পুজো শুরু হল। সঙ্গে শুরু হল সাজগোজ। জামাকাপড়ে এ ক’টা দিন একটু বেশি কায়দা। চেহারায় চোখে পড়ার মতো আদব। কিন্তু এই যে বাড়তি ঠাটবাট, তা দেখছেটা কে?
পুজোয় শহরে ভিড় ঠেলে ঠাকুর দেখতে বেরোলে দেখনদারির জায়গা কই। মানুষের মাথা ছাড়া আর বিশেষ কিছু চোখে পরে না। জামা কাপড় তো দূর অস্ত। তা হলে এই যে এত খরচ করে জামা-কাপড়-প্যান্ট-জুতো-গয়নাগাটি কিনলেন, তার কী হবে?
নাহ্, সে ধন বৃথা যায় না। পুজোয় কে কেমন সাজলেন, তা গোটা দুনিয়া ঠিকই দেখে ফেলে। ছবিতে, রিলসে, ভিডিয়োয় ‘হ্যাশট্যাগ’ ষষ্ঠী বা সপ্তমী লিখে ঠিক সময়ে আপলোড হয়ে যায় ফোটো। তাতে লন্ডনে থাকা ছোট মাসি থেকে লোনাভালায় কর্মরত প্রাক্তন— লাইক ঠোকেন সবাই।
সমাজমাধ্যমই যেখানে পুজোর ‘ওপেন টি বায়োস্কোপ’, সেখানে পুজো মানে অনেকটাই পারফেক্ট পুজো ক্লিক। ফলে ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় ভাল ছবি উঠলে মন ভাল। অষ্টমীর অঞ্জলি দেওয়ার সাজের ভাল ছবি না উঠলে মুখ ভার।
ভাল ছবির অনেক শর্তও আছে। দু’পাশে জঞ্জাল পড়ে থাকলেও ছবির ফ্রেমের ব্যাকগ্রাউন্ড নিখুঁত হতে হবে। এ যুগের ভাষায় ‘ইনস্টা ওর্দি’ হতে হবে। পুজোয় সাজগোজের মতো তাই ছবি তোলার জন্যও চলে প্ল্যানিং। কেউ কেউ ওয়েবসিরিজ়র মতো পুজোর পাঁচ দিনের ছবির সিরিজ়ও বানিয়ে ফেলেন। মণ্ডপের মতো সেই সিরিজ়ে আবার ‘থিম’ও থাকে।
ধরা যাক, কেউ ঠিক করলেন, পুজোর পাঁচ দিন নানা পুরনো ঠাকুরদালানে নিজের ছবি তুলবেন। কেউ ভাবলেন শহরের সেরা পুজোর প্যান্ডেলের সামনে ছবি তুলবেন ষষ্ঠী থেকে দশমী। আবার কেউ কাশবন থেকে কুমোরটুলি হয়ে ক্যাফে— কিছুই বাদ রাখলেন না। এক এক দিন এক এক রকম। ভাবনায় যত বৈচিত্র, ছবি ততই ট্রেন্ডিং। পুজোর ছবিতে তেমন ট্রেন্ড সেট করতে চাইলে জেনে নিতে পারেন কলকাতার আশপাশেই পুজোর কিছু শুটিং স্পট।
১। কাশবন
শরতের আগমন বার্তা যদি ছবিতে বোঝাতে হয়, তবে কাশবনের চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে! আর সব চেয়ে বড় কথা হল সেই কাশবন খুঁজতে কলকাতার বাইরে যেতে হবে না। গ্রাম নয়, খাস শহরের বুকেই হাওয়ায় কাশের মাথা দোলানো দেখা যাবে নিউটাউনের দিকে গেলে। টালিগঞ্জ এবং বেহালার দিকেও শরৎ এলে মাথা তোলে কাশফুল। দেবীপক্ষের যে কোনও দিন নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ দেখলেই বেরিয়ে পড়ুন। কাশবনের ওপারে ‘পথের পাঁচালী’র ট্রেন না থাক লালপেড়ে সাদা শাড়িতে আপনার দুর্গা হওয়া আটকায় কে!
২। হাওড়া ব্রিজ আর ফুলের হাট
দিলজিৎ দোসঞ্জ কলকাতায় এসে হাজির হয়েছিলেন এই ফুল বাজারে! তাঁর রিলস-এ মল্লিক ঘাটের রূপ দেখে গোটা দুনিয়া জানতে চেয়েছে, জায়গাটা কোথায়। শুধু দিলজিৎ-ই বা কেন। এ ঘাটে এসেছেন প্রিয়ঙ্কা চোপড়া থেকে রণবীর কপূর হয়ে বহু বলিউড তারকা। কারণ, কলকাতা-কেন্দ্রিক অনেক বলিউড সিনেমার শুটিং হয়েছে এখানে। আর ঘরের পাশের এমন একটি পিকচার পারফেক্ট জায়গায় ছবি তোলার সুযোগ আপনি ছাড়বেন? আকাশ মেঘলা হোক বা নীল, তার বুকে আঁকা হাওড়া ব্রিজ, এক পাশে গঙ্গা, অন্য পাশে রঙিন ফুলের পসরা! পুজোর এর থেকে ভাল ইনস্টা ওর্দি পরিবেশ আর কি হতে পারে!
৩। ট্রাম রাইড
দু’কামরার লোহার শকট একটি অস্ত টাইম মেশিন। আজও এক নিমেষে নিয়ে গিয়ে ফেলতে পারে পুরনো শহরের আমেজে। পুজোয় পাটভাঙ্গা তাঁতের শাড়িটি পরে প্রিয় মানুষটির সঙ্গে উঠে পড়ুন সেই ট্রামের কামরায়। জানলা দিয়ে দেখতে থাকুন অচেনা শহরের স্লাইড শো। হারিয়ে যান সময়ের জানলায়। আর ঠিক তখনই লেন্সবন্দি হোক জানলায় মাথা, আলগা খোঁপা, লুটিয়ে পড়া তাঁতের শাড়ি আর এক ইস্পাত যান। কলকাতার ট্রাম এখনও হাতে গোনা কয়েকটি রুটে চলছে। কে জানে আর কত দিন! সুযোগ হারাবেন কি?
৪। সত্যজিৎ রায় ধরণী
‘পরশু তো ষষ্ঠী’— দুর্গা পুজোর চতুর্থীতে এ সংলাপ মনে পড়ে না এমন বাঙালি কমই আছেন। দুর্গাপুজো যদি বাঙালিয়ানার উদযাপন হয়ে থাকে, তবে তা সত্যজিৎ রায়কে বাদ দিয়ে হয় কী করে! আর সত্যজিৎ এবং তাঁর কাজকে ক্যামেরা বন্দি করার জায়গা হতে পারে ‘সত্যজিৎ রায় ধরণী’। বাংলা সিনেমার ‘মহারাজা’র বাড়ির পাশের রাস্তাটির নতুন নাম। যে খানে তৈরি হয়েছে তাঁকে নিয়ে ওপেন মিউজিয়াম। দেওয়ালে দেওয়ালে সত্যজিতের সিনেমার পোস্টার, তাঁর লেখা বইয়ের ইলাস্ট্রেশন। কোথাও ফেলুদার থ্রি মাস্কেটিয়ার্স, তো কোথাও হাড় হিম করা ভিলেন মগনলাল, কোথাও ভূতের রাজা তো কোথাও হীরক রাজা। পুজোয় থিমের মণ্ডপ দেখার একফাঁকে ক্যামেরা নিয়ে সেই রাস্তাও হতে পারে আপনার পুজোর ছবির গন্তব্য।
৫। উত্তর কলকাতা
যে দশভূজাকে নিয়ে উৎসব, তাঁর রূপের সূচনা হয় কলকাতার এই এলাকাতেই। খড়ের কাঠামো কুমোরটুলির মাটি পেয়ে নেয় মাতৃরূপ। তবে চেনা কুমোরটুলি ছাড়াও পুজোর ছবি তোলার বহু জায়গা রয়েছে উত্তর কলকাতায়। যা বাঙালিকে তার ফেলে আসা দিনের কথা মনে করিয়ে দেয়। নকশি রেলিংয়ের ঝুল বারান্দা, জাফরি কাজের কার্নিশ, খড়খড়ি দেওয়া জানলা, খিলানে রঙিন কাচের নকশা করা দরজা, আড্ডা জমানোর রক তো আছেই। চাইলে সার দেওয়া হাতে টানা রিকশাও হতে পারে অন্য রকম পুজোর ছবির অঙ্গ। আর আছে বনেদি বাড়ির পুজো। শোভা বাজারের রাজবড়ি, পাথুরিয়া ঘটার রাজবাড়ি, দর্জি পাড়ার মিত্র বাড়ি, জোড়াসাঁকোর দাঁ বাড়ির পুজো। যেখানে পুজো দেখার পাশাপাশি বনেদিয়ানাকেও বন্দি করা যাবে ছবিতে।