Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
Mr. Bean

তিন দশক পেরোলেন মিস্টার বিন

ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র। নাটকের মঞ্চে ফরাসি ভাষায় সংলাপ বলতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকেই মাথায় আসে হাস্যরস পরিবেশনের ভাবনা। ১৯৯০ সালে প্রথম সম্প্রচার। রসিক দর্শক পেয়ে গেল চার্লি চ্যাপলিন, লরেল-হার্ডির সফল উত্তরসূরি। শুধু দর্শকের ভালবাসাই নয়, বহু স্বীকৃতিও এসেছে বিভিন্ন সময়ে। মিস্টার বিন সিরিজ়ের জন্য অজস্র পুরস্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘গোল্ডেন রোজ়’ আর ‘বেস্ট কমেডি’।

সৌম্যকান্তি দত্ত
শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০২০ ০০:০৭
Share: Save:

মাথায় বেশ লম্বা। পাঁচ ফুট সাড়ে এগারো ইঞ্চি। ভদ্রলোকের আসল নাম রোয়ান সেবাস্টিয়ান অ্যাটকিনসন। কিন্তু আমরা চিনি ‘মিস্টার বিন’ নামে। যাঁরা নব্বইয়ের দশকে বেড়ে উঠেছেন এবং হাসির খোরাক খুঁজেছেন— তারা পনেরো এপিসোডের মিস্টার বিন সিরিজ় দেখেননি, এ যেন অসম্ভব! সেই বিনসাহেবের মুক্তির তিরিশ বছর কেমন নিঃশব্দে কেটে গেল এ বছরের ঠিক প্রথম দিনটায়। যখন সবাই হাসতে ভুলে যাচ্ছে, লাফটার শো’গুলো গণহারে কাতুকুতু দিয়ে হাসাচ্ছে, তখন মিস্টার বিনের মতো সহজ, সরল চরিত্রটি যেন হয়ে উঠছে চার্লি চ্যাপলিন, লরেল-হার্ডি, বাস্টার কিটনদের সফল উত্তরসূরি। ‘মানুষ মনে করে আমি পর্দায় সবাইকে হাসাই, কিন্তু এই দুঃখের জীবনে প্রত্যেককে আলাদা করে হাসাতে পারি আমি...’ এমন উক্তি তাঁর মুখে মানানসই।

মিস্টার বিনের জন্ম ইংল্যান্ডে। ১৯৫৫ সালের ৬ জানুয়ারি। ডারহ্যাম্স কোরিস্টার স্কুলে মিস্টার বিনের সহপাঠী ছিলেন প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টোনি ব্লেয়ার। ছোটবেলার মিস্টার বিন খুব লাজুক এবং চুপচাপ। টোনি ব্লেয়ার ছিলেন একেবারে উল্টো।

১৯৯০-এর ১ জানুয়ারি ব্রিটিশ চ্যানেল আইটিভি-তে মিস্টার বিনের প্রথম এপিসোড সম্প্রচারিত হয়। ব্রিটিশ অভিনেতা রোয়ান অ্যাটকিনসন তখন অক্সফোর্ডের ‘দ্য কুইন্স’ কলেজের মাস্টার ডিগ্রিতে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র। বিজ্ঞানে বরাবর প্রথম দিকেই থেকে এসেছেন। নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটি থেকে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি নেওয়ার পরই ভর্তি হয়েছিলেন কুইন্স কলেজে। কানাডার ‘জাস্ট ফর লাফ্স’ ফেস্টিভ্যালে একটি নাটকে ফরাসি ডায়লগ বলতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যান। অধিকাংশ দর্শক ঘাবড়ে গেলেও, হাসিতে ফেটে পড়েন কেউ কেউ। এখান থেকেই তিনি চিন্তাভাবনা শুরু করেন কী করে শুধু শারীরিক অঙ্গভঙ্গি ও ভাবের মাধ্যমে লোককে মজা দেওয়া যায়। উনি ছিলেন ফরাসি পরিচালক জাক তাতি’র ‘মঁসিয়ে উলো’ এবং পিটার সেলার্সের ‘ফামলিং ফুল’ চরিত্র দু’টির গভীর অনুরাগী। এ ছাড়া নির্বাক যুগের শরীরী কৌতুক ওঁকে মুগ্ধ করে। আর সেখান থেকেই এই চরিত্রের জন্ম। ‘মিস্টার বিন’ নামটি কিন্তু শুরুতে ভাবা হয়নি, প্রথমে ভাবা হয়েছিল ‘মিস্টার কলিফ্লাওয়ার’। কিন্তু অ্যাটকিনসন সাহেব চাইছিলেন সহজ ছোট্ট নাম। কাজেই সাতপাঁচ ভেবে নামকরণ হয় ‘মিস্টার বিন’।

নামের মতোই সহজ এবং সাধারণ এই সিরিজ়ের কৌতুক উপাদান। তেরোতম এপিসোড ‘গুডনাইট মিস্টার বিন’-এর শুরুতে বিন তাঁর কটকটে সবুজ রঙের ‘লে ল্যান্ড মিনি ওয়ান থাউজ়্যান্ড মার্ক টু’ গাড়িতে করে ডাক্তারের চেম্বারে পৌঁছন। অদ্ভুত রোগ, বিনের বাঁ হাতে একটি কেটলির মাথা আটকে গেছে, কিছুতেই খোলা যাচ্ছে না। কাজেই ডাক্তারের শরণাপন্ন। চেম্বারে পৌঁছে নিজের নাম লেখানোর লাইনে দাঁড়ানোর ধৈর্য তাঁর নেই। বিভিন্ন কৌশলে লাইনে আগেভাগে কী ভাবে পৌঁছনো যায়, তারই চেষ্টা! আর তাঁর কলাকৌশল যত ব্যর্থ হচ্ছে, তৈরি হচ্ছে হাসির অব্যর্থ মশলা। আবার ধরুন, এই সিরিজ়ের শেষ এপিসোড, ‘দ্য বেস্ট বিট্স অব মিস্টার বিন’-এ রাত্তিরবেলা বিন তাঁর প্রিয়তম টেডি-কে আদর করে ঘুম পাড়িয়ে ঘড়িতে অ্যালার্ম দিলেন সকাল আটটার। ন’টায় দাঁতের ডাক্তারের কাছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট। যথাসময়ে অ্যালার্ম বাজতে শুরু করল, কিন্তু ঘুম আর ভাঙে না। অগত্যা, ঘড়িটিকে ডান হাত দিয়ে পাশে রাখা জলভর্তি গ্লাসে নির্দ্বিধায় ডুবিয়ে দিলেন। ব্যস, ঘড়ির হাঁকডাক বন্ধ। এমন ইচ্ছে এক বার না এক বার কার হয়নি বলুন! হাস্যরসের সঙ্গে মিস্টার বিনের গল্পে কোথাও মিশে গিয়েছে দর্শকদের ছোটখাটো ইচ্ছেপূরণও।

সিরিজ়ে বিনের অসহায় প্রেমিকা ইরমা গব-এর চরিত্রে মাটিল্ডা জ়িগলার-এর উপস্থিতি সিরিজ়টিকে আরও জমিয়ে দেয়। মিস্টার বিন তাকে বন্ধু বলেই ভাবে, কিন্তু সে অন্য কারও হাত ধরে নাচলেই তার মনে উঁকি দেয় ঈর্ষা। ‘মেরি ক্রিসমাস মিস্টার বিন’ কে ভুলতে পারে! ক্রিসমাসের সেই রাতে ইরমা অপেক্ষা করেছিল কখন বিন তাকে প্রোপোজ় করবে। কিন্তু প্রোপোজ় করা হল কি? উঁহু... এক বার দেখে নেবেন। মিস্টার বিন পুরনো হয় না। বরং এক-একটা বয়সে হাস্যরসের নতুন নতুন দর্শন তুলে ধরে। হালকা হাসির সঙ্গে কোথাও মিশে যায় মৃদু মনখারাপ। মিস্টার বিন থেকে যাবেন, কারণ রোজকার ছোটবড় অসঙ্গতি থেকে উঠে আসা এমন নির্মল হাস্যরস ক্রমশই বিরল হয়ে উঠেছে।

‘দ্য ট্রাব্‌ল উইথ মিস্টার বিন’ থেকে মিস্টার বিনের সঙ্গী তার বিখ্যাত টেডি। গোল মাথা, পুঁতি চোখ, সসেজের মতো হাত পা। একে কিন্তু মোটেই পুতুল বলে মনে করেন না মিস্টার বিন। এর জন্য ক্রিসমাস গিফ্ট নিয়ে আসেন, এঁকে হিপনোটাইজ় করেন। হিপনোটাইজ়ড অবস্থা কেটে গেলে সে আবার উঠেও বসে। মজা পাবেন নিঃসন্দেহে, কিন্তু মনের অবচেতনে গুনগুনিয়ে উঠবেই সেই সত্য— মানুষ আসলে এত একা যে, তাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য টেডিকেও জীবন্ত হয়ে উঠতে হয়। এই হলেন মিস্টার বিন। তাঁর হাস্যরস বহুস্তরীয়, দার্শনিক।

তার পর আসবে মিস্টার বিনের বিখ্যাত গাড়ির কথা। নাম ‘দ্য মিনি’। আগেই বলা হয়েছে গাড়িটার নাম। রংটাও কটকটে সবুজ। একেবারে জটায়ুসুলভ। মাদ্রাজি ফিল্মমার্কা। তবে আরও আছে। গাড়ির ছাদে আর্মচেয়ার ফিট করে স্টিয়ারিংয়ে দড়ি বেঁধে ড্রাইভ করার দৃশ্য চিরকাল মনে থাকবে দর্শকের। ব্যক্তিগত জীবনে রোয়ান অ্যাটকিনসন গাড়ি বিষয়ে খুবই শৌখিন। রেসিং মডেলের ‘ফোর্ড ফ্যালকন’ তাঁর প্রিয় গাড়ি। এ ছাড়াও তাঁর সংগ্রহে আছে বেশ কিছু দুর্মূল্য স্পোর্টস এবং ভিন্টেজ গাড়িও। পর্দায় নিজেকে বার বার ভেঙেছেন শুধু দর্শককে আনন্দ দেওয়ার জন্যই।

শুধু দর্শকের ভালবাসাই নয়, বহু স্বীকৃতিও এসেছে বিভিন্ন সময়ে। মিস্টার বিন সিরিজ়ের জন্য অজস্র পুরস্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘গোল্ডেন রোজ়’ আর ‘বেস্ট কমেডি’। ২৯ মিনিট পর্বের সিরিজ়েই আটকে থাকেননি মিস্টার বিন। জনপ্রিয়তার দাবি মেনেই দু’টি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের সিনেমাও হয়েছে, সেগুলো হল ‘বিন’ এবং ‘মিস্টার বিন্‌স হলিডে’। এ ছাড়া ২০১২-তে ‘সামার অলিম্পিকস ওপেনিং সেরেমনি’-তে অ্যাটকিনসন মিস্টার বিনের একটি লাইভ পারফরম্যান্স করেন। ২০০২ সালে ৫২ এপিসোডে মিস্টার বিনের অ্যানিমেশন সিরিজ়ও হয়েছিল। সেখানে দেখা যায় মিস উইকেট নামে এক জন দজ্জাল মহিলা ও তাঁর বেড়ালকে। ২০১৫ সালে মিস্টার বিনের পঁচিশ বছরে হয়েছে ‘মিস্টার বিন ড্রাইভস এগেন’।

২০১২-তে ‘দ্য ডেলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় মিস্টার বিনের ভূমিকায় আর অভিনয় করবেন কি না, এই প্রসঙ্গে অ্যাটকিনসন বলেছিলেন, ‘পঞ্চাশ পেরোলেই মানুষের শৈশব ফিরে আসে, মনখারাপ হয়...’ কিন্তু ২০১৬-য় মত বদলে তিনিই আবার বলেন, ‘মিস্টার বিনের ভূমিকা থেকে অবসর নেওয়া উচিত বলে আমি কখনও মনে করি না।’ স্বয়ং স্রষ্টাই যখন অবসরে অনিচ্ছুক, তখন এই উজ্জ্বল তিন দশকের মতো আরও বহু দশক তিনি আমাদের উপহার দেবেন, এমনটাই কি ভাবতে ইচ্ছে করে না!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mr. Bean Comedy TV Serial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE