Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ধর্ষককে ধরার দাবিতে থানায় অবস্থান বধূর

হয় ধর্ষককে গ্রেফতার করুন নয়তো আমাকে গ্রেফতার করুন! এই দাবিতে বুধবার সারাদিন দেগঙ্গা থানায় ঠায় বসে রইলেন অভিযোগকারিণী। নির্জলা অনশন চালিয়ে গেলেন। কেন? রবিউল হক নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করেছিলেন মহিলা। বছর ঘুরে গেলেও পুলিশ তাকে ধরেনি। সে ফেরার বলে পুলিশের দাবি। অথচ দেগঙ্গা এলাকায় তাকে একাধিক বার দেখা গিয়েছে বলে অভিযোগ।

বুধবার দেগঙ্গা থানায় অভিযোগকারিণী। — নিজস্ব চিত্র

বুধবার দেগঙ্গা থানায় অভিযোগকারিণী। — নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:১৮
Share: Save:

হয় ধর্ষককে গ্রেফতার করুন নয়তো আমাকে গ্রেফতার করুন!

এই দাবিতে বুধবার সারাদিন দেগঙ্গা থানায় ঠায় বসে রইলেন অভিযোগকারিণী। নির্জলা অনশন চালিয়ে গেলেন।

কেন? রবিউল হক নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করেছিলেন মহিলা। বছর ঘুরে গেলেও পুলিশ তাকে ধরেনি। সে ফেরার বলে পুলিশের দাবি। অথচ দেগঙ্গা এলাকায় তাকে একাধিক বার দেখা গিয়েছে বলে অভিযোগ। এমনকী অভিযোগকারিণীর কথায়, ‘‘রবিবার থানার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়ে চোখে পড়ে, রবিউল থানা চত্বরেই একটি গাড়ির ভিতরে বসে আছে। সঙ্গে কয়েক জন তৃণমূল নেতাও আছেন। পুলিশ কর্মীদের সঙ্গে হাসিঠাট্টা, চা-পান চলছে।’’

চোখের সামনে এই দৃশ্য দেখেই ওই মহিলা সোজা ঢুকে পড়েন ওসি পলাশ চট্টোপাধ্যায়ের ঘরে। তাঁকে বলেন রবিউলের কথা। ওসি ঘর থেকে বেরিয়ে রবিউলের খোঁজ করেন। কিন্তু ততক্ষণে চলে গিয়েছে সে। মহিলার দাবি, ওসি তাঁকে কথা দেন, আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করা হবে রবিউলকে।

সেই সময়সীমা পেরিয়ে গেলে এ দিন সকাল ১০টা নাগাদ ফের ওসির কাছে গিয়ে বছর সাঁইত্রিশের ওই মহিলা বলেন, ‘‘হয় রবিউলকে গ্রেফতার করুন, নয় আমাকে ধরুন!’’ অভিযুক্ত ধরা না পড়া অবধি থানা চত্বরে বসে অনশন চালিয়ে যাবেন বলে জানান তিনি। পুলিশ সাধ্যমতো চেষ্টা করছে বলে বোঝানো হলেও তা শুনে চলে আসতে রাজি হননি তিনি। জানিয়ে দেন, যতক্ষণ না গ্রেফতার করা হবে রবিউলকে, থানা চত্বরে বসেই অনশন চালিয়ে যাবেন তিনি।

শুধু মুখের কথা নয়, বাস্তবিকই বুধবার রাত ৯টা পর্যন্ত থানা চত্বরে বসে নির্জলা অনশন চালিয়ে গিয়েছেন ওই মহিলা। কিছুক্ষণের জন্য অসুস্থও হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু পুলিশকর্মীদের কাছ থেকে কোনও রকম সহযোগিতা মেলেনি বলে তাঁর অভিযোগ। বরং কিছু পুলিশকর্মীর বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ তুলেছেন তিনি। রাত ৯টা নাগাদ তিনি থানা থেকে বেরিয়ে যান।

দেগঙ্গা থানার একটি সূত্রের অবশ্য দাবি, রবিবার ও বুধবার থানায় ঢুকে পুলিশ কর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন ওই মহিলাই। মহিলা পুলিশের সঙ্গে তাঁর ধাক্কাধাক্কি হয়।

কিন্তু পুলিশ এত দিন ধর্ষণের মতো গুরুতর অভিযোগে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি কেন? কেনই বা চার্জশিট জমা পড়েনি? উত্তর ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘অভিযুক্ত পলাতক। সে কারণেই চার্জশিট দেওয়া হয়নি।’’ কিন্তু রবিউলকে এলাকায় দেখা যাচ্ছে, এমনকী থানাতেও পুলিশ কর্মীদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দেখেছেন অভিযোগকারিণী। তা হলে পুলিশ রবিউলকে ধরতে পারছে না কেন? পুলিশ কর্তার বক্তব্য, ‘‘এ‌ই অভিযোগ এসেছে। খতিয়ে দেখা হবে।’’

পুলিশের অন্য একটি সূত্র জানাচ্ছে, রবিউল বেশির ভাগ সময়ে কলকাতায় থাকেন। এর আগে বেশ কয়েক বার তল্লাশি চালালেও দেখা মেলেনি তার।

তা-ই যদি হয়, তা হলে প্রায় ১৪ মাস পরে কেন পুলিশের উপর চাপ তৈরি করলেন নির্যাতিতা? তাঁর বক্তব্য, পুলিশকে এর আগে অনেক বার বলেও লাভ হয়নি। রবিবার খোদ পুলিশ কর্মীদের সঙ্গেই রবিউলকে খোশগল্প করতে দেখে তিনি আর স্থির থাকতে পারেননি। নিজেই ওসির কাছে চলে গিয়েছিলেন।

বুধবার পার্ক সার্কাসের বাড়ি থেকে মোবাইলে রবিউলের স্ত্রী জুলেখা হকও জানান, রবিউল বাড়িতেই আছেন। তিনি পলাতক নন। তবে জুলেখার দাবি, তাঁর স্বামী নির্দোষ। সম্পত্তি নিয়ে গোলমালের জেরেই ফাঁসানো হচ্ছে তাঁর স্বামীকে।

নিগৃহীতার কিন্তু দাবি, রবিউল হক সম্পর্কে তাঁর এক দেওর। ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি বেড়াচাঁপায় তাঁর বাড়িতেই রবিউল ধর্ষণ করে তাঁকে। ঘটনার দিন পনেরো বাদে থানায় লিখিত অভিযোগ করেন মহিলা। বারাসত আদালতে তাঁর গোপন জবানবন্দিও নেওয়া হয়। কিন্তু তদন্ত এর বেশি এগোয়নি।

মহিলার অভিযোগ, তৃণমূলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার জন্যই পুলিশ সব জেনেশুনেও গ্রেফতার করেনি রবিউলকে।

এলাকাবাসীরা জানাচ্ছেন, অভিযুক্ত রবিউল হক এলাকায় তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। রবিউলকে তিনি চেনেন বলে স্বীকার করছেন তৃণমূলের দেগঙ্গা ব্লকের সভাপতি মিন্টু সাহাজিও। তবে তাঁর দাবি, ‘‘এই ঘটনার সঙ্গে দলের সম্পর্ক নেই। সম্পত্তি নিয়ে গোলমালের জেরে একটা মিথ্যা অভিযোগ তোলা হচ্ছে।’’

নিগৃহীতার স্বামী এ দিন বাড়িতেই ছিলেন। তাঁরও বক্তব্য, ‘‘ঘটনার পর থেকে রবিউল একাধিক বার এলাকায় এসেছে। বেড়াচাঁপায় তার ব্যবসাও আছে। কিন্তু পুলিশ সব জেনেশুনেও তাকে ধরছে না।’’

এর উত্তরে ভাস্করবাবু এ দিন বলেন, ‘‘মঙ্গলবার আমাদের চিঠি দিয়ে অপরাধীকে ধরা হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন ওই মহিলা। আমরা বিষয়টি দেখছি।’’

একই আশ্বাস দিচ্ছেন মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায়। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘বিষয়টি আমি খোঁজ নিয়ে দেখব। সেই সঙ্গে, এক বছর আগের অভিযোগে পুলিশ এখনও কেন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেনি, তা-ও খোঁজ নেব।’’

কখনও পার্ক স্ট্রিট, কখনও কড়েয়া, কখনও মধ্যমগ্রাম— ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়ার পরেও পুলিশের দিক থেকে যথেষ্ট সক্রিয়া না হওয়ার অভিযোগ বারবারই উঠেছে। সেই তালিকায় জুড়স দেগঙ্গার নামও।

আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় এ দিন বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই তদন্ত শেষ করার জন্য আরও সময় চেয়ে পুলিশ আদালতে আবেদন জানায়। এটা আইনবিরোধী না হলেও ধর্ষণের মামলায় তদন্তের দ্রুত নিষ্পত্তি করতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ রয়েছে। অতীব গুরুত্বের সঙ্গে এবং নির্যাতিতার প্রতি সহানুভূতির সঙ্গে তদন্ত করতে হবে বলেও নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। ‘‘অভিযুক্ত পলাতক থাকলেও চার্জশিট দিতে অসুবিধে ছিল না পুলিশের। তার উপরে যদি থানায় দেখা যায় ‘পলাতক’ অভিযুক্তকে, তা হলে তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন তো উঠবেই,’’ বলেন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE