ছোট ইলিশ। —ফাইল চিত্র।
এক দিকে চড়া চাহিদা। অন্য দিকে ঢিলে নজরদারি। তাই বাজার ছেয়েছে ছোট ইলিশে।
মৎস্য দফতরের নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ডায়মন্ড হারবার, কাকদ্বীপ হয়ে কলকাতা অবধি দক্ষিণবঙ্গের বহু বাজারে অঢেল মিলছে দেড়শো-দু’শো গ্রামের ইলিশ। কেন এমন হচ্ছে, প্রশ্ন করলে ট্রলার মালিক আর ভুটভুটি মালিক এ ওকে দুষছেন। একে অন্যের দিকে আঙুল তুলছেন মৎস্য দফতরের কর্তারা আর মৎস্যজীবীদের সংগঠনের নেতারা। আর এই সব টানাপড়েনের ফাঁক দিয়ে গলে যাচ্ছে ঝাঁকে-ঝাঁকে ছোট ইলিশ।
এ বছর ১৫ জুন থেকে সামুদ্রিক মাছের মরসুম শুরু হয়েছে। প্রথম প্রথম কয়েক দিন বড় সাইজের ইলিশ পেয়েছেন মৎস্যজীবীরা। তা-ও তা একেবারে মোহনায়। কিন্তু তার পর থেকেই বড় ইলিশে ভাটা। বাজারদর চড়চড় করে বেড়েছে। এই সুযোগে এক মাসেরও বেশি ধরে বেআইনি ভাবে ছোট ইলিশ ধরা বেড়ে গিয়েছে।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার পশ্চিমাঞ্চলে নামখানা, কাকদ্বীপ, রায়দিঘি, কুলতলি থেকেই মূলত গভীর সমুদ্রের ৯০ শতাংশ ইলিশ রাজ্যে আসে। রায়দিঘির ট্রলার মালিক প্রসেনজিৎ দাসের দাবি, বছরের শুরুতেই মৎস্য দফতর এখানে কয়েক বার বেআইনি মাছ ধরার বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। তার জেরে ট্রলার মালিকরা সতর্ক হয়েছেন। ছোট ইলিশ মাছ ধরা বন্ধ। তাঁর অভিযোগ, ‘‘ভুটভুটি নৌকো নিয়ে যাঁরা মাছ ধরতে যান, মূলত তাঁরাই ছোট ইলিশ ধরছেন।’’ আবার, ভুটভুটি মালিকদের দাবি, তাঁরা ছোট ইলিশ ধরছেন না।
অনেকের মতে, আসল সমস্যা লুকিয়ে রয়েছে ‘মিড ট্রলিং’ (অগভীর সমুদ্রে মাছ ধরা) করার অনুমতিতে। হাওড়া, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার সামুদ্রিক মৎস্যক্ষেত্রে মোট ৮০০ লাইসেন্সধারী মৎস্যজীবী ও ট্রলার মালিক রয়েছেন, যাঁদের রাজ্য সরকার ‘মিড ট্রলিং’ করার অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু এঁদের অনেকেই সরকার অনুমোদিত ৯০ মিলিমিটার ফাঁসের চেয়ে ছোট ফাঁসের জাল নিয়ে সমুদ্রে যাচ্ছেন। আইন ভেঙে ‘বটম ট্রলিং’ (সমুদ্রের তলায় ছাঁকনি জাল) করে ছেঁকে তোলা হচ্ছে ছোট মাছ। মৎস্য দফতরের নাকের ডগা দিয়েই ছোট ইলিশ বন্দর থেকে বেরিয়ে ট্রাক বোঝাই হয়ে নামখানা থেকে কাকদ্বীপ হয়ে ডায়মন্ড হারবারে ঢুকছে। গোটা রাস্তায় ট্রাকের যাত্রা অবাধ করতে কয়েকটি ক্লাবকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করতে হয়েছে বলেও কানাঘুষো শোনা গেল। হাওড়া, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা মিলিয়ে ১৯টি ব্লকে কমবেশি ৩৭টি ‘ফিশল্যান্ডিং ঘাট’ (মাছ ধরে এনে যেখানে জড়ো করা হয়) রয়েছে। সামুদ্রিক মৎস্য ব্লকগুলিতে নজরদারি করার জন্য এক জন সহ-মৎস্য অধিকর্তা, দু’জন জেলা মৎস্য আধিকারিক এবং দু’জন ফিশারিজ এক্সটেনশন অফিসার আছেন। তাঁরা মাঝেমধ্যে অভিযানে যান। তাতে যে তেমন কাজ হচ্ছে না, তা স্পষ্ট।
নজরদারির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকা সত্ত্বেও মিড ট্রলিংয়ের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে কেন? উপ-মৎস্য অধিকর্তা (সামুদ্রিক) সন্দীপ মণ্ডলের ব্যাখ্যা, ‘‘কেবল নজরদারির লোক কম বলেই মিড ট্রলিংয়ের সমস্যা হচ্ছে, এমন নয়।’’ মৎস্যকর্তাদের অভিযোগ, যাঁরা বেআইনি ভাবে ছোট মাছ ধরছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে সক্রিয় যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছে না মৎস্যজীবী সংগঠনগুলি।
ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনাইটেড ফিশারমেন অ্যাসোসিয়েশনের নেতা বিজন মাইতি পাল্টা দাবি করেন, সংগঠনগুলিই বেআইনি মাছ ধরার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। মৎস্য দফতরে খবর দেয়। কিন্তু মৎস্যকর্তারা কিছু করতে পারেন না। বিজনবাবুর কথায়, ‘‘আমরা সহযোগিতা করছি। কিন্তু সংগঠন তো আর আইনি ব্যবস্থা নিতে পারে না।’’
মৎস্যজীবীরা যেমন আইনের পরোয়া করছেন না, তেমনই বেপরোয়া ক্রেতারাও। ডায়মন্ড হারবার থেকে চন্দননগর, বারাসত থেকে ডোমজুড়— দেড়শো থেকে দু’শো গ্রামের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৩৫০ টাকা দরে। ডায়মন্ড হারবার বাজারের এক মাছ বিক্রেতা বলেন, ‘‘মধ্যবিত্তদের মধ্যে কম দামে ছোট ইলিশের চাহিদা বেশি।’’ বড় ইলিশ, অর্থাৎ ৮০০ গ্রাম-১ কেজির ইলিশের দর ১১০০-১২০০ টাকা কিলোগ্রাম। সাধ্যের মধ্যে সাধ মেটাতে ছোট ইলিশ খুঁজছে খদ্দের।
এ ভাবে চললে দেড়-দু’কেজি ইলিশের স্বাদ-সুঘ্রাণ পাওয়া যাবে শুধু লোকগাথায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy