Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
অশোকনগর-কল্যাণগড়

ঘরের দ্বন্দ্ব রুখে গতবারের সাফল্য ধরে রাখাই চ্যালেঞ্জ শাসক দলের

অতীতে যা ছিল বামেদের ঘরোয়া কোন্দল, এ বার সেটাই তৃণমূলের সৌজন্যে ডালপালা মেলেছে অশোকনগর-কল্যাণগড়ে। বরং গোটা রাজ্যে কোণঠাসা বামেরা এখানে অনেকটাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ছে। অশোকনগর-কল্যাণগড় পুর এলাকাটিকে এক সময়ে বামেদের দুর্ভেদ্য দুর্গ হিসাবে পরিচিত ছিল। পুরসভাটি তৈরি হয় ১৯৬৮ সালে। ’৮১ সাল থেকে নির্বাচন শুরু হয়।

সীমান্ত মৈত্র
অশোকনগর শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৩৭
Share: Save:

অতীতে যা ছিল বামেদের ঘরোয়া কোন্দল, এ বার সেটাই তৃণমূলের সৌজন্যে ডালপালা মেলেছে অশোকনগর-কল্যাণগড়ে। বরং গোটা রাজ্যে কোণঠাসা বামেরা এখানে অনেকটাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ছে।

অশোকনগর-কল্যাণগড় পুর এলাকাটিকে এক সময়ে বামেদের দুর্ভেদ্য দুর্গ হিসাবে পরিচিত ছিল। পুরসভাটি তৈরি হয় ১৯৬৮ সালে। ’৮১ সাল থেকে নির্বাচন শুরু হয়। আর তখন থেকেই ২০১০ সাল পর্যন্ত বামেরাই ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু প্রবল দলীয় কোন্দল এখানে মাথাচাড়া দিয়েছিল। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছয়, গতবার পুরভোটে সিপিএম নেতৃত্ব তৎকালীন পুরপ্রধান শর্মিষ্ঠা দত্ত ও বিধায়ক সত্যসেবী করকে প্রার্থী করেনি। এই দু’জনের কোন্দলই ছিল অশোকনগর-কল্যাণগড়ে সিপিএমের সব থেকে বড় মাথা ব্যথার কারণ। প্রয়াত দমদমের সাংসদ অমিতাভ নন্দী ও প্রয়াত পরিবহণ মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর হাত দু’জনের মাথায় ছিল।

সে সব দিন এখন নেই। দলের একের পর এক ব্যর্থতায় ঢাকা পড়েছে নিজেদের গোলমাল। এ বার পুরভোটে শর্মিষ্ঠাদেবী ও সত্যসেবীবাবু দু’জনকেই প্রার্থী করেছে সিপিএম। নতুন মুখের পাশাপাশি দুই অভিজ্ঞ নেতানেত্রীকেও লড়াইয়ে নামানো হয়েছে। সত্যসেবীবাবু দাঁড়িয়েছেন ৯ নম্বর ওয়ার্ড থেকে। সেখানে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূলের বিদায়ী কাউন্সিলর তথা হেভিওয়েট প্রার্থী চিরঞ্জীব সরকার। শর্মিষ্ঠাদেবী দাঁড়িয়েছেন ১০ নম্বর ওয়ার্ডে। সেখানে তিনি শাসক দলের বিদায়ী কাউন্সিলর ঝর্ণা দাসের মুখোমুখি। টক্করটা যে কঠিন, তা বিলক্ষণ জানেন দুই পোড় খাওয়া বাম নেতানেত্রী।

সিপিএম এ বার ২৩টি আসনের মধ্যে প্রার্থী দিয়েছে ১৫টি ওয়ার্ডে। সিপিআই দিয়েছে ৬টি ওয়ার্ডে। ৪ নম্বর ও ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে তারা নির্দল প্রার্থীকে সমর্থন করেছে। বাম ঐক্যে গোল বেধেছে একটি মাত্র ওয়ার্ড নিয়ে। ১২ নম্বর ওয়ার্ডে সিপিআইয়ের সুজিত সেন বাম প্রার্থী হয়েছেন। এখানে নির্দল প্রার্থী হিসাবে দাঁড়িয়েছেন সিপিএম কর্মী তাপস পাল। দল তাঁকে বহিষ্কার করেছে। কিন্তু সিপিএমের কর্মী-সমর্থকদের এখানে তাপসবাবু হয়েই প্রচারে দেখা যাচ্ছে বেশি। নেতারাও সে ভাবে প্রচারে গা ঘামাচ্ছেন না।

দলীয় কোন্দলের জন্য এ বার আনুষ্ঠানিক ভাবে এখানে প্রার্থী তালিকাই ঘোষণা করতে পারেনি তৃণমূল। প্রার্থীরা সরাসরি মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন বারাসতে জেলাশাসকের দফতরে গিয়ে। দলীয় নির্দেশ মেনে এখানে প্রার্থী বাছাই করতে গিয়ে প্রাথমিক ভাবে জটিলতা তৈরি হয়েছিল। প্রার্থী বাছাই সভায় দু’দল তৃণমূল কর্মী সমর্থকেরা মারপিটেরও জড়িয়ে পড়েছিলেন। পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

বিদায়ী পুরপ্রধান সমীর দত্ত ও উপ পুরপ্রধান প্রবোধ সরকারের মধ্যে বিরোধের আলোচনা এখানে তৃণমূলের অন্দরে কান পাতলেই শোনা যায়। এ বারই প্রথম ভোটে দাঁড়ানো প্রবোধবাবুর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত এক তৃণমূল প্রার্থী জানালেন, তাঁর ওয়ার্ডে সমীরবাবুরা প্রচারে গা ঘামাচ্ছেন না। অন্য দিকে, গতবারের কাউন্সিলর এবং সমীরবাবুর ঘনিষ্ঠ এক প্রার্থীর কথায়, ‘‘আমার ওয়ার্ডে এখনও বিধায়ক ধীমান রায় ও প্রবোধ সরকার প্রচারে আসেননি।’’

ধীমানবাবু জানান, অনেকেই প্রার্থী হওয়ার দাবিদার ছিলেন। তবে তা নিয়ে কারও কোনও ক্ষোভ নেই। তাঁদের দলে কোনও ঘরোয়া কোন্দলও নেই। প্রবোধবাবুও বলেন, ‘‘আমাদের মধ্যে কোনও ভুল বোঝাবুঝি নেই। আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েই লড়াই করছি। প্রার্থীদের নিয়েও দলে কোনও ক্ষোভ-বিক্ষোভ নেই।’’ আর সমীরবাবুর কথায়, ‘‘দলীয় কর্মসূচি গ্রহণে আমি প্রবোধবাবু ও ধীমানবাবুর সঙ্গে আলোচনা করে বহু সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ফলে আমাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির কোনও অবকাশ নেই।’’

দলের নেতারা মুখে যাই বলুন না কেন, তৃণমূলের ঘরোয়া আলোচনায় বার বার উঠে আসছে অন্তর্দ্বন্দ্বের প্রসঙ্গ। ভোটের দিন তা কোনও প্রভাব ফেলে কিনা, তা নিয়েও চিন্তায় আছেন নেতৃত্ব।

কংগ্রেস এখানে সব ওয়ার্ডে প্রার্থী দিতে পারেনি। ১৬টি ওয়ার্ডে তারা প্রার্থী দিয়েছে। কংগ্রেস নেতা সুহাস দত্ত বলেন, ‘‘মূলত ছাত্র-যুবদের এ বার প্রার্থী করা হয়েছে।’’

কী অবস্থা বিজেপির?

রাজ্যে বিজেপি প্রথম যে বিধানসভার আসনটি জিতেছিল, সেটি ছিল অশোকনগর। ১৯৯৯ সালে বিধানসভার উপ নির্বাচনে সে বার সিপিএমের রেখা গোস্বামীর মতো হেভিওয়েট প্রার্থীকে হারিয়ে জয়ী হয়েছিলেন বিজেপির বাদল ভট্টাচার্য। তৎকালীন সিপিএম বিধায়ক নীরোদ রায়চৌধুরীর মৃত্যুতে ভোটে হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে বিজেপি তাদের সেই সাফল্য ধরে রাখতে পারেনি। ২০০১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বাদলবাবু পরাজিত হন। জয়ী হয়েছিলেন সিপিএমের শর্মিষ্ঠাদেবী। বাদলবাবু হয়েছিলেন তৃতীয়।

তবে বিজেপির কিছুটা জনভিত্তি এখনও থেকে গিয়েছে এই এলাকায়। জেলা বিজেপির সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব হালদার ফলাফল নিয়ে বেশ আশাবাদী। যদিও ঘরোয়া আলোচনায় বিজেপির নেতারা খুব একটা ভরসা করতে পারছেন না। তবে তারা ২৩টি আসনেই এ বার প্রার্থী দিয়েছে। তার মধ্যে আঠারো জনই নতুন মুখ।

কিন্তু প্রার্থী বাছাই নিয়ে বিজেপির মধ্যেও ক্ষোভ-বিক্ষোভ আছে। কিছু ক্ষেত্রে দলী নেতৃত্ব উপর থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রার্থীকে চাপিয়ে দিয়েছেন বলে অনুযোগ শোনা যাচ্ছে। ৯ নম্বর ওয়ার্ডে এক জন বিজেপির গোঁজ প্রার্থীও রয়েছেন। এমন পাঁচ জনকে এ বার বিজেপি প্রার্থী করেছে, যারা সিপিএম বা তৃণমূল ছেড়ে এসেছেন অল্প দিন আগেই। গত লোকসভা ভোটের নিরিখে বিজেপি একটি মাত্র ওয়ার্ডে এগিয়ে ছিল এখানে। সেটি হল ২১ নম্বর ওয়ার্ড। সেখানে এ বার প্রার্থী হয়েছেন সুশান্ত মৈত্র। ওই একটি আসন ধরে রেখে আরও আসন বাড়িয়ে নেওয়া যায় কিনা, সেটাই এখন মরিয়া চেষ্টা বিজেপির তরফে।

উন্নয়ন-অনুন্নয়নের চাপানউতোরের পাশাপাশি অন্য যে বিষয়টি সব দলের প্রচারেই প্রাধান্য পাচ্ছে, তা হল আইন-শৃঙ্খলা। একটা সময় ছিল অশোকনগর ছিল দুষ্কৃতীদের আড্ডাখানা। রাতের পর রাত বোমার শব্দে ঘুমোতে পারতেন না মানুষ। তার দায় কার, তা নিয়ে কাজিয়া আছে বাম ও তৃণমূলের মধ্যে। ইদানীং দুষ্কৃতী তাণ্ডব কমেছে বলে সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা। কিন্তু তা মানতে নারাজ সিপিএম-সহ অন্য বিরোধী দলগুলি। এলাকায় শান্তি ফিরেছে বলে ঢালাও প্রচার চালাচ্ছে তৃণমূল। সিপিএমের সত্যসেবীবাবুর অভিযোগ, ‘‘গত পাঁচ বছরে দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। তোলাবাজি, ছিনতাই, কেপমারির ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু অপরাধীরা ধরা পড়েনি। দুষ্কৃতীরা ধরা পড়লেও তাদের ছাড়াতে থানায় কারা তদ্বির করতে করতে গিয়েছেন, তা এলাকার মানুষের অজানা নয়।’’ তৃণমূলের বিদায়ী চেয়ারম্যান সমীরবাবুর পাল্টা বক্তব্য, ‘‘দুষ্কৃতীরা এখন কেউ এলাকায় নেই। এলাকা দুষ্কৃতী-মুক্ত। শান্তি ফিরেছে। এখানে অপরাধীদের তৈরি করেছিল সিপিএম। আমাদের দলের কারও সঙ্গে সমাজবিরোধীদের কোনও সম্পর্ক নেই।’’

সমস্যা আছে আরও। গত কয়েক বছরে কিছু শিল্প-কারখানা এখানে বন্ধ হয়েছে। যেমন, রাধা কেমিক্যালস। কল্যাণী স্পিনিং মিলও ধুঁকছে। সড়ক পথে যোগাযোগ ব্যবস্থা, নিকাশি নিয়েও ক্ষোভ আছে।

উন্নয়ন নিয়ে দাবি, পাল্টা দাবি যতই থাক, তৃণমূলের মাথাব্যথার কারণ একটাই। তা হল দলের মধ্যে বিভিন্ন উপ-দল ও তাদের নিজেদের টানাপড়েন। ভোটের দিন অন্তত যা ধামাচাপা থাক, এটাই চাইছেন শীর্ষ নেতৃত্ব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE