মাঠ ভরা ফসল। —নিজস্ব চিত্র।
অর্থকরী ফসল হিসেবে রাজ্য সরকার সূর্যমুখী চাষে উৎসাহ দিচ্ছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার দুই মহকুমায় চাষিরা সূর্যমুখী চাষও করছেন। বাড়ছে চাষের এলাকা। কিন্তু চাষিদের লাভ দিচ্ছে না সূর্যমুখী। কেননা, নেই বিপণনের ব্যবস্থা। তাই নিজেদের সাংসারিক প্রয়োজনের বাইরে গিয়ে ওই চাষে উৎসাহ পাচ্ছেন না বেশির ভাগ চাষিই। কৃষি দফতর অবশ্য সূর্যমুখী তেল বিপণনের ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিচ্ছে। কিন্তু চাষিরা বলছেন, না আঁচালে বিশ্বাস নেই।
ডায়মন্ড হারবারের উস্তির বাসিন্দা শীতল নস্করের প্রায় এক বিঘা জমি রয়েছে। তিনি ১০ কাঠা জমিতে এ বার সূর্যমুখী চাষ করেছেন। বাকি জমিতে প্রথাগত ভাবে বোরো এবং মুগ ডাল। শীতলবাবু বলেন, ‘‘সূর্যমুখীতে ‘ফলন গতবারের তুলনায় ভাল হয়েছে। এক একটি ফুলে বীজের পরিমাণও ঠিকঠাক। এ থেকেই সারা বছরের খাবারের মতো তেল হয়ে যাবে। বাড়তি জমিতে ফসল বুনে লাভ কী? তেল তো বিক্রি করতে পারব না।’’
একই সুর কাকদ্বীপের বাপুজি এলাকার সূর্যমুখী চাষি অশ্বিনীকুমার জানার গলাতেও, ‘‘‘প্রায় ১৫ কাঠা জমিতে চাষ করেছি। বাড়ির জন্য বছরের তেল রেখে গ্রামের এক-দু’জন চাইলে দিই। বাড়তি চাষ করলে বিক্রি করব কোথায়? কোনও সংস্থা নিতে আসে না।’’
ডায়মন্ড হারবার মহকুমার কুলপি, উস্তি, মন্দিরবাজার, মথুরাপুর এবং কাকদ্বীপের চারটি ব্লকেই কমবেশি সূর্যমুখীর চাষ হয়েছে এ বছর। কাকদ্বীপের বাপুজি, সূর্যনগর, পাথরপ্রতিমা, শ্রীনগর, নামখানার মতো এলাকাগুলিতেও সূর্যমুখী চাষ হচ্ছে কয়েক বছর ধরে। কিন্তু এখনও বিপণন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি।
অথচ, কৃষি দফতরের হিসাবই বলছে, গত বছর দু’টি মহকুমা মিলিয়ে সূর্যমুখী চাষ হয়েছিল ৩২১২ হেক্টর জমিতে। এ বার ৩৯৩৭ হেক্টরে সরকারি বীজে চাষ হয়েছে। বেসরকারি সংস্থার থেকে বীজ কিনে চাষ করা জমির পরিমাণ আরও প্রায় দেড় হাজার হেক্টর হবে। দুই মহকুমায় এই চাষের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৫০ হাজার চাষি। ফসল কাটা শুরু হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। অর্থাৎ, নিজেদের পারিবারিক প্রয়োজনের জন্য হলেও চাষিরা সূর্যমুখী চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। ভাল দাম পেলে বাড়তি তৈলবীজ উৎপাদন করার কথাও বলেছেন তাঁরা।
কিন্তু সূর্যমুখী তেলের বিপণন ব্যবস্থা কেন গড়ে তোলা যাচ্ছে না?
সে প্রশ্নের সরাসরি কোনও উত্তর দেননি ডায়মন্ড হারবার এবং কাকদ্বীপ মহকুমার দায়িত্বে রয়েছেন অতিরিক্ত কৃষি-সচিব মহম্মদ আসিফ লস্কর। তাঁর কথায়, ‘‘এখন হেক্টর প্রতি সূর্যমুখী তৈলবীজের উৎপাদন এক টনের কাছাকাছি। এটা আরও বাড়াতে হবে। তার জন্য শস্তায় ভাল মানের বীজ এবং উৎপাদিত তৈলবীজ বাজারজাত করার জন্য নানা প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।’’
কৃষি দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে, গত বছর একটি বেসরকারি সংস্থাকে দিয়ে চাষিদের কাছ থেকে তৈলবীজ কেনার পরিকল্পনা জেলায় শুরু হলেও তা বাস্তবে রূপ পায়নি। কারণ, কৃষকদের ন্যায্য দাম দিয়ে বীজ কেনার ক্ষেত্রে পিছিয়ে গিয়েছিল ওই সংস্থা। তাই মহকুমা স্তর থেকে জেলা দফতরে প্রস্তাব পাঠানো হচ্ছে, এই দুই মহকুমার কোথাও একটি দু’বার পরিস্রুত করা যায় এ রকম সুবিধাযুক্ত একটি তেলকল ইউনিট চালু করার। একই সঙ্গে প্রাণিসম্পদ দফতরের অধীনে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল লাইভ স্টক ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন’-এর কর্তাদের সঙ্গেও কথাবার্তা চালানো হচ্ছে। যাতে ওই সংস্থা জেলায় কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে সূর্যমুখীর বীজ কেনে। পাশাপাশি, কৃষি বিপণন দফতরের তরফে একটি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে চেষ্টা শুরু হয়েছে। কৃষকদের মধ্যেই ছোট ছোট গোষ্ঠী তৈরি করে নিজেদের উৎপাদিত সূর্যমুখী তেল বাজারজাত করানোর। কুলপি, কাকদ্বীপে দু’টি তেলকলে পরিশোধন করার যন্ত্র লাগিয়ে সেখানে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে তেল উৎপাদনের তোড়জোড় শুরু হয়েছে এই মরসুম থেকে।
কিন্তু সামগ্রিক ভাবে তেল বিপণনের ব্যবস্থা করা না গেলে এই বিকল্প চাষ অর্থকরী হবে না বলেই মনে করছেন চাষিরা। তাঁদের কথায়, কখনও-সখনও তেলকল মালিকেরা চাষিদের থেকে তেল কিনে নেন। তাতে কিছুটা লাভের মুখ দেখেন চাষিরা। কিন্তু তা নেহাতই ব্যতিক্রম। ভাল মানের সরকারি বীজ মিললে এবং বিপণনের ব্যবস্থা হলে তাঁদের অনেকেই আরও বেশি পরিমাণ জমিতে সূর্যমুখী চাষ করতে পারেন বলে জানান চাষিরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy