সাক্ষী: সংস্কারের পরে সতীদাহ ঘাট। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ। ঝোপজঙ্গলে ভরা গঙ্গার পাড় থেকে মাঝেমধ্যেই ভেসে আসত ঢাক, ঢোল, কাঁসর, ঘণ্টার আওয়াজ!
যাঁদের কানে সেই শব্দ পৌঁছত তাঁরা বুঝতে পারতেন কী ঘটছে। গগনভেদী সেই আওয়াজই বলে দিত, কোনও কিশোরী বধূর সহমরণের কাহিনি। দুশো বছরের বেশি পুরনো সেই স্মৃতি, আজও জেগে রয়েছে কলকাতার গা ঘেঁষা প্রাচীন জনপদ বরাহনগরে। এখনও সেখানে রয়েছে ‘সতীদাহ’ ঘাট। এলাকার ইতিহাস বহন করে যা আজও গল্প শোনায় সহমরণের।
গঙ্গার পাড় ধরে হাঁটলেই রায় মথুরানাথ চৌধুরী স্ট্রিটে চোখে পড়ে ছোট্ট পরিসরে থাকা সতীদাহ ঘাটের। ইতিহাসের সাক্ষী ওই ঘাটকে বাঁচিয়ে রাখতে তৎপর হয়েছে বরাহনগর পুরসভাও। পুরনো ঘাটটি অবশ্য অনেক কাল আগেই তলিয়ে গিয়েছে গঙ্গায়। তবে ১৫ ও ১৬ নম্বর রায় মথুরানাথ চৌধুরী স্ট্রিটের ওই ছোট অংশটি বাঁধিয়ে সেখানে রাজা রামমোহন রায়ের আবক্ষ মূর্তি বসিয়েছেন পুরকর্তৃপক্ষ। লাগানো হয়েছে আলো। তৈরি হয়েছে বসার জায়গা।
এলাকার পুরনো বাসিন্দা তথা সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় জানান, এক সময়ে বিত্তজীবী মানুষ ও বেনে সম্প্রদায়ের বাস ছিল বরাহনগরে। সঙ্গে গঙ্গার পাড় ঘেঁষে ছিল জমিদারদের বাগানবাড়ি। টাকির মুন্সি জমিদারদের পূর্বপুরুষ ছিলেন রায় মথুরানাথ চৌধুরী। তাঁদেরই বিরাট বাড়ি, বাগান ছিল এই বরাহনগরে। এ ছাড়াও আরও অনেকের বাগান ছিল এই এলাকায়। এখন যেটি রায় মথুরানাথ চৌধুরী স্ট্রিট, সেটি ছিল গা ছমছমে পথ। যে জায়গাটিকে সতীদাহ ঘাট বলা হচ্ছে, তার অদূরেই রয়েছে কাশীপুর মহাশ্মশান। সঞ্জীববাবু বলেন, ‘‘কাশীপুর শ্মশানে অবশ্য কখনও সতীদাহ হয়নি। কিন্তু বরাহনগরের এই গঙ্গার ঘাটে সে কালের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ব্রাহ্মণেরা বিধবাদের পুড়িয়ে মারার একটা ব্যবস্থা করেছিল।’’
লেখক স্বপন বসুর ‘সতী’ নামক বইতেও উল্লেখ রয়েছে বরাহনগরের গঙ্গার পাড়ের সেই সব ঘটনার। তিনি লিখেছেন, ‘কামারহাটির কৃষ্ণদেব মুখোপাধ্যায় মারা গিয়েছেন, খবর পেয়েই পাল্কি চেপে বরাহনগরের গঙ্গার ঘাটে হাজির হয়েছিলেন এক বৃদ্ধা। বয়সের ভারে ঠিক মতো চলতে না পারা ওই বৃদ্ধা ছিলেন কৃষ্ণদেববাবুর স্ত্রী। স্বামীর মৃত্যুর খবর পেয়ে বরাহনগরের ঘাটে তিনি এসেছিলেন সতী হতে। বৃদ্ধার ইচ্ছানুসারে স্বামীর চিতার পাশেই শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁকেও।’ এই লেখা থেকে বোঝা যায়, বরাহনগরের ওই ঘাটে যে শুধু কিশোরী বধূদেরই সতী করা হত তা নয়, অনেক বৃদ্ধা স্ত্রী-ও সতী হতেন।
ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায় জানান, প্রাচীন প্রথা সতীদাহের উল্লেখ পাওয়া যায় বেদে। তবে সে সময়ে সেটা খুব বড় আকারে ছিল না। ব্রাহ্মণ, রাজপুত, জমিদারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত রাজস্থানে রাজপুতদের প্রধান প্রথা ছিল এই সতীদাহ। তাতে অবশ্য সমাজের নিম্ন শ্রেণির লোকেরা অংশ নিতেন না। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও হত না। তবে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে আচমকাই অন্যান্য প্রদেশকে পিছনে ফেলে বাংলাদেশে সতীদাহ বেড়ে গেল। রজতকান্তবাবু বলেন, ‘‘এর মূল কারণ ছিল, নিম্ন শ্রেণির মানুষেরাও সমাজের উঁচু স্থানে বসতে চাইলেন। তাঁদের মধ্যেও সতীদাহ প্রথার চল হতেই সমস্যা প্রকট হল। যার ফলে বাংলাদেশে বেশি সতীদাহ হতে থাকল। নিম্ন বঙ্গে বিশেষত কলকাতা থেকে হুগলি জেলার মধ্যে এর চল ছিল বেশি।’’ সহমত পোষণ করে সঞ্জীববাবুও বলেন, ‘‘চন্দননগর, শ্রীরামপুর, চুঁচুড়া, হুগলিতেও এই প্রথার চল ছিল।’’
রবীন্দ্রভারতীর ইতিহাসের শিক্ষক ও পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদের সম্পাদক আশিসকুমার দাস বলেন, ‘‘সতীদাহের ইতিহাস ঘাঁটলে বরাহনগর ও বাঁকুড়ায় সতীঘাটের উল্লেখ পাওয়া যায়। আরও দেখা যায়, হুগলি, বর্ধমান, নদীয়া, ২৪ পরগনা ও কলকাতার শহরতলির মেয়েরাই সব থেকে বেশি সতী হতেন। তার মধ্যেই রয়েছে কলকাতা লাগোয়া বরাহনগরও।’’
ওই কালো অধ্যায়কে ইতিহাস হিসেবেই বাঁচিয়ে রাখতে চান বরাহনগরের পুর কর্তৃপক্ষ। চেয়ারপার্সন অপর্ণা মৌলিক বলেন, ‘‘ঘাটটি ফের বানানোর জন্য ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্পে আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু কিছু হয়নি। সকলকে ওই ইতিহাস জানাতেই ঘাটটি বাঁধানো হয়েছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy