Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ওঝার জলপড়া নয়, যান হাসপাতালেই

‘ভূত তাড়াতে’ এক তরুণীকে বেধড়ক পিটিয়েছিল ওঝা। কুসংস্কারে ভর করে মানসিক ভাবে অসুস্থ তরুণীর উপরে কয়েক ঘণ্টা ধরে অত্যাচার চলে।

ওঝার দাপট, সেদিনের ঘটনা। ফাইল চিত্র।

ওঝার দাপট, সেদিনের ঘটনা। ফাইল চিত্র।

 সীমান্ত মৈত্র
গাইঘাটা শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

‘ভূত তাড়াতে’ এক তরুণীকে বেধড়ক পিটিয়েছিল ওঝা। কুসংস্কারে ভর করে মানসিক ভাবে অসুস্থ তরুণীর উপরে কয়েক ঘণ্টা ধরে অত্যাচার চলে। ওঝার লাথি লেগে যখন বাড়ির উঠোনে ছিটকে পড়েন তরুণী বধূ, গ্রামের লোক তখন ভিড় করে দেখছে ওঝার কেরামতি। জলের বালতি দাঁত দিয়ে ধরে তরুণীতে হাঁটতে বাধ্য করে ওঝা। গ্রামের লোকে সে দিন টুঁ শব্দটি করেননি কেউ।

গাইঘাটার মধ্য বকচরা এলাকার ওই ঘটনার কথা জেনে আঁতকে ওঠেন পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারাও। এলাকা যে অন্ধবিশ্বাসে ডুবে রয়েছে, তা জানতে আর বাকি ছিল না।

এ বার ওই গ্রামকে কুসংস্কারমুক্ত করতে এগিয়ে এল বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী মঞ্চ। বুধবার মঞ্চের তরফে এলাকাবাসীদের নিয়ে সচেতনতা শিবিরের আয়োজন হয়। মঞ্চের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ সরকার বলেন, ‘‘মধ্য বকচরা গ্রামকে আমরা কুসংস্কারমুক্ত গ্রামে পরিণত করতে চাই। সম্প্রতি এখানকার রোগাক্রান্ত এক মহিলার উপরে ঝাড়ফুঁক ও নিপীড়নের ঘটনা আমাদের নজরে এসেছে।’’

তরুণীর উপরে নির্যাতনের খবর পেয়ে ঘটনার দিনই গ্রামে গিয়েছিলেন বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী মঞ্চের সদস্যেরা। শ্বশুরবাড়ির লোকজন ও গ্রামবাসীদের তাঁরা সে সময়ে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, ‘ভূতে ধরা’ বলে আদৌ কোনও ঘটনা নেই। মানসিক অসুস্থতার ফলে এমন ঘটনা কখনও সখনও ঘটে। তরুণীকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে অনুরোধ করে দেখেছিলেন যুক্তিবাদী মঞ্চের সদস্যেরা। গ্রামের মানুষ উল্টে তাঁদের উপরেই সে দিন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন।

তবে দমে যাননি মঞ্চের সদস্যেরা। ওঝার বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেন তাঁরা। পুলিশ ঘটনার তদন্তে তরুণীর বাড়িতে যায়। তদন্তকারী পুলিশ অফিসারেরাও তরুণীকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। শেষ পর্যন্ত তরুণীকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন বাড়ির লোকজন। চিকিৎসার পরে তরুণী অনেকটাই সুস্থ বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে।

তবে মঞ্চের সদস্যেরা সে সময়ে গ্রামে গিয়ে জানতে পেরেছিলেন, এখানকার মানুষ অনেকেই রোগবালাই হলে জলপড়া, তেলপড়ার মতো ওঝা-গুনিনের কেরামতির উপরেই বেশি ভরসা করেন। জন্ডিস হলেও তাঁরা চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে ওঝার কাছে যান। জানা গেল, এলাকায় কারও দাঁতের যন্ত্রণা হলে স্থানীয় এক বৃদ্ধা শিকড় দিয়ে ‘দাঁতের পোকা’ তুলতেন। চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে গ্রামবাসীরা ওই বৃদ্ধার কাছেই যেতেন। বৃদ্ধা অবশ্য কিছু দিন আগে মারা গিয়েছেন।

গ্রামটিকে ‘কুসংস্কারমুক্ত গ্রাম’ হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী মঞ্চ। বুধবার শিবিরে অধ্যাপক, চিকিৎসক, সমাজকর্মী-সহ সমাজের বিশিষ্ট মানুষ ভূত-প্রেত, ঝাড়ফুঁক, তুকতাক, জলপড়া, তেলপড়া নিয়ে গ্রামবাসীদের সচেতন করেন। মঞ্চের সদস্যেরা হাতে-কলমে পরীক্ষা করে দেখান, জন্ডিসে আক্রান্ত রোগীর শরীর থেকে হলুদ বের করার পিছনে থাকে ওঝাদের কেরামতি। হাতে আমের কষ মেখে চুনজলে হাত দিলে সেই জল হলুদ হয়ে যায়।

গাইঘাটার বিডিও বিব্রত বিশ্বাস বলেন, ‘‘আমাদের পক্ষ থেকেও গ্রামের মানুষকে সচেতন করার কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে। মঞ্চের তরফেও আমাদের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। আমরা ওঁদের পাশে আছি।’’একই কথা জানিয়েছেন গাইঘাটা পঞ্চায়েত সমিতির জনস্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ ধ্যানেশনারায়ণ গুহ। শুকদেব মণ্ডল নামে যে ওঝা সে দিন তরুণীর উপরে নির্যাতন চালিয়েছিল বলে অভিযোগ, তাকে খুঁজছে পুলিশ।

এ দিনের কর্মসূচিতে অবশ্য ওই তরুণী বা তাঁর স্বামী আসেননি। তাঁরা বাড়িতেই ছিলেন। সচেতনতা শিবিরের পরে গ্রামের মানুষ কার্যত দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছেন। কয়েকজন মহিলার কথায়, ‘‘শিবিরে না এলে জানতেই পারতাম না, ভূত-প্রেতের ভর করার ব্যাপারটা নেহাতই বুজরুকি। কেউ এ ভাবে কোনও দিন আমাদের বোঝাতে আসেননি। এখন থেকে কেউ অস্বাভাবিক আচরণ করলে তাঁকে হাসপাতালেই নিয়ে যাব।’’ তবে অনেকে এ সব যুক্তির কথা শুনবেন না বলে গোঁ ধরে বসে আছেন। প্রদীপ বলেন, ‘‘মানসিকতা বদলাতে সময় লাগবে। দীর্ঘদিনের বিশ্বাস চট করে যাবে না। তবে এই শিবিরে অনেকই কিন্তু আমাদের কথা মনে দিয়ে শুনেছেন। আমরা এ ভাবে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করার কাজ নিয়মিত চালিয়ে যাব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Medical Health Science
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE