আকাশে চক্কর কাটছে বিমান। নেমে এসেছে এতটাই নিচুতে যে মনে হচ্ছে, এই বুঝি নারকেল গাছে ধাক্কা খেয়ে যাবে! তারপর আরও নীচে..। উড়তে উড়তেই নেমে এসেছিল জলকাদা ভরা ধান খেতে।
আমদাবাদের বিমান দুর্ঘটনার পরে এ ভাবেই উত্তর ২৪ পরগনার স্বরূপনগরে ঘুরপাক খাচ্ছে তেত্রিশ বছর আগের স্মৃতি। তবে সেই দিন বিমান মাঠে অবতরণ করে মাঝখান থেকে দু’টুকরো হয়ে গেলেও বিপর্যয়, প্রাণহানি হয়নি। বিমানের পাইলট এবং বিমানকর্মীদের উদ্ধার করেছিলেন স্থানীয় মানুষজন। তার পরেও বিমানের ধ্বংসাবশেষ পড়ে ছিল স্বরূপনগরের ওই মাঠে। তা নিয়েও কম স্মৃতি নেই। তাই আজও ঘুরেফিরে স্বরূপনগরের স্মৃতিতে ফিরে আসে ১৯৯২ সালের ৩০ মার্চ।
স্বরূপনগরের নতুনপাড়ার ধান খেতে ভেঙে পড়া রুশ বিমানটি হ্যানয় থেকে উড়েছিল। মাঝআকাশেই জ্বালানি শেষ হয়ে যাওয়ায় কলকাতা বিমানবন্দরে নামার আগেই পাইলট স্বরূপনগরের ফসল খেতে নামিয়ে দেন বিমানটিকে। মালবাহী বিমানটিতে পাইলট-সহ সাত জন ছিলেন। বিমানটি প্রায় মাঝ বরাবর ভেঙে গেলেও অক্ষত অবস্থায় বার করা গিয়েছিল তাঁদের। যে জমিতে বিমানটি নেমেছিল, তার শরিকি মালিকানা ছিল স্বরূপনগরের বাসিন্দা গঙ্গারাম হালদারের। বর্তমানে বৃদ্ধ গঙ্গারাম সে সময়ে তরতাজা যুবক ছিলেন। স্মৃতিতে ডুব দিয়ে বললেন, “চৈত্র মাসের এক বিকেলে বিমানটা জলকাদা ভরা মাঠে নেমেছিল। আমদাবাদের মতো ফেটে যায়নি। তাই আমরা সবাই বিমানের ভাঙা অংশ দিয়ে ঢুকে পাইলট-সহ বাকিদের বার করে এনেছিলাম। পরে পুলিশ এসে তাঁদের নিয়ে যায়।”
স্বরূপনগরের বাসিন্দারা বলছেন, ভাঙা বিমানের জিনিসপত্র যাতে চুরি না-হয় তার জন্য মাসখানেক পুলিশি পাহারা ছিল। দূরদূরান্ত থেকে লোকজন ভাঙা বিমান দেখতে আসতেন। শেষে বিমানের জিনিসপত্র সব বার করে নিয়ে গেলে পুলিশের পাহারা উঠে যায়। নতুনগ্রামের বাসিন্দা বিকাশ মণ্ডলের কথায়, “তখন এখানে মেলা বসার জোগাড়। কী ছিল না সেখানে! খাবারের দোকান থেকে শুরু করে সাইকেলের গ্যারাজ—সব তৈরি হয়ে গিয়েছিল। প্রতিদিন হাজার-হাজার লোক আসত, ভাঙা বিমান দেখে ফিরে যেত।” ভাঙা বিমান সাত-আট বছর ওই মাঠেই পড়ে ছিল। দূরের রাস্তা থেকেও দেখা যেত বিমানের ভাঙা ডানা। তবে এখন সে সব অবশিষ্ট নেই।
স্থানীয় বাসিন্দা দেবব্রত জোয়ারদার জানান, এক সময় দা-কুড়ুল দিয়ে অনেকেই বিমানের কিছু অংশ কেটে বাড়ি নিয়ে চলে গিয়েছেন। পরে পুলিশ এসে বাকিটুকু থানায় নিয়ে গিয়েছিল। শুক্রবার স্বরূপনগর থানায় গিয়েও বিমানের অবশিষ্টের খোঁজ মেলেনি। থানার বাইরে দাঁড়ানো এক সিভিক ভলান্টিয়ার বললেন “গোটা কয়েক যা টুকরো পড়েছিল, বছর দুয়েক আগে সেই সব বিক্রি হয়ে গিয়েছে।” অনেকের মতো বিমানের ভাঙা অংশ কেটে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন নতুনপাড়ার বাসিন্দা নলিনীরঞ্জন মণ্ডল। এ দিন সে কথা তুলতেই বাড়ির টিনের চালের ভিতর থেকে দু’টি টুকরো বার করে আনলেন। সেই টুকরোয় জমে থাকা ধুলো সাফ করতে করতেই বৃদ্ধ বললেন, “এতে মানুষের রক্ত লেগে ছিল না। কিন্তু আমদাবাদে যা দেখছি..!”
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)