Advertisement
০৯ মে ২০২৪
Mamata Banerjee

ওজনদার প্রার্থী, হেভিওয়েট ‘সেনাপতি’? সভাপতির খাসতালুকেই বিজেপি-কে চেপে ধরার ভাবনায় তৃণমূল

কিন্তু খড়্গপুর সদরকে ঘিরে হঠাৎ এত তৎপরতা কেন?

উপনির্বাচনে জোরদার লড়াই হতে পারে খড়্গপুরে, সে ভাবেই ঘুঁটি সাজাচ্ছে তৃণমূল। —ফাইল চিত্র।

উপনির্বাচনে জোরদার লড়াই হতে পারে খড়্গপুরে, সে ভাবেই ঘুঁটি সাজাচ্ছে তৃণমূল। —ফাইল চিত্র।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৯ ২০:২০
Share: Save:

বিনা যুদ্ধে তিল পরিমাণ জমিও যে তিনি প্রতিপক্ষকে ছাড়েন না, সে কথা বাংলার রাজনীতিতে কারও অজানা নয়। তাই লোকসভা নির্বাচনের ফল যত বড় ধাক্কাই দিয়ে থাকুক, হাল ছাড়ার যে প্রশ্নই নেই, তা প্রতি পদক্ষেপে বুঝিয়ে দিচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পুর নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে রাজ্য জুড়ে তৃণমূল ঘর গোছানো শুরু করে দিয়েছে আগেই। কিন্তু তার আগেই হবে তিন বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন। আর সে নির্বাচনে বিজেপির ‘ঘরের মাঠে’ বিজেপি-কে পর্যুদস্ত করার পরিকল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে বলে খবর মিলছে তৃণমূল সূত্রে।

২৫ নভেম্বর উপনির্বাচন পশ্চিমবঙ্গের তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রে— পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার খড়্গপুর সদর, নদিয়ার করিমপুর এবং উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জ। মেদিনীপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে জিতে সংসদে যাওয়ায় খড়্গপুরের বিধায়ক পদ ছেড়েছিলেন রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ। কৃষ্ণনগর লোকসভায় জিতে সংসদে যাওয়ায় করিমপুরের বিধায়ক পদ ছেড়েছিলেন তৃণমূলের মহুয়া মৈত্র। আর কালিয়াগঞ্জ আসন শূন্য হয়েছিল কংগ্রেস বিধায়ক পি এন রায়ের প্রয়াণে। তাই উপনির্বাচন হচ্ছে এই তিন আসনে।

বিজেপির হাতে যে আসনটি ছিল এবং পর পর দু’টি নির্বাচনে (২০১৬-র বিধানসভা, ২০১৯-এর লোকসভা) যে বিধানসভায় বড় ব্যবধানে তৃণমূলকে পিছনে ফেলেছে বিজেপি— সেই খড়্গপুর সদর আসনেই তৃণমূল সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপাতে পারে। এখনও কোনও আসনের জন্যই রাজ্যের শাসক দল প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেনি। কিন্তু খড়্গপুর সদরে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে প্রার্থী করার কথা ভাবা হচ্ছে বলে তৃণমূল সূত্রের খবর। আর সেই প্রার্থীর হয়ে ময়দানে নেমে আসনটি পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে রাজ্যের এক দাপুটে মন্ত্রীকে।

খড়্গপুর সদরে তৃণমূল প্রার্থী করতে পারে দীনেশ ত্রিবেদীকে।—ফাইল চিত্র।

আরও পড়ুন: মুখ্যমন্ত্রী এত ছোট ঘরে থাকেন কী করে? মমতার কালীপুজোয় গিয়ে পার্থকে প্রশ্ন রাজ্যপালের​

খড়্গপুর সদরে তৃণমূল প্রার্থী করতে পারে ভারতের প্রাক্তন রেলমন্ত্রী তথা ব্যারাকপুরের প্রাক্তন সাংসদ দীনেশ ত্রিবেদীকে। তৃণমূল সূত্রে এমনই জানা যাচ্ছে। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে দাপুটে সিপিএম সাংসদ তড়িৎবণ তোপদারকে ব্যারাকপুরে ধরাশায়ী করে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন দীনেশ। পরে দেশের রেলমন্ত্রীও হন। ২০১৪ সালে আবার জেতেন ব্যারাকপুর থেকে। কিন্তু ২০১৯ সালে ভোটে নিজের প্রাক্তন সতীর্থ অর্জুন সিংহের কাছে হেরে যান দীনেশ। তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়া অর্জুন ১৪ হাজারের কিছু বেশি ভোটে হারিয়ে দেন দীনেশকে।

এ বার হেরে গিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু দু’বার রাজ্যসভা এবং দু’বার লোকসভা মিলিয়ে চার বারের সাংসদ তিনি। দেশের রেলমন্ত্রী ছিলেন। এই মুহূর্তে মুখ্যমন্ত্রীর পছন্দের তালিকাতেও রয়েছেন। সুতরাং প্রার্থী হিসেবে যথেষ্ট ওজনদার নাম দীনেশ ত্রিবেদী।

তা ছাড়া খড়্গপুর সদর আসনে অবাঙালি ভোটের পরিমাণও বিপুল। ২০১৪ সালে বিজেপির টিকিটে দিলীপ ঘোষ জেতার আগে পর্যন্ত প্রায় সব নির্বাচনেই খড়্গপুর থেকে অবাঙালি প্রার্থীরাই জিততেন। সে সিপিআইয়ের নারায়ণ চৌবেই হন বা কংগ্রেসের জ্ঞান সিংহ সোহনপাল। সে সব কথা মাথায় রেখেই দীনেশ ত্রিবেদীর কথা ভাবা হচ্ছে বলে তৃণমূল সূত্রে জানা যাচ্ছে।

রাজ্য সভাপতির খাসতালুকে এ বার কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হতে পারে বিজেপি-কে।—ফাইল চিত্র।

শুভেন্দু অধিকারীকে খড়্গপুরে ভোটযুদ্ধের ‘সেনাপতি’ করা হচ্ছে বলেও শোনা যাচ্ছে। রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী খাতায়-কলমে পূর্ব মেদিনীপুরের নেতা এবং খড়্গপুর পশ্চিম মেদিনীপুরে ঠিকই, কিন্তু নিজের জেলার পাশাপাশি পশ্চিমেও শুভেন্দুর প্রভাব যথেষ্টই। শুভেন্দুর ‘নির্বাচন মেশিনারি’রও বেশ ‘সুখ্যাতি’ রয়েছে দলে। রাজ্য বিজেপির সভাপতির খাসতালুকে ভোট করানোর দায়িত্ব যদি সেই শুভেন্দু অধিকারীকে সঁপে দেন তৃণমূল নেতৃত্ব, তা হলে অন্তর্নিহিত বার্তাটা বুঝতে অসুবিধা হয় না।

কিন্তু খড়্গপুর সদরকে ঘিরে হঠাৎ এত তৎপরতা কেন? উপনির্বাচনের ময়দানে হেভিওয়েট প্রার্থীকে নামানো, ভোট সামলানোর দায়িত্ব আরও বড় হেভিওয়েটের হাতে দেওয়া— এর মাধ্যমে কোন লক্ষ্যে পৌঁছতে চাইছে তৃণমূল? এত কিছুর পরেও হেরে গেলে তো আরও বেশি মুখ পুড়বে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই কিন্তু তেমনটা মনে করছেন না। তাঁদের মতে, বিজেপি-কে যে এক বিন্দু মাটিও তৃণমূল ছাড়বে না, সেই বার্তা নিজের দলকে খুব স্পষ্ট ভাবে দিয়ে দিতে চাইছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। খড়্গপুর সদর আসনে তৃণমূল কখনও জেতেনি, সে কথা ঠিকই। কিন্তু তেমন একটা আসনকেও যে টার্গেট করে নিয়ে ঝাঁপানোর পরিস্থিতিতে দল রয়েছে, এই বার্তাটুকু দেওয়া গেলেই কর্মী-সমর্থকদের চাঙ্গা করে তোলা যায় বলে বিশ্লেষকদের মত।

আরও পড়ুন: দ্রুত সাড়া দিতে মহিলা সমিতির ‘ডেকো বাহিনী’​

তৃণমূলের জেলা নেতাদের অনেকেই বলছেন, এই লড়াইয়ে তৃণমূলের কোনও ক্ষতি নেই। যেটুকুই হোক, লাভই হবে বলে তাঁদের দাবি। কেন এমন দাবি তৃণমূল নেতাদের? তাঁদের ব্যাখ্যা— ধুন্ধুমার লড়াই দিয়ে যদি আসনটা জিতে নিতে পারে তৃণমূল, তা হলে লহমায় গোটা রাজ্যে বিজেপি কর্মীদের মনোবলে ধাক্কা দিয়ে দেওয়া যাবে। একে খোদ রাজ্য বিজেপি সভাপতির খাসতালুক, তায় মাত্র কয়েক মাস আগের ভোটেও এগিয়ে ছিল বিজেপি। সেখানে এ বার তৃণমূল জিতলে রাজ্য জুড়ে হইহই করে তৃণমূল বলতে পারবে যে, লোকসভা নির্বাচনের সময়ে ওঠা গেরুয়া হাওয়া এখন পুরোপুরি অতীত। আর যদি হারও হয়, তা হলেও অসুবিধা নেই। কারণ, হারা আসনে হেরে যাওয়ায় কোনও গ্লানি নেই। বরং লড়াই দেওয়ার চেষ্টাটাকে তুলে ধরা যাবে।

প্রার্থীর নাম এখনও ঘোষণা করেনি তৃণমূল। তিন আসনের প্রার্থীর নাম একসঙ্গেই ঘোষণা করা হবে। সে বিষয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে এক দফা আলোচনা সোমবার সন্ধ্যায় সেরেছেন বলে খবর। আর পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা তৃণমূল সভাপতি অজিত মাইতি আনন্দবাজারকে বলেছেন, ‘‘খড়্গপুর সদরে প্রার্থী কে হবেন, সেটা দলনেত্রীই স্থির করবেন। যাঁকে প্রার্থী করা হবে, আমরা তাঁর হয়েই ময়দানে নামব।’’ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ইঙ্গিত স্পষ্ট, খড়্গপুর সদরের প্রার্থী বাছাইয়ের বিষয়টি সরাসরি তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বই দেখছেন। প্রার্থীর নাম ঘোষিত হলেই বোঝা যাবে, এই উপনির্বাচন কতটা বাড়াতে চলেছে বিজেপির রক্তচাপ।

উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জে কাকে প্রার্থী করা হবে, তা নিয়েও সোমবার আলোচনা হয়েছে তৃণমূলে। জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত পর্যবেক্ষক শুভেন্দু অধিকারী এবং জেলা তৃণমূলের তিন গুরুত্বপূর্ণ নেতা অমল আচার্য, গোলাম রব্বানি ও কানাইয়ালাল আগরওয়ালকে নিয়ে এ দিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আলোচনায় বসেন। সে আলোচনায় দধি দেবশর্মা এবং উত্তর দিনাজপুর জেলা পরিষদের সভাধিপতি কবিতা বর্মণ-সহ মোট তিন জনের নাম উঠে আসে বলে তৃণমূল সূত্রের খবর। কিন্তু কোনও নামেই চূড়ান্ত সিলমোহর পড়েনি। জেলা নেতৃত্বকে আরও ভেবে সিদ্ধান্ত জানাতে বলা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE