Advertisement
E-Paper

রংবুল-তাকদা-লামাহাট্টা-দাড়া

কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখতে দেখতে, অ্যাজেলিয়ার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে হতে আপনি হারিয়ে যেতে চাইবেন। লিখছেন অঞ্জন সরকারসূয্যিটার মজা দেখো, আজ যে ছুটির দিন নয় ভুলেই গিয়েছে যেন! গাড়ি এগোয় দু’পাশের চা বাগানকে সঙ্গে নিয়ে।

শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ২১:৩৯
অজস্র পাইনের ফাঁক দিয়ে ভেসে আসা সকালের আলো লামাহাট্টার পথে।

অজস্র পাইনের ফাঁক দিয়ে ভেসে আসা সকালের আলো লামাহাট্টার পথে।

সুকনা পেরুলো আমার গাড়ি। আশপাশ একটু রুখু-সুখু। শালের বড় বড় শুকনো পাতারা হাত ধরাধরি করে নেমে আসছে মাটিতে। দূর পাহাড়ের ঘন সবুজে মাঝেমধ্যে শিমুলেরা। তাদের টপকে আর একটু পিছন পানে যদি তাকাই সেখানটায় মেঘ-কুয়াশায় মেশামিশি। সূয্যিটার মজা দেখো, আজ যে ছুটির দিন নয় ভুলেই গিয়েছে যেন! গাড়ি এগোয় দু’পাশের চা বাগানকে সঙ্গে নিয়ে। একটা বাঁকের মাথায় মেঘ-কুয়াশা একে অপরের হাত ছেড়ে যেই দু’দিকে সরে গেল, সূয্যিটা একমাথা কমলা-সোনালি ঝলমলে চুল নিয়ে ছুটে এসে শিমুলকে চুমু দিল। শিমুল লজ্জায় রাঙা হল। সকাল এল আমার মনে…এ’পাহাড়ি পথেও।

চলার মাঝে ছোট্ট বিরতি। গাড়ি দাঁড়ায় একখানে। পুরি-সব্জিতে অন্তরাত্মাকে খুশি করে গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে বাহনে উঠি। সুন্দরী কার্শিয়াংকে ছাড়িয়ে, সোনাদার পুড়ে যাওয়া স্টেশন দেখে মন খারাপের স্মৃতির পাতা উল্টে যে রাস্তায় এসে হাজির হই, সেখানে চালক মনোজের ঘোষণা, ‘সাব, ইস পাঁচ কিলোমিটার রাস্তে পুরাই কাচ্চা হ্যায়…।’ বোল্ডার-পাথর-মাটিতে মোড়া রাস্তা বেয়ে প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে সকালের খাবার হজম করিয়ে নিউ জলপাইগুড়ি থেকে তিন ঘণ্টা যাত্রা শেষে গাড়ি থামলো পথের ধারে। আমি এখন রংবুলে। গাড়ি থেকে নামতেই এক লহমায় মন ভাল হয়ে গেল চারপাশে সবুজে ঘেরা রংবুলের ‘রেনবো ভ্যালি রিসর্ট’ দেখে।

সবুজে ঘেরা রংবুলের ‘রেনবো ভ্যালি রিসর্ট’।

আর শরীরের ক্লান্তি উধাও রিসর্টের দায়িত্বে থাকা রাহুলের এনে দেওয়া গরম লেবু চায়ের কাপে। জানুয়ারি মাস, দুপুর বেলার ঠাণ্ডাটা বেশ আরামদায়ক। দুপুরের খাওয়া শেষে পায়ে পায়ে চলতে থাকি জঙ্গলের মাঝ দিয়ে নেমে যাওয়া পথে। রেলিংয়ে ঘেরা প্রায় দু’কিলোমিটার পথ নেমে যেখানে থেমেছে, সেখানে এক ঝর্না, ‘রেনবো ওয়াটার ফলস’। ঝর্না দেখে পথ উজিয়ে ফিরে চলি ‘সানসেট পয়েন্ট’।

গাছের আড়ালে ঢাকা পড়ছে সূর্য।

সূর্য তখন দিন শেষের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আকাশ এখনও নীল। আস্তে আস্তে সে রং পাল্টালো…পাল্টাতেই থাকল। কখনও কমলা, কখনও উজ্জ্বল হলুদ, কখনও বা চোখ ধাঁধাঁনো সোনালি মেঘেরা সঙ্গত করছে…রঙের সাত সুরের অনায়াস আসা যাওয়া। ছবি তুলব কি, শুধুই তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে…। কিছু ছবি বোধহয় ক্যামেরায় না তোলাই ভাল। দিন শেষে রাত আসে। পাখিরা বাসায়, সঙ্গীর সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছে সারা দিনের না বলা কতই না কথা। আকাশের বাঁকা চাঁদ সাক্ষী থাকে। রাতের আকাশের অজস্র তারা মিষ্টি করে হাসে, রাহুল আগুন জ্বালায়…‘বন ফায়ার’।

তাকদার বিখ্যাত ‘হ্যাঙ্গিং ব্রিজ’

পর দিন ভোর চারটে। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার, কনকনে হাওয়া। মনোজ এসে হাজির। এক ঝলক ‘টাইগার হিল’ যেতে মন চাইছে যে— কত দিন, সেখানে সূর্য ওঠা দেখিনি। গরম চায়ে চুমুক দিয়ে ঠাণ্ডাকে ঢুকতে না দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে উঠে বসি গাড়িতে। টাইগার হিলে উঠছি যখন…একপ্রস্থ হাল্কা পাউডারের মতো তুষারপাত। পথের আশপাশ গুঁড়ো বরফের চাদরে ঢাকা। ঠাণ্ডায় নাকের ডগাটায় সাড় নেই। ঠিক সকাল ৬টা ২৭ মিনিটে সে এলো। চারপাশ রাঙিয়ে। আমার মনের পথ বেয়ে হিমেল হাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছুটে আসতে থাকলো কত পুরনো সেই সব কলেজ দিনগুলোর কথা। রেলিং-এর কোন ধারটায় যেন হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম…পাশে যেন কে ছিল— পিউ না সাগরিকা? কার মাথার অবাধ্য চুলগুলো উড়ে এসে আমার কপাল আর গাল ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল…বাজি রাখতে পারি টাইগার হিলে সূর্যোদয়ের এমন অনেক স্মৃতি আপনার মন বেয়েও নামবে। হতাশ করল কাঞ্চনজঙ্ঘা। যে কোনও কারণেই হোক, আজ সে মেঘের আড়ালে…।

পাহাড়ের কোলে তাকদার অপূর্ব হেরিটেজ বাংলো।

ফিরতি পথে আজ আমি তাকদায়। তাকদার হেরিটেজ বাংলো কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে না পাওয়ার দুঃখ ভোলায়। আলাপ হয় আনন্দ মোকতান এবং তাঁর জামাই সুশীল প্রধানের সঙ্গে। রাতের খাবার টেবিলে যাওয়ার আগে অজস্র গল্প, ঘরের ফায়ার প্লেসের আগুনের সামনে। তাকদায় আজকের রাত দু’ডিগ্রিতে মুড়ে নিয়েছে নিজেকে। সুশীল বলেন, আজ বিশ্রাম নিন, কাল প্রমোদকে বলে দেব আপনাকে আশপাশ ঘুরিয়ে দেখাবে। পরদিন ভোরে জানালা দিয়ে ঘরে আসা আলোয় ঘুম ভাঙে দেখি…। নিজেকে বেশ রাজা-মহারাজা গোছের মনে হচ্ছিল। আপনি যদি দু’টো দিন চুপচাপ বিশ্রাম নিতে চান তবে তাকদা হল আপনার জন্য আদর্শ জায়গা।

প্রমোদ এসে হাজির সকালে। তার গাড়িতে সওয়ারি হয়ে প্রথমে রংগলী-রংগলী টি এস্টেট পার হয়ে যাই ১৯১৬ সালে ব্রিটিশদের তৈরি ‘হ্যাঙ্গিং ব্রিজ’ দেখতে। জায়গাটা খুব সুন্দর, গাছগাছালিতে ঘেরা। ঝুলন্ত সেতুতে একটু সাবধানে পা ফেলাই ভাল, কিছু কিছু জায়গায় কাঠের পাটাতন বেশ পুরনো হয়েছে। সেখান থেকে ‘তিস্তা টি গার্ডেন’-এর সবুজ-সতেজ পার হয়ে ভিউ পয়েন্ট। এখান থেকে আপনি পাবেন তিস্তাকে, বহু দূর পর্যন্ত, সঙ্গে রঙ্গিতও। ভিউ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে উল্টো দিকে একচিলতে কাঞ্চনজঙ্ঘা। চা বাগান শেষে এ বার আসি সেখানকার অর্কিড বাগানে। কি অপূর্ব সংগ্রহ অর্কিড, ক্যাকটাস আর ফার্নে…মন ভরিয়ে দেয়।

পাইনদের বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে লামাহাট্টার ছোট্ট হ্রদ।

দ্বিতীয় দিন সকালে প্রমোদের বাবা, বিনোদ কুমার ধানুটি আমার সারথি, নিয়ে চললেন লামাহাট্টার পথে। লামাহাট্টা…এমন এক জায়গা যেখানে অজস্র বৃদ্ধ পাইনের ফাঁক দিয়ে ভেসে আসা সকালের আলোর পরশ নিতে নিতে, কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখতে দেখতে, অ্যাজেলিয়ার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে হতে…জঙ্গলে ঘেরা পায়ে চলা পথে পা ফেলতে ফেলতে...ফুসফুসটাকে সতেজ করে নিতে নিতে...আপনি হারিয়ে যেতে চাইবেন। লামাহাট্টার মাথায় এক জল টলমল ছোট হ্রদ, পাইনদের বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে, নামার পথে লেপচুতে ‘প্যাসান ফ্রুট জুসে’ চুমুক দিয়ে দাড়া ইকো ভিলেজের রাস্তায়। তিস্তা বাজার পার হয়ে পথ গিয়েছে বেঁকে। সে পথ ধরে বড়া মাঙ্গোয়া পার করে যখন দাড়ায় পৌঁছলাম তখন অজস্র পাখির ডাক ভরিয়ে তুলেছে চারপাশ। বুলবুলরা ব্যস্ত খাবার সংগ্রহে, পীচ রঙা রাই ফুলেরা হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে…মৌমাছিদের ব্যালে রাই ফুলের জমিতে। সন্ধ্যার আঁধারে দাড়া গ্রামের সোনাম মোক্তানের হোম স্টে ‘মোক্তান ভিলা’ রুমঝুম আলো নিয়ে মায়াবী। সেই মায়া কাজল মনের আনাচকানাচে বুলিয়ে দাড়া গ্রামের অল্প ওপরে চোর্তেনের মাঝে দাঁড়িয়ে দিনের প্রথম সূর্যের পরশ নিতে নিতে কাঞ্চনজঙ্ঘার ছায়ায় বিশ্রাম নিতে থাকা কমলালেবু গাছেদের গন্ধ নিয়ে সানবার্ড, বুলবুল আর মিনিভেটদের গানে ভেসে যেতে যেতে ভাবলাম, ‘এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না’…।

প্রথম সূর্যের পরশ নিতে চলে আসুন দারা গ্রামে।

কী করে যাবেন: কলকাতা থেকে নিউ জলপাইগুড়ি (এনজেপি) ট্রেনে অথবা বাসে। সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে রংবুল, তাকদা, লামাহাট্টা হয়ে দাড়া ইকো ভিলেজ। ফিরতি পথে দাড়া থেকে শিলিগুড়ি অথবা এনজেপি।

কখন যাবেন: বর্ষা বাদ দিয়ে যে কোনও সময় আসুন। ডিসেম্বর-জানুয়ারির ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারলে সে সময়টা দারুণ উপভোগ করতে পারবেন। ওই সময় দাড়া বাদে অন্য জায়গাগুলোয় রাতের তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি-৩ ডিগ্রির মধ্যে ও দিনের তাপমাত্রা ৬-৭ ডিগ্রির মধ্যে ঘোরাফেরা করে। দাড়ায় ঠাণ্ডা তুলনামূলক ভাবে কম। শীতে এলে গরম জামাকাপড় অবশ্যই আনবেন।

কোথায় থাকবেন: রংবুল-রেনবো ভ্যালি রিসর্ট।

তাকদা-সাইনো হেরিটেজ বাংলো, স্নেহম হোম স্টে।

দাড়া- মোক্তান ভিলা।

রংবুল ছাড়া বাকি দু-জাগায় থাকার সঙ্গে সারা দিনের (চার বার) খাবার প্যাকেজ আছে, জন প্রতি ৫০০-৬০০ টাকা।

পীচ রঙা রাই ফুলে প্রজাপতিদের ব্যালে।

যোগাযোগ: ১) কলকাতা থেকে বুকিং: ট্রাভেলস মঙ্ক ট্যুরস, ফোন-০৮৯০২২৩২৫৫৯, ০৯০৫১০৬৪৫১০ (অরিজিৎ কর্মকার)

২) রংবুল-সাইমন রাই, ফোন- ০৯৮৩২৬১৬৯৭০

৩) তাকদা-আনন্দ মোক্তান (হেরিটেজ বাংলো), ফোন-০৯৪৩৪৪৬২৮০৬

সুশীল প্রধান, ফোন-০৯৪৩৪৩৮০৮৪৭

প্রমোদ সিংহ (স্নেহম হোম স্টে), ফোন-০৯০০২৬৭৭৭৭১

৪) দাড়া-সোনাম মোক্তান, ফোন-০৯৬৩৫৯৬৩১৮৬

গাড়ির জন্য: রিসর্ট অথবা হোম স্টে-র বুকিংয়ের জন্য যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন তারাই গাড়ির ব্যবস্থাও করে দিতে পারবেন।

(লেখক পরিচিতি: অঞ্জন পেশায় শারীরবিদ্যার শিক্ষক। কিন্তু তাঁর মন ঘুরে বেড়ায় প্রকৃতির মাঝে। জল-জঙ্গল-পাহাড় চষে বেড়ান তিনি, চোখ থাকে সর্বক্ষণের সঙ্গী ক্যামেরার লেন্সে। একাধিক গ্রন্থপ্রণেতা অঞ্জনের কলম ও ক্যামেরার শাটার চলে সমান দক্ষতায়। অঞ্জন শুধু এক জন ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফারই নন, তাঁর ভ্রমণ-আলেখ্য প্রকৃতির মধ্যে খুঁজে ফেরে মানবজমিন।)

Rongbull Takdah Holiday Trip Tourist Spot Tour Package
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy