Advertisement
E-Paper

নৌকো চলত যমুনায়, এখন সে সব গল্পকথা মনে হয় এলাকার মানুষের

দূর থেকে দেখলে সবুজ গালিচা বলে ভুল হতেই পারে। তবে এটিই হল গাইঘাটার মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া যমুনা নদী। একদা খরস্রোতা নদীটি বহু অযত্নে নাব্যতা হারিয়ে মজে যেতে বসেছে। নদী জুড়ে কচুরিপানার বাড়বাড়ন্ত। বাহারি ফুলও ফুটেছে। কিন্তু কোথাও এক ফোঁটা জলের চিহ্ন দেখা মেলা মুশকিল। বহু দিন হল স্থানীয় বাসিন্দারা এখন আর নদীতে স্নান করতে পারেন না। নদী পাড়ের বাসিন্দারা জানালেন, মশার উপদ্রব বেড়েছে। এলাকার বহু মানুষ সন্ধ্যায় নদীর পাড়ে বসে সময় কাটাতেন।

সীমান্ত মৈত্র

শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০১৫ ০১:১৭
ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

দূর থেকে দেখলে সবুজ গালিচা বলে ভুল হতেই পারে। তবে এটিই হল গাইঘাটার মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া যমুনা নদী।
একদা খরস্রোতা নদীটি বহু অযত্নে নাব্যতা হারিয়ে মজে যেতে বসেছে। নদী জুড়ে কচুরিপানার বাড়বাড়ন্ত। বাহারি ফুলও ফুটেছে। কিন্তু কোথাও এক ফোঁটা জলের চিহ্ন দেখা মেলা মুশকিল। বহু দিন হল স্থানীয় বাসিন্দারা এখন আর নদীতে স্নান করতে পারেন না। নদী পাড়ের বাসিন্দারা জানালেন, মশার উপদ্রব বেড়েছে। এলাকার বহু মানুষ সন্ধ্যায় নদীর পাড়ে বসে সময় কাটাতেন। মশার জ্বালায় সে সবও বন্ধ। নৌকাও চলে না আর। বেআইনি ভাবে নদীতে মাছ ধরার জন্য বাঁশ-কাঠের ভেচাল দেওয়া হয়েছে। স্রোত বলতে কিছু নেই। নদী থেকে কচুরিপানা তোলার এবং পলি তুলে নাব্যতা বাড়ানোর দাবি এলাকার মানুষের দীর্ঘদিনের। অতীতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে একশো দিনের কাজ প্রকল্পে নদী থেকে বিক্ষিত ভাবে কচুরিপানা তোলা হলেও এখন তা-ও হয় না। চোখের সামনে প্রিয় নদীটিকে মৃতপ্রায় হতে দেখে হতাশ গাইঘাটার মানুষ।

গাইঘাটা ব্লক প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, এই ব্লকে যমুনা প্রবেশ করেছে স্থানীয় ধর্মপুর-২ পঞ্চায়েত এলাকার মধ্যে দিয়ে। শেষে ইছাপুর-১ পঞ্চায়েতের মধ্যে দিয়ে তা গোবরডাঙায় চলে গিয়েছে। গাইঘাটা ব্লকে যমুনা রয়েছে প্রায় ১২ কিলোমিটার। এক কালে এই নদীই ছিল গাইঘাটার বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রধান নিকাশির মাধ্যম। নদী মজে যাওয়ায় জল ধারণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। এখন বর্ষার মরসুমে উল্টে নদীর জল কৃষি জমি ও লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে। যমুনার পাশাপাশি ইছামতীও নাব্যতা হারিয়েছে। জবর দখলে প্রায় হারিয়ে গিয়েছে স্থানীয় চালন্দিয়া নদীও। অন্য খাল-বিল-বাওর-নদীর অবস্থা শোচনীয়। সব মিলিয়ে গাইঘাটার নিকাশি ব্যবস্থা বলতে আজ কিছুই নেই। যার জেরে একদিকে যেমন চাষিরা ভুগছেন জলের অভাবে, অন্য দিকে ফি বছরে বহু মানুষকে বর্ষার সময় বাড়ি ছেড়ে ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিতে হচ্ছে।

যমুনা থেকে কচুরিপানা তোলা ও নদীর স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন করছেন এখানকার মানুষ। বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনের বিভিন্ন মহলে স্মারকলিপি দিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি কিছুই। এলাকার বসিন্দা গৌতম দাস, হরি শীল, জগদীশ দেবনাথরা বললেন, ‘‘নদী-নির্ভর জীবন-জীবিকা বন্ধ। কেউ স্নানটুকু করতে পারেন না। মশার উপদ্রব। এ সব কথা প্রশাসনকে জানিয়েও ফল মেলেনি।’’

মঙ্গলবার গাইঘাটা বাজার এলাকায় গিয়ে কথা হচ্ছিল স্থানীয় ব্যবসায়ী কৃষ্ণ দাসের সঙ্গে। জানালেন, অতীতে দেখেছেন, যমুনার অন্য চেহারা। তখন নদী ছিল আরও চওড়া। স্রোত ছিল দেখার মতো। গভীরতাও ছিল অনেক বেশি। মানুষ তখন নৌকায় করে যাতায়াত করতেন। জলপথেই স্থানীয়, চণ্ডীগড়, শেরপুর, খেজুরবাগান, বাঙলানি-সহ বেশ কিছু গ্রামের চাষিরা গাইঘাটা হাটে সোম-শুক্রবার মালপত্র নিয়ে আসতেন। গাইঘাটা বাজার কালী মন্দির কমিটির সম্পাদক নকুল সরকার বলছিলেন পুরনো দিনের কথা। জানালেন, এখানে নারকেল দোয়া বলে একটি জায়গা আছে। সেখানে অতীতে নদীতে এতটাই স্রোত থাকত যে নদীর মাঝ বরাবর নৌকা যেতে পারত না।

নদী মজে যাওয়ায় সমস্যায় পড়েছেন মৎস্যজীবীরাও। অনেকে বিকল্প রোজগারের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। অনেকে বাইরের রাজ্যে কাজ খুঁজে নিয়ে চলে গিয়েছেন।

যমুনার দুই পাড়ে রয়েছে, আমকোলা, রামপুর, বাগনা, নারিকেলা, মাঠকুমড়া, নাইগাছির মতো বেশ কিছু এলাকা। সেখানকার মানুষজনও নদীর মৃতপ্রায় দশার জন্য নানা ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। খেজুরবাগান এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, নদীতে জল বলে কিছু নেই। পুরোটাই কচুরিপানায় ঢাকা। নদী-সংলগ্ন এলাকায় কৃষি জমিতে পাট চাষ হয়েছে। স্থানীয় চাষি বলরাম দেবনাথ বলেন, ‘‘নদীর কচুরিপানা খেতে ঢুকে পড়ে সেই কচুরিপানা সরাতে বহু টাকা খরচ হয়ে যায়। এখানে এখন পাট ছাড়া আর কোনও ফসল হয় না। আগে ধান হত, সব্জি হতো।প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে, যমুনা নদীর জন্য জলেশ্বর-১, জলেশ্বর-২, ও ইছাপুর-১ পঞ্চায়েত ও ধর্মপুর-২ পঞ্চায়েতের কিছু এলাকার চাষি ও সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ইছামতী নদীর জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সুটিয়া রামনগর ঝাউডাঙা পঞ্চায়েতের মানুষ। এ ছাড়া, শিমুলপুর ও ডুমা পঞ্চায়েতের আশিংক এলাকাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে যমুনা নদী থেকে কচুরিপানা বা পলি তোলার ব্যাপারে ব্লক প্রশাসনের কর্তারা কোনও আশ্বাস দিতে পারেননি। গাইঘাটার পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সুব্রত সরকার বলেন, ‘‘একশো দিনের কাজের প্রকল্পে কচুরিপানা তোলা এখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বিকল্প ফান্ডও নেই।’’ বিডিও পার্থ মণ্ডলের কথায়, ‘‘কচুরিপানা তোলা বা পলি তুলে সংস্কার করার মতো পরিকাঠামো ও আর্থিক সামর্থ্য পঞ্চায়েত সমিতির নেই।’’ যদিও আশার কথা শুনিয়েছে বিদ্যাধরী ড্রেনেজ ডিভিশন। দফতরের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার নির্বাহী বাস্তকার সোমেন মিশ্র বলেন, ‘‘গাইঘাটা এলাকায় যমুনা নদী থেকে কচুরিপানা তোলা এবং ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদী থেকে পলি তুলে নদী সংস্কারের বিষয়টি আমাদের গুরুত্বের তালিকার মধ্যে আছে। ইতিমধ্যেই ওই বিষয়ে রাজ্য সেচ দফতরের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এখন পদ্মা নদী, পদ্মা খাল ও নাংলা খাল সংস্কার হচ্ছে। ওই কাজ শেষ হলে যমুনা নদীতেও হাত দেওয়া হবে।’’

গাইগাটা ব্লকের আরও একটি অন্যতম নিকাশির মাধ্যম ছিল চালুন্দিয়া নদী। সে-ও বিলুপ্তির পথে। অভিযোগ, নদীর জমি দখল করে বাড়িঘর তৈরি হয়েছে। সামান্য বৃষ্টিতেই এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ভেঙে পড়েছে সেচ ব্যবস্থাও।

স্থানীয় চাঁদপাড়া এলাকায় চাঁদপাড়া-ঠাকুরনগর সড়কের উপরে একটি কালভার্টের নীচে ওই নদীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেল। যা এখন নালায় পরিণত হয়েছে। নোংরা আবর্জনায় ভর্তি। স্থানীয় বাসিন্দারা ‘চালুন্দিয়া নদী বাঁচাও মঞ্চ’ করে আন্দোলন শুরু করেছেন। প্রশাসনিক মহলে স্মারকলিপি দেওয়া থেকে শুরু করে বিক্ষোভ-সমাবেশ, নাগরিক কনভেনশন— কিছুই বাদ রাখছেন না। মঞ্চের সম্পাদক নন্দদুলাল দাস জানালেন, গোপালনগরের কাঁচিকাটা থেকে চালুন্দিয়া নদীর জন্ম। ১৭টি পঞ্চায়েতের মধ্যে দিয়ে নদীটি প্রবাহিত হয়েছে। কিন্তু নদী এখন মৃতপ্রায়।

গাইঘাটার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে ইছামতী নদী। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী সীমান্ত। গাইঘাটা ব্লকে ইছামতীর দু’বার ড্রেজিং হয়েছে। তবুও নাব্যতা খুব বেশি বাড়েনি। ঝাউডাঙা এলাকায় নদীতে নোনা জল ঢুকে মাছ মারা যাচ্ছে। বর্ষায় নদীর জল লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে। নোনা জল ঢুকে পড়ায় ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। ডুমার বাওরের জলও নানা কারণে দূষিত হয়ে গিয়েছে। ফলে তা চাষের কাজে লাগে না।

(চলবে)

amar shohor my town jamuna river gaighata jamuna river jamuna river dead jamuna river history
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy