিপিং।

কিন্তু বৃহস্পতিবারের পরিস্থিতিটা দেখা গেল একেবারে আলাদা। মুজো দো ফুবল— ব্রাজিলের সরকারি ফুটবল-জাদুঘরে যে দর্শনার্থী হয়ে ঢুকে পড়েছে এক দল আর্জেন্তিনীয়। তারা জাদুঘরে এসে কর্মীদের জিজ্ঞেস করছে, রাইট অফ প্যাসেজ এতটুকু ছোট জায়গায় কী করে হবে? তা হলে বেলোর ১-৭-টা আসবে কোথায়? এদের ব্যঙ্গের সামনে দাঁড়িয়ে জাদুঘর কর্মীরা উত্তেজিত না হয়েই বোঝানোর চেষ্টা করলেন, ওটাও আসবে। তবে পরের বছর।

সামনে একটু এগিয়ে ফ্রেমে বাঁধানো পেলের সত্তর সালের বিশ্বকাপ খেলা দশ নম্বর জার্সি। আর্জেন্তিনীয়রা এ বার হাসাহাসি শুরু করে দিল, দিয়েগোর জার্সি কোথায়? মহিলা তখনও ঠান্ডা মাথায় বোঝানোর চেষ্টা করছেন, এটা হল ব্রাজিলের সরকারি ফুটবল-জাদুঘর। আমরা ব্রাজিলীয় ফুটবলারদেরই এখানে গুরুত্ব দিয়ে থাকি। যদিও মারাদোনার স্মরণীয় সব গোলের টেপ সব সময় চলে। পাশের ঘরটায় এলেই দেখতে পাবেন। কিন্তু এরা অনড়, আরে সের্জিও রোমেরোর গ্লাভস জোড়া চেয়ে রাখুন। ফাইনাল জিতে ও নাহয় এখানে পাঠিয়ে দেবে।

বিশ্বকাপ ফাইনালে দল পৌঁছে যাওয়ার পর যেন আরও অদম্য হয়ে উঠেছে ব্রাজিলে আসা মেসির দেশের সমর্থকেরা। মনে হচ্ছে আগামী ক’দিন এদের জন্য রিও আর্জেন্তিনীয় কলোনির চেহারা নেবে। ব্রাজিলীয় জাদুঘরে যে ভিড়টা পেলাম তারা কেউ কেউ এক সময় নিউ ইয়র্কে কাটানোর জন্য ইংরেজি বলতে পারেন। রোববারের ফাইনাল নিয়ে নিরন্তর আলোচনাও করে যাচ্ছেন। কিন্তু মানসিক ভাবে এরা এমন গ্রহে যে বোঝানোর চেষ্টা করাটাই বোকামি, বাকি পৃথিবী কাপ ফেভারিট হিসেবে জার্মানদেরই বাছছে!

আর্জেন রবেন যেমন। ব্রাজিল বিশ্বকাপের সবচেয়ে ধারাবাহিক পারফর্মার। কাল শেষ মুহূর্তেও মাসচেরানোর স্লাইডিং ট্যাকলটা না হলে গোল করে দিচ্ছিলেন। ম্যাচটা অতিরিক্ত সময়ে যেতই না। টাইব্রেকার তো দূরের কথা। তা রবেন মনে করেন, ফাইনালে মেসিদের কোনও আশাই নেই। অবিসংবাদী জার্মানি। স্নাইডারেরও খুব অসহ্য লেগেছে কালকের আর্জেন্তিনীয় ট্যাকটিক্স। পেনাল্টি মিস করে আরও বেশি খাপ্পা তিনি অভিযোগ করেছেন, জেতার চেষ্টা না করে আর্জেন্তিনা ম্যাচটা টাইব্রেকারে নিয়ে যেতে বেশি উদ্যোগী ছিল। এই মনোভাব নিয়ে জার্মানদের সঙ্গে আর কত দূর যাবে?

রিওর পানশালায় ‘ভামোস ভামোস’। ছবি: এএফপি।

নিরপক্ষ পর্যবেক্ষকদের অবশ্য মনে হচ্ছে, ফাইনাল যেতে না পারার চূড়ান্ত হতাশাতেই ডাচ তারকারা এ সব বলছেন। কাল ম্যাচে অনেক বেশি আক্রমণ তো মেসির আর্জেন্তিনাই করেছে। তা মেসি যতই নিষ্ক্রিয় থাকুন আর তাঁকে ছিয়াশি নয়, ক্রমাগত নব্বই বিশ্বকাপের মারাদোনা দেখাতে থাকুক। গোটা ম্যাচে ফ্রিকিক গোলকিপারের হাতে মারা আর অতিরিক্ত সময়ের আগে উদ্দীপ্ত টিম টক দেওয়া ছাড়া মেসি একটাই কাজ করেছেন। খেলার শেষ দিকে রাইট উইং থেকে অনবদ্য সেন্টার ভাসিয়েছিলেন। যেটা পনেরো গজের ভলিতে ঠিকঠাক রাখতে পারলেই গোল। ম্যাক্সি রদ্রিগেজ সেটারই টাইমিং গণ্ডগোল করে ফেলেন। এই রদ্রিগেজের পেনাল্টিটাই চূড়ান্ত ৪-২ তফাত করে দেয়। ভলিটা লাগাতে পারলে তাঁকে পেনাল্টি কিকের যন্ত্রণা নিতেই হত না। আর এক বার সহজ হেড করলে গোল— ছয় গজ থেকে আর্জেন্তিনা নষ্ট করে।

টাইব্রেকারের জন্য মেসিরা যে খেলছিলেন না, তার পরিষ্কার নমুনা রয়েছে। বরং যেটা পরিষ্কার হচ্ছে না, কাল ডাচদের হয়ে প্রথম পেনাল্টি মারতে কোন দু’জন অস্বীকার করেছিলেন? তাঁদের নাম কি রবেন আর স্নাইডার? সাংবাদিক সম্মেলনে এসে এই গররাজি হওয়ার খবরটা ফাঁস করলেন স্বয়ং কোচ লুই ফান গল। কাল রাত্তিরে এরিনা সাও পাওলোয় ফান গলের সাংবাদিক সম্মেলনে থেকে অবাকই লাগছিল।

কত বড় বড় কোচ বিশ্বকাপে এসে হেরে চলে গিয়েছেন। ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের নতুন কোচের মতো এত তিতকুটে মেজাজ কারও দেখিনি। ওল্ড ট্রাফোর্ডে ঢুকে পড়ার পর ব্রিটিশ মিডিয়ার সঙ্গে তাঁর কী রকম যাবে, জানি না। তবে এ দিন যা নমুনা পাওয়া গেল সেটা যদি প্রোমো হয়, তা হলে নিয়মিত স্টোরি হবে! নাম না করে টিমের দু’জন তারকা সম্পর্কে এমন সাংঘাতিক অভিযোগ হানলেন। তার পর বললেন, তৃতীয় স্থানের জন্য খেলাটা একেবারে বোকা বোকা। কোনও মানেই হয় না। ওটা জোর করে আমাদের খেলানো হচ্ছে। বাধ্য হয়ে যাচ্ছি। এর পর আবার বলেন, সের্জিও রোমেরোকে আমিই শিখিয়েছি কী করে পেনাল্টি আটকাতে হয়। আজ সেই গুরুমারা বিদ্যেটাই দেখাল! দ্রুত প্রশ্ন হল, তা হলে কি আর্জেন্তিনার জয়ের পিছনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী কোচের শেখানো টেকনিক কাজ করেছে?

এ বার প্রচণ্ড চটে গেলেন ফান গল। “অত্যন্ত নোংরা মানসিকতা নিয়ে এই প্রশ্নটা করা হল। আমি তীব্র আপত্তি জানাচ্ছি।” সাংবাদিকরা দেখেটেখে হা।ঁ বায়ার্ন মিউনিখে তাঁর প্রাক্তন সহকারী মেহরুট স্কোল তো সরাসরি অভিযোগ এনে বলেছেন, ফান গলের ভুল স্ট্র্যাটেজিই নেদারল্যান্ডসকে ফাইনালে উঠতে দিল না। বাকি ফুটবল-বিশ্ব অনেকটাই একমত যে মেসিকে আটকানোয় সফল হয়েও তিনি ট্যাকটিক্স তৈরিতে স্বভাববিরুদ্ধ এমন কিছু ভুল করেছেন যে, কমলা জার্সির দাপটটাই ম্যাচে ছিল না। সবচেয়ে আশ্চর্যের, ম্যাচ টাইব্রেকারে যাচ্ছে দেখেও তিন নম্বর বদলিটা করে ফেললেন কেন? টিম ক্রুল তো আগের ম্যাচটাই তাঁকে টাইব্রেকারে জিতিয়েছিলেন!

সাও পাওলোর ফুটবল মিউজিয়ামে পেলের যে জার্সি নিয়ে আর্জেন্তিনীয়দের বিদ্রুপ। ছবি: রয়টার্স।

জ্যাসপার সিলেসেন গোলকিপার হিসেবে যত ভালই হন না কেন, টাইব্রেকারের শরীরী ভাষাটা তাঁর নেই! টাইব্রেকারে গোলকিপারকে দস্যি হতে হবে। লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে এমন একটা বাতাবরণ তৈরি করতে হবে যে, কিকার কিক নিতে গিয়ে ভাববে, কোথা দিয়ে মারব। সব দিকই তো আটকানো। দুর্দান্ত রিফ্লেক্স নিশ্চয়ই চাই যেটা দেখিয়ে রোমেরো টিমকে ফাইনাল তুললেন। প্রথম শটটা বাঁ দিকে আর স্নাইডারের বেলা ডান দিকে ঝাঁপিয়েছিলেন। কিন্তু রোমেরোরও দাপুটে শরীরী ভাষা আছে। আর্জেন্তিনীয় পেনাল্টিগুলো চারটেই দারুণ মারা। তবু কোচ তাঁর পেনাল্টি রক্ষার সেরা স্ট্রোক বেঞ্চে রাখবেন কেন?

বেঞ্চ লিখতে গিয়ে মনে পড়ে গেল, কাল অ্যাঞ্জেল দি’মারিয়াকে রিজার্ভ বেঞ্চে দেখা গেল। শুনলাম আজ বেসক্যাম্পে হালকা ট্রেনিংও তিনি করেছেন। মানে কী? ফাইনালে নামবেন নাকি? না জার্মানদের ওপর চাপ রাখছেন মেসিরা? বোঝা যাচ্ছে না। তবু এটুকু বেশ বোধগম্য যে আর্জেন্তিনা একক মেসি থেকে এখন দলে রূপান্তরিত। ডিফেন্সে দারুণ খেলছেন পাবলো জাবালেতা। কাল মুখ ফেটে রক্ত ঝরার পরেও মুখে ব্যান্ডেজ বেঁধে চালিয়ে গেলেন। জাভিয়ের মাসচেরানো আর এক জন। আর্জেন্তিনীয় আকাশে তারা বরাবরই ছিলেন। এ বার বিশ্বকাপেও ডালপালা মেলছেন।

ফাইনালের অঙ্ক। সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

ব্রিটিশ মিডিয়া এ দিন মেসির টিমকে উজ্জীবিত করাকেই প্রচারে অগ্রাধিকার দিয়েছে। কিন্তু টাইব্রেকারের আগে রোমেরোকে টগবগে করে দেওয়াটা মাসচেরানোই করেন। রোমেরো গত বছর মোনাকোতে ছ’টা ম্যাচও পেয়েছেন কি না সন্দেহ। ব্রাজিল বিশ্বকাপও তাঁকে এমন কিছু আত্মবিশ্বাস দেয়নি। তিনি চাপে থাকতে পারেন বুঝে মাসচেরানো দৌড়ে যান। মাথায় মাথা ঠেকিয়ে বলে আসেন, যা বলে দিলাম তুই আগামী কয়েক মিনিটে পৃথিবীজোড়া নাম করে ফেলবি পেনাল্টি বাঁচিয়ে।

মারাকানা থেকে ৩৭৬৮ মাইল দূরবর্তী। রিও-র মতোই অসামান্য রূপসী এক শহরে ঠিক চার বছর দশ দিন আগে লাঞ্ছনাটা এসেছিল। টমাস মুলারের গোল থেকে শুরু হয়েছিল। কেপটাউনে সে দিনের ব্যবধান গিয়ে দাঁড়ায় ৪-০। কিন্তু রোববার মনে হচ্ছে জার্মানরা কাগজে-কলমে ফেভারিট হয়েও মাঠে অনেক বেশি সংঘাতের মুখোমুখি হবে।

ওটা ছিল মেসি নামক প্রিয়তম শিষ্যনির্ভর কোচ মারাদোনার আর্জেন্তিনা!

এটা ক্যাপ্টেন মেসির আর্জেন্তিনা! টিম আর্জেন্তিনা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

fifaworldcup gautambhattacharya roben teammessi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE