ছবি: পিন্টু মণ্ডল
চোখে দেখেন না। হাঁটাচলার সম্বল বলতে হাতের লাঠি। সেই লাঠি হাতেই এলাকায় ঘুরছেন বছর ষাটের বৃদ্ধ। কাঁধে ঝোলানো মাইক নিয়ে হেঁকে বলছেন, ‘গুজবে কান না দেবেন না।’
মঙ্গলবার চম্পাহাটি বাজারে এ ভাবেই সাধারণ মানুষকে সচেতন করছিলেন বাবলু চক্রবর্তী। এই বাজারেই লটারির টিকিট বিক্রি করে সংসার চলে তাঁর। তবে গুজব কাণ্ডের জেরে সে কাজ শিকেয় তুলে মানুষটা রাস্তায় নেমেছেন মানুষকে সচেতন করতে।
গুজবের জেরে গত কয়েক দিন ধরে উত্তেজনা ছড়িয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার একাধিক জায়গায়। কাউকে শিশুচোর কাউকে কিডনিপাচারকারী বলে দাগিয়ে দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় চলছে নানা অপপ্রচার। সে সবের সত্যতা যাচাই না করে কিছু লোকের কান ভাঙছে তাতে। জায়গায় জায়গায় লোককে ধরে স্রেফ সন্দেহের বশে মারধর করেছে জনতা। অচেনা মুখ দেখলেই কোথাও কোথাও ঘিরে ধরছে ভিড়টা। উড়ো প্রশ্নে শাসানির ঢঙ। উত্তর সন্তোষজনক না হলেই পড়ছে চড়-থাপ্পড়।
রবিবার মগরাহাট এলাকায় সন্দেহের বশে দু’জনকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। চোর বা কিডনি পাচারকারী সন্দেহে একের পর এক গণপিটুনি চলছে। জয়নগরের বহড়ু স্টেশন চত্বরে দু’জন অজ্ঞাতপরিচয়কে বেধড়ক মারধর করা হয়। একই ঘটনা ঘটে বেলিয়াচণ্ডী, মোমরেজগড়ে। শুধু গুজব ছড়িয়ে নিরাপরাধ লোকদের মারধরই নয়, হামলা-লুটপাটও হচ্ছে দোকানপাটে।
অপপ্রচারে প্রভাবিত ও আতঙ্কিত না হওয়ার জন্য প্রশাসন থেকে প্রচার শুরু হয়েছে সর্বস্তরে। পঞ্চায়েত, পুলিশের তরফে এলাকায় মাইক নিয়ে প্রচার চলছে। তবে তার মধ্যেও নিজের মতো করে মানুষকে সচেতন করার কাজ করে চলেছেন বাবলু।
সুভাষগ্রামের কোদালিয়ার বাসিন্দা বাবলু দীর্ঘ দিন ধরেই চম্পাহাটি বাজারে লটারির টিকিট বেচেন। কোনও দোকান নেই। অন্ধ বৃদ্ধ লাঠি এবং মাইক হাতে ঘুরে ঘুরেই বিক্রি করেন লটারির টিকিট।
তবে মঙ্গলবার সকাল থেকে টিকিট বিক্রি বন্ধ রেখে শুরু করেছেন প্রচার। হঠাৎ এমন ভাবনা এল কেন?
বৃদ্ধের কথায়, ‘‘সকলেই এই নিয়ে কথা বলছে। এলাকায় নাকি দুষ্কৃতী ঢুকে পড়েছে। মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে। কিন্তু আমার বুদ্ধিতে মনে হচ্ছে, এ সবই গুজব। পুলিশ-প্রশাসন থেকেও শুনলাম তাই বলেছে। তাই টিকিট বিক্রি বন্ধ রেখে এলাকায় ঘুরে সকলকে বোঝানোর চেষ্টা করছি।’’
চায়ের দোকানগুলির সামনে লোকজনের জটলা বুঝতে পারলেই তাঁদের কাছে গিয়ে বাবলু অনুরোধ করছেন, অযথা ভুল খবর না রটাতে। কোথাও কোথাও টিটকিরিও শুনতে হচ্ছে। ভারী গলায় ধমক জুটছে। কিন্তু মাথা ঠান্ডা রেখে নিজের সাধ্য মতো বিবেক-বুদ্ধির কথা বলছেন বাবলু।
তাঁর কথায়, ‘‘অনেকেই প্রচারে বাধা দিচ্ছে। বলছে, সত্যিই নাকি এ সব ঘটছে। একজন একটা জায়গার কথা বলে বললেন ওখানে এ রকম ঘটেছে। আমি পাল্টা বললাম, আমায় নিয়ে চলো। দেখব কী হয়েছে। তাতে উনি চুপ করে গেলেন।’’
বাবলুর প্রচার শুনে চায়ের ভাঁড় হাতে থমকে গেলেন এক যুবক। বিড় বিড় করে বলতে শোনা গেল, ‘‘যে মানুষটার চোখ নেই, তিনিও ধাপ্পাবাজিটা ধরে ফেলেছেন। অথচ, সুস্থ-সবল মানুষগুলো নিজেদের বুদ্ধিসুদ্ধি হারিয়ে কী কাণ্ডটাই না করছে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy