Advertisement
E-Paper

সিনেমার জন্য ডাক্তারি ছেড়েছিলেন এই পরিচালক

ওঁর সিনেমা জীবনের বয়স ৫০ বছর! কত জন যে তাঁর ছবিতে প্রথম বার সুযোগ পেয়ে নাম কুড়িয়েছেন! অসম্ভব মিতভাষী, আদ্যন্ত অনাড়ম্বর চিত্র পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের বহু অকথিত গল্পে পুত্র অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ওঁর সিনেমা জীবনের বয়স ৫০ বছর! কত জন যে তাঁর ছবিতে প্রথম বার সুযোগ পেয়ে নাম কুড়িয়েছেন! অসম্ভব মিতভাষী, আদ্যন্ত অনাড়ম্বর চিত্র পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের বহু অকথিত গল্পে পুত্র অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০১৭ ১৩:০০
অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়।

অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়।

বাবার চিৎকারে চমকেই উঠেছিলেন বোধহয় রবীন্দ্রনাথ!

ইস্কুলজীবন শেষে বাবাকে তখন দাদা বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, মানে বনফুল পাঠিয়ে দিয়েছেন শান্তিনিকেতনে গুরুদেবের আশ্রমে। সেই প্রথম রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বাবার আলাপ। তার আগে কে যেন দুষ্টুমি করে বাবাকে বলে দিয়েছিল, গুরুদেব কিন্তু কানে একটু খাটো। ফলে শুরুতেই রবীন্দ্রনাথ যেই নাম জি়জ্ঞেস করেছেন, যতটা সম্ভব গলা চড়িয়ে বাবা বলে উঠেছিল, ‘‘অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়।’’

কবি হতচকিত। তাতেও রবিঠাকুরের সরস মন্তব্যটি কিন্তু শোনার মতো। তিনি জানতেন, তাঁর নতুন আশ্রমিক ছাত্রটি বলাইচাঁদের ভাই। তার অমন তীব্র স্বর শুনে বলেছিলেন, ‘‘তুমি বলাইয়ের ভাই, তোমার নাম সানাই হল না কেন?’’

শান্তিনিকেতনে বাবার সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন সত্যজিৎ রায়ও। ওঁকে নিয়ে বাবা একটা হাতে লেখা পত্রিকা বের করত। নাম ছিল, ‘একেবারে যা-তা’। প্রচ্ছদের ভার সত্যজিৎ রায়ের। প্রকাশকের জায়গায় লেখা থাকত, ‘তুমি’। সম্পাদকের জায়গায় ‘আমি’।

শান্তিনিকেতনে বাবা থিয়েটারও করেছে। পরিচালক রামকিঙ্কর বেইজ। বাবা নায়ক। নায়িকা সুচিত্রা মিত্র। শুনেছি, মহলার সময় রামকিঙ্কর নাকি খুব বকাবকি করতেন। একদিন সেই বকুনি শুনে সুচিত্রা মিত্র কেঁদেই ফেলেন।

বাবার শৈশব থেকে বড় হওয়া বিহারে। মণিহারী গ্রাম। জন্ম ওখানেই। গাছগাছালিতে ছাওয়া গাঁ-ঘর। পিরবাবার পাহাড়। বাহি নদীর ধারে আমবাগান।

ঠাকুরদা ছিলেন ডাক্তার। তিনি আবার রোগীর রোগ না সারলে ফিজ্ নিতেন না। ঘোর আদর্শবাদী।

‘অগ্নীশ্বর’-এর শ্যুটিঙের সময় উত্তমকুমারের মুখোমুখি, মাঝে সুব্রতা

আমার ন’জেঠু গৌরমোহনও ছিলেন ডাক্তার। আর ঠাকুর্দার আদর্শবোধ ছিল তাঁর মধ্যেও। বাড়ির কারও কিছু হল কী, ন’জেঠু ছায়া হয়ে দেখা দিতেন। আবার অন্য দিকে আমোদ-আহ্লাদেও ষোলো আনা। মণিহারী গ্রামে তখনকার দিনের বিখ্যাত সব ফুটবলার, সামাদ-উমাপতি কুমারদের নিয়ে জমাটি ফুটবল টুর্নামেন্ট তিনিই চালাতেন।

শান্তিনিকেতনের পর বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ। চার বছর পড়ে ইস্তফা। কেন? অধ্যাপক ডা. রামগতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের অ্যানাটমির ক্লাসে মড়া কাটতে গিয়ে ভিরমি খাওয়ার দশা। দু’রাত ঘুমোতে পারেনি। এই সময়ই রিলিজ করে ছবি ‘উদয়ের পথে’। ১৯৪৪ সাল। ছবি দেখে বাবা এতটাই মুগ্ধ, ঠিক করল, ‘‘ডাক্তারি যায়, যাক। আমি ফিল্ম লাইনে যাব।’’ তখন বাঁকুড়ার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অন্নদাশঙ্কর রায়। তিনি আমাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ। বাবার মন বুঝে তিনি আর দাদা বনফুল মত দিলেন, ‘‘তবে তা-ই যা।’’

অতঃপর বীরেন সরকারের নিউ থিয়েটার্স। বিমল রায়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট। সেখানে আবার বাবার সহকর্মী হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়। পরে যিনি বিখ্যাত পরিচালক হবেন।

বিমল রায় ছিলেন মস্ত কড়া। একদিন কাজে কী যেন ভুল হয়েছিল বলে দুই অনুজ সহকর্মী, অরবিন্দ আর হৃষীকেশকে গাছতলায় নিলডাউন করে রেখে দিয়েছিলেন।

(বাঁ দিক থেকে) প্রযোজক মামাজি, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত, শোভা সেন

নিউ থিয়েটার্সে হাত পাকাতে পাকাতে বাবার প্রথম ছবি ১৯৫৯-এ। ‘কিছুক্ষণ’। অনেকেই জানেন না, এই ছবিতেই প্রথমবারের মতো পরদায় আসেন রবি ঘোষ। উৎপল দত্তের নাটকের দল তখন ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’। সেখানকারই একটি নাটকে তরুণ অভিনেতা রবি ঘোষের অভিনয় দেখে বাবা উৎপল কাকুকে বলে, ‘‘আমার ছবিতে এ ছেলেকে আমার চাই-ই।’’

‘কিছুক্ষণ’-এর পর ‘আহ্বান’। রানাঘাটে আউটডোর। শ্যুটিং চলাকালীন হঠাৎ আবির্ভাব এক সুন্দরী কিশোরীর। সে আসে, যায়। ভাব জমায়। একদিন সন্ধ্যা রায়ের কাছে সে আবদার করে বসে, তাকে কলকাতায় নিয়ে যেতেই হবে। সবাই শুনে তো তাজ্জব! মেয়ে কিছুতেই ছাড়বে না। অগত্যা বাবাকে নিয়ে তখন সন্ধ্যাপিসি যায় তার বাড়ি। অভিভাবকদের কাছে অনুমতি চাইতে। অনুমতি মঞ্জুর হলে কিশোরীকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। সন্ধ্যাপিসি তাকে বাড়িতে তোলে। ইস্কুলে ভরতি করে দেয়। সে দিনের সেই কন্যাটি কে জানেন? আজকের রাখী গুলজার।

১৯৬১ সাল। ডা. বিধানচন্দ্র রায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তাঁকে ‘আহ্বান’ দেখাতে স্পেশাল স্ক্রিনিং। ছবির কাহিনি সাম্প্রতিক সম্প্রীতিকে ঘিরে। শো দেখে বিধান রায় এত খুশি হয়েছিলেন যে, ‘আহ্বান’-এর সঙ্গীত পরিচালক পঙ্কজকুমার মল্লিককে ডেকে বলেন, ‘‘বলাইয়ের ভাই একটা ভাল সিনেমা করেছে। ওটা বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করো। সম্মান পাবে।’’

প্রশংসা পেতে কার না ভাল লাগে! বাবারও লেগেছিল, কিন্তু নিজের কাজে বাড়তি সম্মান আদায়ের জন্য বাবাকে কোনও দিন কিছু করতে দেখিনি! এত সরল, অনাড়ম্বর জীবন যে কোনও চিত্র পরিচালকের থাকতে পারে, সে কালেও তা ছিল কষ্টকল্পিত।

খাবারদাবারেও বাবা ছিল অসম্ভব পরিমিত। ‘বর্ণচোরা’ ছবির সময়কার একটা ঘটনা মনে পড়ছে। সেটে লাঞ্চ ব্রেক। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, অনিল চট্টোপাধ্যায় ও অন্যদের সঙ্গে বাবা। বাবা খেতও যেমন কম, পিটপিটেও ছিল তেমনই। আর আমার জেঠুরা হল, যাকে বলে খাইয়েদাইয়ে। সে দিন বাবার খাবারের পরিমাণ দেখে অবাক হয়ে ভানুজেঠু বলেছিলেন, ‘‘ঢুলু, (বাবার ডাকনাম) তুই এত কম খাস ক্যান, তোগো বড়দা তো ভোজনবিলাসী, আর তুই! এর লিগাই তুই এত প্যাংলা!’’

একটু পেটরোগাও ছিল বাবা। একবার আউটডোরে গিয়ে যা-তা অবস্থা। প্রোডাকশন ম্যানেজার বাবার জন্য কোত্থেকে মাগুর মাছ জোগাড় করে আনল। এ দিকে ওই কাঁটাওয়ালা জ্যান্ত মাগুর কাটবে কে! ছবির নায়িকা সন্ধ্যাপিসি। পিসিই সাততাড়াতাড়ি বঁটি নিয়ে বসে গেল মাগুর কাটতে।

বাবা বরাবরই রোগা-পাতলা। মনেও নরমসরম। তাই মাকে অনেক সামাল দিতে হত। মা নামে যেমন প্রতিমা, স্বভাবেও তাই। তার ওপর দারুণ গানও জানত।

এক সময় আমাদের অবস্থা কতটা খারাপ ছিল, বলার নয়। খাট আলমারি ছাড়া আসবাব বলতে তিনটে বেতের চেয়ার। তাও ছারপোকায় ঠাসা! নতুন যে কিনবে বাবা, সে সঙ্গতি কই! কোনও প্রোডিউসার আসবে শুনলে মায়ের প্রথম কাজ ছিল, গরম জল ঢেলে ছারপোকা তাড়ানো। অমন সময়েই ‘নিশিপদ্ম’। ছবির স্ক্রিপ্ট শুনতে বাড়ি এসেছিলেন উত্তমকুমার। আর শুনেই এক কথায় রাজি।

আরেকটি গল্প বলি। ‘অগ্নীশ্বর’। সে অবশ্য ‘নিশিপদ্ম’র বছর পাঁচেক পরে। ডাক্তারের ভূমিকায় উত্তমকাকু। সঙ্গে মাধবী মুখোপাধ্যায়, সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়। গল্প বড় জেঠুর। মানে, বনফুলের।

নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়োয় একটা শো-এর ব্যবস্থা করা হল। বড়জেঠু দেখবেন। তিনি দেখবেন বলে উত্তমকাকুও হাজির। শো শুরু হল। সারাক্ষণ সিঁটিয়ে বসে উত্তমকাকু। শেষে ভয়ে ভয়ে এসে দাঁড়ালেন বনফুলের সামনে। বাবা পাশেই দাঁড়িয়ে। কাকু ইতঃস্তত করছেন দেখে বাবা বলল, ‘‘উত্তম কেমন করেছে বলবে তো!’’ চওড়া হাসি মুখে নিয়ে কাকুর কাঁধে হাত রেখে কাহিনিকার বললেন, ‘‘অপূর্ব! অগ্নীশ্বর-এর ব্যক্তিত্বকে তুমি সুন্দর ফুটিয়েছ।’’

‘নিশিপদ্ম’র হিন্দি ভার্সান ‘অমরপ্রেম’। চিত্রনাট্য বাবার। ছবি তৈরির পর রাজেশ খন্না যখন কলকাতায় আসেন, দেখা হয় বাবার সঙ্গে। রাজেশ বলেন, ‘‘দাদা, ‘নিশিপদ্ম’ অনেক বার দেখেছি। ‘অমরপ্রেম’-এ আমার চরিত্রটাও দারুণ করেছেন।’’

’৭০-’৭১ সাল। ‘ধন্যি মেয়ে’ হবে। নতুন নায়িকার খোঁজ চলছে। বড় জেঠুর বিশেষ প্রিয়, সাহিত্যিক তরুণ ভাদুড়ী। তাঁর সুপারিশ নিয়ে তাঁরই মেয়ে জয়া এলেন বাবার কাছে। সেই জয়া ভাদুড়ীকে ছবির নায়িকা করল বাবা।

ছবির আউটডোর। জগৎবল্লভপুর গ্রাম। প্রযোজক নারায়ণবাবুর প্রাসাদোপম বাড়ি ওই গ্রামেই। সেখানেই থাকা। দোতলার সামনের দিকে বাবার ঘর। পিছন দিকের ঘরে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় আর জয়া ভাদুড়ী।

রাত্তিরে বাবার ঘরে মশারি টাঙাতে গিয়ে প্রোডাকশন বয় দেখে, দড়ি নেই। সে তো থতমত খেয়ে সোজা সাবুপিসির কাছে চলে গেল, ‘‘ঢুলুবাবুর মশারি টাঙাতে পারছি না। দড়ি নেই।’’

সাবুপিসি গেল বাবার ঘরে। হাতে চুল বাঁধার ফিতে-দড়ি। সঙ্গে জয়া ভাদুড়ী। দু’জনে মিলে মশারি টাঙিয়ে, গুঁজেটুজে দিয়ে তবে শান্তি। কী সব সম্পর্ক ছিল তখন!

শুধু সিনেমার নেশা নয়, বাবার সাহিত্যপ্রেমও ছিল অঢেল। বহু জনপ্রিয় পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিল বাবা। ‘শ্রীগুপ্ত’ ছদ্মনামে একটি বাণিজ্যিক পত্রিকায় সিনেমা সংক্রান্ত লেখালেখি করেছে। ছড়াও লিখত। বাবার ছোট গল্পের সংকলনও আছে। ‘সোনার মেডেল’।

বাবা খুব ভাল গান বুঝত। মণিজেঠু, ডা. লালমোহন মুখোপাধ্যায় খুবই ভাল গান গাইতেন। বাবার জীবনে গানের অনুপ্রেরণা মণিজেঠুই। ছবির সিকোয়েন্স বুঝে গান তৈরি করত বাবা। ‘নিশিপদ্ম’র ‘রাজার পঙ্খী উইড়্যা গেলে’ গানটা বাবারই লেখা। এমনকী ‘না না না, আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে যাব না’ গানের জন্য আলাদা করে বিশেষ সিচ্যুয়েশন তৈরি করে বাবা।

বাবার আরেকটা ব্যাপার ছিল, পাঁড় মোহনবাগানী। ১৯৭৫ সাল। মুম্বই গিয়েছে বাবা। ‘অজস্র ধন্যবাদ’ ছবির গান টেক হবে। সুরকার শ্যামল মিত্র। আর গায়ক-গায়িকার দলে মহম্মদ রফি, আশা ভোঁসলে, শৈলেন্দ্র সিং। রফি চলে এসেছেন দেখেও বাবা চুপ করে কোণের দিকে বসে। দেখেশুনে রফিসাব খুব অবাক হয়ে বলেই ফেললেন, ‘‘ডিরেকটার সাব কো কুছ হুয়া ক্যয়া, ইতনা নারাজ!’’ শ্যামলকাকু মৃদু হেসে বললেন, ‘‘কিছু না, কাল বড় ম্যাচ ছিল। ঢুলুদার মোহনবাগানকে পাঁচ গোলে হারিয়েছে ইস্টবেঙ্গল, তাই!’’

মিঠুন চক্রবর্তীর কথা বলি। ওঁর প্রথম বাংলা ছবি বাবারই, ‘নদী থেকে সাগরে’। তখন থেকেই বাবার সঙ্গে ওঁর সম্পর্কটা একটু অন্য রকম। প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করতেন বাবাকে।

কাটিহার থেকে কলকাতা

• ১৯১৯ সালের ১৮ জুন বিহারের কাটিহার জেলার মণিহারী গ্রামে তাঁর জন্ম। চিকিৎসক বাবা সত্যচরণ মুখোপাধ্যায় ও মা মৃণালিনীদেবীর কনিষ্ঠ সন্তান তিনি। ওঁরা ছিলেন ছয় ভাই, দুই বোন। ভাইবোনেদের মধ্যে সবচেয়ে বড় কথাসাহিত্যিক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়। যাঁর ছদ্মনাম বনফুল।

• মণিহারী ও ভাগলপুরে কাটে তাঁর ছাত্রজীবনের প্রাথমিক পর্ব। ১৯৩৯ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা পাশ করার পর তাঁর পড়াশোনার দ্বিতীয় পর্বের শুরু শান্তিনিকেতনে। সেখানে তিনি কবিগুরু ছাড়াও যাঁদের সংস্পর্শে আসেন, তাঁরা হলেন ক্ষিতিমোহন সেন, শৈলজানন্দ মজুমদার, রামকিঙ্কর বেইজ, বলরাজ সাহানি, নন্দলাল বসু, সত্যজি‌ৎ রায় ও আরও অনেকে।

• পড়াশোনায় তাঁর তৃতীয় পর্বের শুরু ১৯৪২ সালে। ওই বছরেই তিনি ভর্তি হন বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে।

• নিউ থিয়েটার্স-এ সহকারী পরিচালক এবং পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় দিয়ে আরম্ভ হয় তাঁর চলচ্চিত্র জীবন।

• মোট ২৬টি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি, ৩টি টেলিফিল্ম ও ১টি ধারাবাহিক পরিচালনা করেন তিনি।

• তাঁর পরিচালনায় প্রথম ছবি ‘কিছুক্ষণ’। ছবিটি ১৯৫৯ সালে তৈরি। কাহিনি ওঁর দাদা বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, অর্থাৎ বনফুলের। ছবিটি রাষ্ট্রপতি পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়। এই ছবিতেই রবি ঘোষের চলচ্চিত্রে প্রথম আত্মপ্রকাশ।

• ১৯৬১ সালে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে তাঁর তৈরি ‘আহ্বান’ ছবিটি ফ্রান্সে কান চলচ্চিত্র উৎসবে আমন্ত্রণ পায়।

• ওঁর ‘শীলা’ নামের ছবিতে অভিনেতা শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় প্রথম নায়কের ভূমিকায় সুযোগ পান।

• তাঁর ‘নিশিপদ্ম’ ছবির কাহিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ছবির হিন্দি ভার্সানটি ‘অমরপ্রেম’। পরিচালনা করেন শক্তি সামন্ত। এই ছবির বাংলা ভার্সানটিতে অভিনয় করেন উত্তমকুমার। হিন্দিতে রাজেশ খন্না। চিত্রনাট্যর প্রয়োজনে উত্তম বা রাজেশের চরিত্রটি তৈরি করেন অরবিন্দ নিজে। মূল গল্পে এই চরিত্র ছিল না। ‘নিশিপদ্ম’ ছবিতে গান গেয়ে মান্না দে ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় জাতীয় পুরস্কার পান।

• তাঁর ‘ধন্যি মেয়ে’-তে নায়িকার চরিত্রে প্রথম অভিনয়ে আসেন জয়া ভাদুড়ী।

• ওঁর ‘নদী থেকে সাগরে’ সিনেমায় মিঠুন চক্রবর্তী প্রথম বাংলা ছবিতে নায়ক হন। দেবশ্রী রায় হন প্রথম নায়িকা।

• ‘হুলস্থুল’ ছবিতে প্রথম বার পরদায় অভিনয়ের সুযোগ পান খরাজ মুখোপাধ্যায়।

• পরিচালক নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়, অজিত গঙ্গোপাধ্যায়, সুজিত গুহ-সহ অনেকেই তাঁর অধীনে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন।

• ‘নায়িকার ভূমিকায়’, ‘পিতাপুত্র’, ‘অজস্র ধন্যবাদ’, ‘নতুন জীবন’, ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘মৌচাক’, ‘বর্ণচোরা’, ‘মন্ত্রমুগ্ধ’, ‘হুলস্থুল’, ‘কেনারাম বেচারাম’ প্রভৃতি চলচ্চিত্রে অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের বিশেষ রসবোধের পরিচয় পাওয়া যায়।

• ২৬ মাঘ, ১৪২২ (১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬)-এ তিনি চিরবিদায় নেন।

তথ্য: পরিবারের সৌজন্যে

একবার পুজোর ঠিক পরের কথা। টালিগঞ্জের নানুবাবুর বাজার। তার সামনের রাস্তা দিয়ে মিঠুন চলেছেন গাড়িতে। বাবা বাজারের থলে হাতে মোড়ের মাথায়। হঠাৎই বাবাকে দেখে গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে মিঠুন বললেন, ‘‘বিজয়ার প্রণামটা এ ভাবেই করতে হল। তাড়া না থাকলে বাড়ি যেতাম।’’ মুহূর্তের মধ্যে লোকে লোকারণ্য। সবাই হতচকিত হয়ে চেয়ে। তাদের পাড়ারই মানুষটার পায়ে হাত দিয়ে মাথায় হাত ঠেকাচ্ছেন যে ভদ্রলোক, তিনি তখন ভারতবিখ্যাত!

রাজকপূর কলকাতায় এসেছেন। ঠিক করেছেন নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়ো যাবেন। স্টুডিয়োর কর্ণধার তখন বিএন সরকার। উনি বাবাকে বললেন, ‘‘ঢুলুবাবু, রাজকে কিন্তু আপনি রিসিভ করবেন।’’

রাজকপূর আসার আগেই স্টুডিয়োতে অপেক্ষায় বাবা। রাজকপূর এলেন। নমস্কার, প্রতি নমস্কার হল। তার পর সবাইকে চমকে দিয়ে গেটের কাছে পায়ের জুতো জোড়া খুলে হাঁটু গেড়ে বসে মাটি থেকে ধুলো নিয়ে মাথায় নিলেন রাজকপূর। উঠে দাঁড়িয়ে বাবাকে বললেন, ‘‘নিউ থিয়েটার্স হল কপূর পরিবারের তীর্থস্থান। আমার বাবা এখানকার নুন খেয়েছেন। এখানে চাকরি করেছেন। জায়গাটায় এলেই আমার কেমন যেন লাগে!’’ শুনে অভিভূত বাবা। কতবার যে এ গল্প করত!

এত সিনেমা-ভক্ত আমাদের বাবা, অথচ ভাই সর্বজিৎ, বোন অমা বা আমি কেউই সিনেমায় আসি, একদম চাইত না। স্থায়ী চাকরি হোক, ব্যস। বলত, এ লাইন বড় অনিশ্চিত। কষ্টের। পরে বুঝেছি, কী বলতে চাইত বাবা। নর্দার্ন অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে যখন আমরা, তখন প্রায় চালচুলো নেই। নিজের বাড়ি তো দূরের কথা, বাবার তখন গাড়ি পর্যন্ত ছিল না।

সেই সময়কার ঘটনা। ‘মৌচাক’ হবে। প্রযোজক জং বাহাদুর রানা। গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউতে ওঁর অফিস। ছবির গল্প সমরেশ বসুর। বাবা নির্দেশক। তিন জন মিলে প্রযোজকের ঘরে মিটিং। দুপুর তিনটে নাগাদ। বাবার দেখা নেই। বেশ দেরি হল সে দিন বাবার যেতে। ঘরে ঢুকতেই জং বাহাদুর বললেন, ‘‘গাড়ির সমস্যা হল নাকি?’’

কোথায় গাড়ি? শুনে প্রযোজক তো হাঁ! বললেন, ‘‘বলেন কী! গাড়ি নেই আপনার! তা, বাড়ি করেছেন?’’

‘‘না। এখনও করে উঠতে পারিনি।’’ শুনে অদ্ভুত একটা পরামর্শ দিলেন উনি, ‘‘একটা কথা বলি, এই ছবিটায় আপনি বড় ভাইয়ের রোলটা উত্তমবাবুকে রাজি করান। আর ছবিতে নিজের শেয়ার রাখুন। গাড়ি কেনা হয়ে যাবে।’’

মায়ের নামে প্রোডাকশন হাউস করল বাবা। ‘প্রতিমা পিকচার্স’। ভারতী সিনেমা। প্রথম শো। শুরু হল ছবি। দর্শক টানটান হয়ে দেখছে। হাফটাইম-এর একটু পরে মিঠু মুখোপাধ্যায় পরদায়। গান শুরু, ‘‘বেশ করেছি, প্রেম করেছি করবই তো।’’ হল ফেটে পড়ল। বাইরে এসে জং বাহাদুর বাবাকে বললেন, ‘‘জমি দেখুন। গাড়ি কেন, বাড়িও হয়ে যাবে আপনার।’’

‘মৌচাক’-এর লাভের টাকাতেই আমাদের বাড়ি হল। একটু যেন স্বাচ্ছন্দ্য এল তখন। কিন্তু ওই যে, বাবা তো! কোনও দিন আড়ম্বরকে প্রাধান্য না দেওয়া এক মানুষ। তিনি তো আর অর্থে গা ভাসাতে পারে না। কত কষ্ট যে করেছে বাবা-মা আমাদের মানুষ করতে! কথাটা কেবলই ভাবি আজকাল। কত ত্যাগ! কত সহ্যশক্তি! কত সম্বরণ!

শেষ চার বছর একদম বিছানাতেই কেটেছে বাবার। ২০১২ থেকে ২০১৬। স্মৃতি প্রখর, একমাত্র বার্ধক্যই যা ক্ষয় ধরিয়েছিল শরীরে। সে সময় বাবার সারাক্ষণের সঙ্গী বলতে ছিল রেডিয়ো। খুব এফএম শুনত। আর কিছুতেই কাছছাড়া করতে চাইত না নাতনি অনিকাকে। প্রত্যেক সন্ধেবেলা নাতনির গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা চাই-ই চাই। আর ভালবাসত চা খেতে। এক কাপ চায়ে তিন চামচ চিনি বাঁধা।

শেষ দিকে খুব কষ্ট পাচ্ছিল। ফেব্রুয়ারির ১০। সকালে চা-টা খেল কোনওক্রমে। তার কিছু পরে সব শেষ। ঘড়িতে তখন ৮টা ৪৫। শতবর্ষ থেকে ঠিক তিন বছর দূরে পরমেশ্বরের ‘আহ্বান’-এ সাড়া দিয়ে আমাদের অনাথ করে চলে গেল আমাদের পরমারাধ্য পিতা!

অনুলিখন: দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়

Arvind Mukherjee Filmmaker Doctor Films Bengali Films
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy