Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ছুড়ে দেওয়া ত্রাণ ধরতে নদীর ধার ঘেঁষে মরিয়া দৌড়

ঘাট বেয়ে হেঁটে আসছেন সত্তর পঁচাত্তরের এক বৃদ্ধা। পরনে ব্লাউজ নেই। সাদা শাড়ি। পিঠে বোট থেকে ছুড়ে দেওয়া ত্রাণ। স্বচ্ছ্ব প্লাস্টিকের বস্তার ভাড়ে আরও ন্যূব্জ হয়েছে শরীর। ভিতরে প্যাকেট প্যাকেট স্যানিটরি ন্যাপকিন। সকলের ভিড়ে এ টুকুই ধরতে পেরেছেন দিদা। আমপান বিধ্বস্ত সুন্দরবন থেকে সরেজমিন প্রতিবেদন। আজ দ্বিতীয় পর্ব।ঘাটে গাড়ি রাখার অজস্র গ্যারাজ। প্রায় সবই ভর্তি। তারই এক কর্মী হাসতে হাসতে বলছিলেন, “এটা হল ত্রাণ পর্যটন”।

আঘাতের পর আঘাত আসে, তবু আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকে সুন্দরবন। এ ছবি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার দেউলবাড়ির। ছবি: এপি।

আঘাতের পর আঘাত আসে, তবু আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকে সুন্দরবন। এ ছবি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার দেউলবাড়ির। ছবি: এপি।

স্যমন্তক ঘোষ
হাসনাবাদ ও গদখালি শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০২০ ১৯:৪৯
Share: Save:

(১)

সারি সারি বোট। বাহারি গাড়ি। কুলির ভিড়। নানা কিসিমের পোশাক। রাজনৈতিক দল থেকে দাদাভাই সঙ্ঘের ব্যানার। ৪০ শতাংশ ফেস্টুনেই ‘অনুপ্রেরণা’ জ্বলজ্বল করছে। এ ছাড়াও গেরুয়া শিবিরের নানাবিধ সংগঠনের লোকজন স্টিমারের গায়ে ব্যানার বাঁধতে ব্যস্ত। গাদা গাদা বস্তা উঠছে স্টিমারে। গদখালির লঞ্চ ঘাট দেখলে মনে হবে যেন সুন্দরবন পর্যটনের মরশুম শুরু হয়ে গিয়েছে।

ঘাটে গাড়ি রাখার অজস্র গ্যারাজ। প্রায় সবই ভর্তি। তারই এক কর্মী হাসতে হাসতে বলছিলেন, “এটা হল ত্রাণ পর্যটন”।

পর্যটনই বটে। এত নৌকো যাচ্ছে কোথায়? ওই দিন বিকেলেই বিডিও অফিসের এক কর্মী বলছিলেন, গোসাবার ব্লকে মেরে কেটে চার থেকে পাঁচটি জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু সব চেয়ে বেশি ত্রাণ ঢুকছে এই ঘাট দিয়েই। এত ত্রাণের সত্যিই প্রয়োজন নেই।

সত্যিই নেই?

আগেই বলেছিলাম। পরিতোষ ফোন করেছিল ৩০ মে বিকেলে। ঝড়ের পর প্রথম। আলো ছিল না। তাই মোবাইলে চার্জ দেওয়া যাচ্ছিল না। টাওয়ারও ছিল না। ঝড়ের পর সব টাওয়ার বসে গিয়েছিল। রামগঙ্গা হয়ে বোটে সমুদ্রের প্রায় মুখে বড় রাক্ষসখালি যাওয়ার কথা বলছিল। প্রায় সাড়ে চারশো আদিবাসীর গ্রাম। ঝড়ের পর কার্যত কিচ্ছু নেই তাঁদের। আর বলেছিল ছোট মোল্লাখালির কথা। মরিচঝাঁপি জঙ্গলের উল্টো পাড়ে ছোট মোল্লাখালির একটা অংশে বাঁধ ভেঙে জল ঢুকেছে। প্রায় বাংলাদেশের গায়ে সেই অঞ্চলে বিশেষ কেউ ত্রাণ নিয়ে পৌঁছচ্ছে না। যদি যাওয়া যায়। বলা গিয়েছিল, বড় রাক্ষসখালিতে বন্ধুরা যাচ্ছেন। আর ছোট মোল্লাখালিতে আমরাই যাওয়ার পরিকল্পনা করেছি।

গোসাবায় বড় ক্ষতি হয়েছে ছোটমোল্লাখালি আর রাক্ষসখালির। এই ছবি রাঙাবেলিয়ার।

২ জুন, সকাল ১০টা—

গদখালি হয়েই ছোট মোল্লাখালি যেতে হয়। স্টিমারে প্রায় দুই-আড়াই ঘণ্টার পথ। স্টিমার ছাড়ার খানিক ক্ষণের মধ্যেই পুরনো দৃশ্য ফিরতে শুরু করল। আয়লার পর এ ভাবেই নদীর ধার ঘেঁষে মানুষকে ছুটতে দেখেছিলাম। এ বারও ঠিক সে ভাবেই ছুটছেন তাঁরা। তবে দৃশ্যত ক্ষয়ক্ষতি বিশেষ দেখা যাচ্ছে না। তা হলে এঁরা ছুটছেন কেন? হাহাকার করছেন কেন এ ভাবে? গোসাবারই বাসিন্দা সারেং ভাই অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে জানালেন, অভ্যাসে এমনটা করছেন ওঁরা। আয়লার পর বাঁধের কাছে থাকা লোকজন বুঝে গিয়েছেন, এ ভাবেই ত্রাণ ধরতে হয়। প্রয়োজন থাকুক, বা না থাকুক। লঞ্চ ধরে ছুটতে থাকা ওই মানুষগুলোর মধ্যে এই কাজে যে একরকম পারদর্শিতা আছে, তাও মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল। যাকে বলে প্রফেশনালিজম। তবে মন মানছিল না। এরই মধ্যে এক গামলা মুড়ি চানাচুর মেখে দিয়ে গেলেন রান্নার দিদি। দুপুরে তিনিই স্টিমারে খিচুরি বানিয়ে খাওয়াবেন। সারেংয়ের কথায় খানিক বিরক্তি প্রকাশ করলেন তিনি। তবে কিছু বললেন না।

আরও পড়ুন: জামাটা পাঁজরের ঘামে সেঁটে, মাথায় খাবারের বস্তা, যূথিকাকে ভুলতে পারছি না

ডাঁশা নদীর পাড়ে। ত্রাণের নৌকো বা লঞ্চের আশায়। শুলকুনি যাওয়ার পথে।

নদী ক্রমশ চওড়া হচ্ছে। বহু দূরে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের জাহাজ। একে একে ঢুকছে। সুন্দরবন হয়ে বজবজের রাস্তা ধরবে। ফ্লাই অ্যাশ তুলে ফিরে যাবে বাংলাদেশে। তা দিয়েই ইট তৈরি হবে। মাঝে করোনার কারণে যাতায়াত বন্ধ ছিল। ফের চলাচল শুরু হয়েছে। এ দিকে ঘাটে ঘাটে দাঁড়িয়ে একের পর এক লঞ্চ। নৌকো থেকেই বস্তা ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে ডাঙায়। ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষজন যা পাচ্ছেন, নিয়ে চলে যাচ্ছেন। চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা। সারেং বলছিলেন, এলাকার নেতারা সব দাঁড়িয়ে আছেন ওই সব জায়গায়। ঘাটে মাল নামলেই সবার প্রথম তাঁরা ধরছেন। জিনিস চলে যাচ্ছে পার্টির হেফাজতে। তাঁরাই ‘বিচার’ করে জিনিস বিতরণ করছেন। অবস্থা এমনই যে, রাঙাবেলিয়া থেকে বন দফতরের নৌকো ফিরে গিয়েছে। এলাকার নেতারা বলে দিয়েছেন, জিনিস কেবল তাঁদের হাতেই দেওয়া যাবে। যাঁরা ত্রাণ নিয়ে এসেছিলেন, তাঁরা রাজি না হওয়ায় নৌকো ফিরে গিয়েছে। এক অদ্ভুত রাজনীতি চলছে।

২ জুন, বেলা ১২টা—

জল খেতে স্টিমারের নীচের কেবিনে নামতেই রান্নার দিদি মুখ খুললেন। দীর্ঘ দিন ধরে ট্যুরিস্ট বোটে রান্নার কাজ করেন তিনি। লকডাউনে দু’মাস বাড়িতে। কোনও কাজ নেই। গ্রাম থেকে বেরতে দিচ্ছে না প্রশাসন। করোনার ভয় দেখাচ্ছে। ‘ত্রাণ পর্যটন’ শুরু হওয়ায় ফের দু’পয়সা রোজগারের সুযোগ হয়েছে। ব্যাঙ্কে যাবেন বলে স্টিমারে উঠে পড়েছেন। দিদির বক্তব্য, আমপানে ততটা ক্ষতি না হলেও, লকডাউনে বিপুল ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। কারও বাড়িতে খাবার নেই। ত্রাণ ধরার জন্য যাঁরা দৌড়চ্ছেন নদীর ধার ধরে, তাঁদের পেটেও ভাত নেই। তবে এও ঠিক যে, অধিকাংশ স্টিমার গদখালির কাছাকাছি এলাকায় জিনিস বিলিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে। দূরের গ্রামগুলোতে কিছুই পৌঁছচ্ছে না। গদখালির কাছের গ্রামগুলো এখন ত্রাণের মাল ধরে তা বিক্রিও করতে শুরু করেছে। হাতে দু'পয়সা আসছে। ফোনেই এ খবর দিয়েছিল পরিতোষ। বলেছিল, শহরের মানুষের কাছে এটা অন্যায় মনে হতে পারে। কিন্তু সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর কাছে ওই সামান্য টাকাও খুব কম কিছু নয়। ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন তো অনেক পরের।

যোগেশগঞ্জের মাধবকাঠি গ্রাম। আমপানের দিন তিনেক পরে।

২ জুন, বেলা ২টো—

চোখের সামনে ঐতিহাসিক মরিচঝাঁপি। গোটা দ্বীপটাই এখন জঙ্গল। নেট দিয়ে ঘেরা। উল্টো দিকে ছোট মোল্লাখালির দ্বীপে সাড়ে তিন কিলোমিটার বাঁধ ভেঙেছে। জোয়ারে জল ঢুকছে গ্রামে। ভাটায় সব কাদা। রাজনীতির খেলা এখানেও আছে। তবে সুবিধা হল, বিপক্ষের শক্তি নেই বিশেষ। ফলে ত্রাণের খেলায় সকলেই মোটামুটি সহমত। মিলমিশ ভালই। বাঁধ সারাইয়ে জেসিপি ঢুকেছে। তবে আগামী এক বছরের মধ্যে ফসল ফলার আর কোনও সম্ভাবনা নেই। পুকুরের মাছ প্রায় সব ভেসে গিয়েছে। গ্রামের মাস্টারমশাই বলছিলেন, আজ না হয় কাল লকডাউন পুরোপুরি উঠে যাবে। কিন্তু মানুষের হাতে কোনও কাজ থাকবে না। জমির দিকে তাকিয়ে বসে থাকা আর আর কতগুলো বৃষ্টিতে নোনা কাটল— সেই দিন গোনা ছাড়া কারও হাতেই আর কোনও কাজ নেই।

আরও পড়ুন: কাল ফের সর্বদল বৈঠক, নেতাদের ফোন মমতার

আরও এক সমস্যার কথা বলছিলেন মাস্টার। আয়লার পর বহু মানুষ সুন্দরবন ছেড়ে শ্রমিকের কাজ নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিলেন। তখনও এ ভাবেই জমিতে নোনা ধরেছিল। লকডাউনে তাঁদের অনেকেই ফিরে এসেছেন। অনেকে ফিরে আসার পরিকল্পনা করছেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, আর শ্রমিকের কাজ করবেন না। জল আর জমির ফসল তুলেই বাকি জীবনটা বাবা-কাকাদের মতো কাটিয়ে দেবেন। ফিরে আসা সেই ‘পরিযায়ী শ্রমিকরা’ও বড় সংকটে। তাঁদের শহরের কাজ গিয়েছে, গ্রামে নোনা খেয়েছে জমি।

নদীর পাড় থেকে ত্রাণ পেয়ে ভাঙা ডেরার দিকে। চকপাটলির গ্রামে।

বাঁধের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই কথা হচ্ছিল মাস্টারের সঙ্গে। এক জায়গায় পৌঁছে দেখা গেল, বাঁধ পুরোপুরি ধসে গিয়েছে। নদীর নোনা জল সেই পথ ধরে ঢুকে গিয়েছে গ্রামের ভিতর। অনেকটা দূরে আরও এক ত্রাণের নৌকো। সদ্য এই অঞ্চল থেকে নোঙর তুলেছে। ভাঙা বাঁধের উপর গাদা গাদা জামা কাপড়। গ্রামের লোক ও সব জিনিস নেননি। কে বলতে পারে, কলকাতার করোনা ওই সব জামা বেয়েই তাঁদের ঘরে পৌঁছে যাবে কি না!

২ জুন, বেলা ৩টে—

স্টিমারে ওঠার সময় হয়েছে। ঘাট বেয়ে হেঁটে আসছেন সত্তর পঁচাত্তরের এক বৃদ্ধা। পরনে ব্লাউজ নেই। সাদা শাড়ি। পিঠে বোট থেকে ছুড়ে দেওয়া ত্রাণ। স্বচ্ছ্ব প্লাস্টিকের বস্তার ভাড়ে আরও ন্যূব্জ হয়েছে শরীর। ভিতরে প্যাকেট প্যাকেট স্যানিটরি ন্যাপকিন। সকলের ভিড়ে এ টুকুই ধরতে পেরেছেন দিদা।

(২)

“একটু জল দেবেন, জল...”

যত দূর চোখ যায়, দিগন্ত বিস্তৃত জল। নদী আর গ্রামের সীমারেখা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সম্পূর্ণ ভেঙে যাওয়া বাঁধ। তারই ওপর কোনও মতে ত্রিপল টাঙিয়ে শ’য়ে শয়ে মানুষ কোনও মতে ভেঙেচুরে বেঁচে আছেন। ফাটল নয়, জায়গায় জায়গায় বাঁধের কিছুই অবশিষ্ট নেই। নৌকো দাঁড় করিয়ে বাঁধ মেরামতির কাজ করছেন স্থানীয় মানুষ। রিং বাঁধ তৈরি হচ্ছে। মনে পড়ছিল দিল্লি-কলকাতা বিমানের সেই সহযাত্রীর কথা। বলেছিলেন, হিঙ্গলগঞ্জে থাকেন। বাড়ি ভেসে গিয়েছে। গ্রামে পৌঁছেই বাঁধ মেরামতির কাজে হাত দেবেন। হয়ত দূরের ওই শ্রমিকদের মধ্যেই কোথাও মিশে আছেন তিনি।

হাসনাবাদ ব্লকে ভবানীপুর ১ নম্বর অঞ্চল আমপানের ১৮ দিন পরে। ডাঁশা ধরে শুলকুনি যাওয়ার পথে।

হাসনাবাদ থেকে মাত্র ৪০ মিনিট দূরে শুলকুনি, খোলসেখালির এই মানুষগুলোও স্টিমার দেখে বাঁধ বরাবর দৌড়চ্ছেন। এ দৌড়, দু'দিন আগে দেখে আসা সুন্দরবনের দৃশ্য নয়। মরিয়া দৌড়। জল বেয়ে ভাটিয়ালি আর্তনাদ দূর থেকে দূরে ভেসে ভেসে যাচ্ছে— “জল দেবেন, একটু জল...”

৬ জুন, সকাল ১০টা—

হাসনাবাদ লঞ্চ ঘাটে দাঁড়িয়েও মনে হয়নি সামান্য দূরে এমন দৃশ্য অপেক্ষা করছে। আমপান না হলে হয়ত এই গ্রামগুলোয় নোনা জল উঠত না। বাঁধ ভাঙত না। কিন্তু তাতেও কি খুব ভাল থাকতেন মূলত জনজাতি অধ্যুষিত এই অঞ্চলের মানুষরা? ভেড়িপাড়ায় উচ্ছিষ্টের মতো জেগে থাকা গ্রামে যেটুকু ঢোকা গিয়েছিল, তাতে সভ্যতার নাম গন্ধ নেই। মাটির রাস্তায় ইট বসে বছরে একবার। এমন ভাবেই বসে, যাতে তা তুলে নিয়ে বেচে দেওয়া যায়। গ্রামের স্কুলের চেহারা বর্ণনা না করাই ভাল। এখন অবশ্য স্কুলটুলের পাঠ চুকেছে। নানা কিসিমের সংস্থা নৌকো নিয়ে এসে টোকেন দিয়ে যায়। স্থানীয় মানুষের ভাষায় ‘টুকন’। ওই টুকনের ভরসাতেই বেঁচে আছেন মানুষগুলো। না, ত্রাণ নিয়ে হাতাহাতি নেই এই অঞ্চলে। যিনি পাচ্ছেন, তিনি যুদ্ধ জয় করছেন। যিনি পাচ্ছেন না, পরাজিত সৈনিকের মতো মাথা ঝুঁকিয়ে ফিরে যাচ্ছেন গাছতলায়। পাশাপাশি বসে ত্রাণ ভাগাভাগি হচ্ছে, এমন বিরল দৃশ্যেরও সাক্ষী হয়েছি সভ্যতা বিবর্জিত ওই পাড়াগাঁয়ে।

শুধু একটাই দাবি— “আর কিচ্ছু চাই না। এক প্যাকেট বিস্কুট আর সামান্য জল দিতে পারেন?”

শুলকুনি গ্রাম। জুনের প্রথম সপ্তাহে।

৬ জুন, সকাল ১০টা ৪০—

নোনা জলে পুকুর ডুবে গিয়েছে। নলকূপ বিশবাঁও জলের তলায়। কোমর জলে হাঁটছেন যে মানুষগুলো, তাঁদের খাওয়ার জল নেই। কয়েক দিন আগে মিনাখার মোহনপুরেও এই ছবি তৈরি হতে দেখেছি। সেখানেও বাঁধ ভেঙে জল ঢুকেছে গ্রামে। স্থানীয় মানুষের অভিযোগ, ভেড়ির মালিকরা বাঁধের ভিতর পাইপ ঢুকিয়ে ভেড়িতে নোনা জল টানেন। তাতেই বাঁধ দুর্বল হয়। ঝড়ের আঘাতে ভেঙে গুড়িয়ে গিয়েছে সেই বাঁধ। গ্রামের ভিতর জোয়ার-ভাটার দৃশ্য দেখেছি। যখন ঢুকেছিলাম, রাস্তায় তখন এক পাতা জল। ফেরার সময় জল বেড়ে পেটের কাছে চলে এসেছে। প্রতিটি বাড়ির ছাদে খাওয়ার জলের কলসি। পানীয় জলের সংকট সবেমাত্র শুরু হয়েছে সেখানে।

শুলকুনির গ্রামগুলো মোহনপুরের চেয়ে কয়েকশো গুণ গরিব। মাটির বাড়ি সব ধসে গিয়েছে। গলে গিয়েছে। পানীয় জল ধরে রাখার ব্যবস্থাটুকু পর্যন্ত নেই। অভিযোগ, প্রশাসন এ সব দেখেও দেখে না। স্থানীয় কিছু ক্লাব, নাটকের দল প্রায় প্রতিদিন জল নিয়ে যাচ্ছে নৌকো করে, তাই বেঁচে আছেন মানুষগুলো।

প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে দক্ষিণ বঙ্গের আমপান বিধ্বস্ত বিস্তীর্ণ এলাকা ঘুরেছি। হাসনাবাদ থেকে মাত্র ৪০ মিনিট দূরে যে দৃশ্য দেখেছি, তা আর কোথাও দেখা যায়নি। স্থানীয় এক নাটকের দলের কর্মীরা বলছিলেন, আমপানের এত দিন পরেও প্রশাসনের এ নিয়ে কোনও উদ্বেগ নেই।

মিনাখাঁর মোহনপুর, কোকিলপুরের মতো গ্রামগুলো আমপানের দিন কুড়ি পরও এমন ছিল।

আরও পড়ুন: গালওয়ানে হামলার নির্দেশ দিয়েছিল চিন, বলছে মার্কিন গোয়েন্দা রিপোর্ট

৮ জুন, বেলা ১২টা—

উদ্বেগ তখনই হয়, যখন খবর থাকে। এক বন্ধুর ফেসবুক পোস্ট পড়ে উত্তর ২৪ পরগনার তৃণমূলের এক নেতা ফোন করে জানতে চেয়েছিলেন, কোথায় ঘটেছে এমন ঘটনা? নেতার হাত ধরে এক মন্ত্রীও একই প্রশ্ন করেন। লজ্জার মাথা খেয়ে তাঁদের বলা হয়েছিল, সরকার এবং প্রশাসন খবর চাপতে চায়, এ সত্য জানা আছে। কিন্তু সত্য ঢাকতে ঢাকতে তারা যে নিজেরাই উটপাখি হয়ে গিয়েছে, সে সত্য জানা ছিল না। বালিতে মুখ গুঁজে বসে থেকে ঘরের পাশের খবরটুকুও আর পাওয়া যায় না। এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কী-ই বা হতে পারে।

এ লেখা লিখতে লিখতেই ফোন এসেছিল শুলকুনি থেকে। আর এক সপ্তাহ জল দিতে পারলে এ যাত্রায় বোধ হয় বেঁচে যাবেন মানুষগুলো। ধরতাই দিয়ে গ্রামের মানুষ ফের বাঁধ খাড়া করেছেন। গ্রাম থেকেও জল নামছে। সাংঘাতিক বৃষ্টি না হলে এক-দেড় সপ্তাহে টিউবওয়েলগুলো অন্তত জেগে উঠবে।

খাওয়ার জলটুকু পাওয়া যাবে, এইটুকু আশা নিয়েই বেঁচে আছেন নোনা জমির চাষারা।

(ছবি:ইন্দ্রনাথ মারিক, শ্যামল গায়েন, বিশ্বজিৎ হাজরা, অরিজিৎ চক্রবর্তী)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cyclone Amphan Sundarbans
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE