একসঙ্গে: পুজোর সময়ে। শনিবার, বাখড়াহাটে। ছবি: অরুণ লোধ
দু’দিন কলেজ যায়নি মাসুদ আর তার বন্ধুরা। কোথায় কোন দোকানদার বসবেন, ক’টা মাইক লাগবে, কী ভাবে ঘোষণা হবে— এ সব সামলাতেই কেটে যায় সময়। প্রতি বছর এই সময়টায় তিন দিনের ছুটি বরাদ্দ। যদিও ইদ গিয়েছে মাসও ঘোরেনি। কিন্তু আষাঢ় মাসের শেষের এই উৎসবে আনন্দের কোনও খামতি ঘটেনি।
একটি বটগাছ আর তার সংলগ্ন মনসা গাছ ঘিরেই হয় উৎসব। পাঁজি মেনে আষাঢ়ের শেষ শনি বা মঙ্গলবার সেখানে পুজো দিয়ে যান সাবিত্রী, সোমার সঙ্গে মর্জিনা বিবি, আদিজারা। এ বছর যেমন পড়েছে শনিবারে। ঠাকুরপুকুর থেকে ন’কিলোমিটার পথ উজিয়ে কেয়াতলার হাট। লোক মুখে কেতলার হাট নামেই পরিচিত। এলাকাটি দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুর থানার অধীন। প্রায় তিরিশ বছর আগে এলাকার অবস্থাপন্ন সুবল ঘোষের পরিবার মনসা গাছের পাশেই তাঁদের জমিতে একটি মন্দির গড়ে মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁদের বাড়ি থেকে মন্দির দেড় কিলোমিটার। তাই সুষ্ঠু ভাবে এই পুজো সামলানোর দায়িত্ব তুলে নেন স্থানীয় মুসলমান ছেলেরা। যদিও প্রায় পঞ্চান্ন বছর ধরে পুজোর সাক্ষী প্রদীপ পালের কথায়, ‘‘মন্দির তৈরির আগে থেকেই পুজো সামলাচ্ছে মুসলমান সম্প্রদায়। ওঁরাও পুজো দেন।’’
লোকমুখে প্রচলিত, সাপের শঙ্খ দেওয়ার জায়গা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল ওই জায়গা। কেউ একটি মনসার ডাল পুঁতে দেন সেখানে। সেই গাছ যত বড় হয়, বিশ্বাসও ডাল-পালা মেলতে থাকে। সুকুর আলি-সমীর নস্করদের মতে সেই বিশ্বাসটা বড্ড দৃঢ়, তাই বাদুড়িয়ার ঘটনা ওঁদের কাছে খুব তুচ্ছ। হাসতে হাসতে সুকুর জানালেন, হিন্দু-মুসলমানের থেকে বরং বেশি আক্রমণাত্বক ঘটি-বাঙালের লড়াইয়ে। সমীর বলেন, ‘‘ওঁদের মিলাদে যাই। ইফতারে বাড়িতে চলে আসে লাচ্চা পরোটা, সেমাই, মাংস। জানেন, হিন্দু প্রতিবেশীদের জন্য ওঁরা খাসি আড়াই পোঁচে জবাই করে প্রসাদ পাঠান।’’
বিবিরহাটের ইদ মেলায় রয়েছেন রমজান শেখ। তিনি এই পুজোর সঙ্গেও জড়িত। রমজান বলছিলেন, ‘‘আমরা তো কখনওই আলাদা ভাবি না। একই পাতে ভাগ করে খেয়ে বড় হয়েছি। সেই শিক্ষা দিয়েছি সন্তানদের। উপোস না করলেও স্নান করে বাতাসা-মিষ্টি দিয়ে পুজো দিই। জলা-জংলার জায়গা, মনসা মাকে তুষ্ট করতে হবে না!’’ কাঁদুনে সাউ জানান, স্থানীয় ক্লাবের ছেলেরাই এই পুজোর দায়িত্ব নেন। পঞ্চাশ জন সদস্যের পাঁচ জন বাদে বাকি সব মুসলমান। নয়ের দশকে কলকাতার একাংশে যখন দাঙ্গা ছড়িয়েছিল, সে দিনও রাতের আড্ডায় মনসুর আর বিপ্লবের পাশাপাশি বসতে কোনও আতঙ্ক তাড়া করেনি। আজও রাজনীতি বা ধর্ম কিছুই ওঁদের হাত ছাড়াতে পারবে না। বলছিলেন, মনসুর-সুকুর আর প্রহ্লাদেরা।
পুজো ঘিরে সকালেই বাখড়াহাট রোডের দু’ধারে বসে মেলা। এক্কেবারে পুরনো মেলার মেজাজ নিয়ে বসা এই মেলার মূল আকর্ষণই হল ফল, ফুল এবং হরেক বাহারি গাছের সম্ভার।
রসুল, শবনমরা ফল, ফুল, মিষ্টি-বাতাসার ডালা নিয়ে বসে মন্দিরের দোরগোড়ায়। মাইকে ঘন ঘন নাম ঘোষণা হতেই মাসুদ দ্রুত পায়ে এগিয়ে যান মন্দিরের দিকে। বাপ-ঠাকুরদার সময় থেকে এমনটাই হয়ে আসছে যে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy