Advertisement
E-Paper

ত্রাণ মেলেনি, খিদেয় কান্না থামছে না শিশুর

তাঁবুর ভিতরে মশার উপদ্রব। চাল-ডাল তো দূর, সামান্য মুড়িও নেই। ছোট মেয়েটা মাঝরাত্তিরে কঁকিয়ে উঠছে খিদের জ্বালায়। মায়ের দৃষ্টি শূন্য। দেড় বছরের মণিমালাকে খেতে দিতে পারেননি কিছু। এত রাত্তিরে পাশের তাঁবু থেকেই এক মুঠো মুড়ি জোগাড় করে আনলেন নামখানার মৌসুনির নীলিমাদেবী। সেটুকুই যত্ন করে মুখে তুলে দিলেন মেয়ের। তার পরে সারা রাত জেগে মেয়েকে ঘুম পাড়ানো। শরীরে আর জুত পাচ্ছেন না নীলিমা।

দিলীপ নস্কর

শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০১৪ ০০:২৫
ঘর হারিয়ে কোনও মতে মাথা গোঁজার ব্যবস্থা।

ঘর হারিয়ে কোনও মতে মাথা গোঁজার ব্যবস্থা।

তাঁবুর ভিতরে মশার উপদ্রব। চাল-ডাল তো দূর, সামান্য মুড়িও নেই। ছোট মেয়েটা মাঝরাত্তিরে কঁকিয়ে উঠছে খিদের জ্বালায়। মায়ের দৃষ্টি শূন্য। দেড় বছরের মণিমালাকে খেতে দিতে পারেননি কিছু। এত রাত্তিরে পাশের তাঁবু থেকেই এক মুঠো মুড়ি জোগাড় করে আনলেন নামখানার মৌসুনির নীলিমাদেবী। সেটুকুই যত্ন করে মুখে তুলে দিলেন মেয়ের। তার পরে সারা রাত জেগে মেয়েকে ঘুম পাড়ানো। শরীরে আর জুত পাচ্ছেন না নীলিমা।

টানা চার দিন ধরে এমনই চলছে। রবিবার রাতের ভরা কোটালে সেই যে ভেসে গেল খড়ের চাল, মাটির বাড়ি--- রাস্তায় এসে দাঁড়াতে হল পরিবারটিকে। সঙ্গের তাঁবু খাটানোর ত্রিপলটুকুর ভরসায়। এখনও সরকারি ত্রাণ এসে পৌঁছয়নি প্লাবনবিধ্বস্ত এলাকায়। এক দিকে জলোচ্ছ্বাসের শব্দ, আর এক দিকে মেয়ের কান্না। আর কত দিন এ ভাবে চলবে জানেন না নীলিমা।

শুধু তিনিই নন, এর উত্তর নেই মৌসুনি পঞ্চায়েত এলাকার হাজার হাজার বানভাসি মানুষের কাছে। জলের তলায় চলে গিয়েছে ভিটে মাটি। কেউ কেউ অবশ্য ভাগ্যবান। উঠে এসেছেন এলাকার পাকা বাড়ি বা কয়েকটি স্কুলে। তবে ঘরে খাবার নেই কারওরই। সকালে যারা পারছেন, বাজার থেকে সামান্য চাল ডাল কিনে আনছেন। কিন্তু তাতে কী, রান্না হবে কিসে? জ্বালানি নেই তাঁবুতে।

নামখানার বিডিও তাপস মণ্ডল অবশ্য দাবি করেছেন, এলাকায় ত্রাণ পাঠানো হয়েছে।

রবিবারের ভরা কোটালে নামখানা ব্লকের চিনাই নদীর প্রায় ১২ কিলোমিটার বাঁধ ভেঙে গিয়েছে। মৌসুনি পঞ্চায়েতের বাগডাঙা, কুসুমতলা এলাকার প্রায় ২৮ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। পঞ্চায়েত সূত্রে জানা গিয়েছে, নোনা জল ঢুকে ৮৩০৫ বিঘা কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৫৮১টি মাছের পুকুর ক্ষতিগ্রস্ত। ১০৬৮টি পরিবারের বাড়ি সম্পূর্ণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। ঘরভাসি মানুষ বেশির ভাগই আশ্রয় নিয়েছেন উঁচু রাস্তার উপর। জল নামলেও কোথায় যাবেন, জানেন না।

ফুঁসছে নদী। বুধবার তোলা নিজস্ব চিত্র।

জমা জলের কারণে এর মধ্যেই রোগ ছড়াতে শুরু করেছে। একেই পিছিয়ে পড়া এই এলাকার অধিকাংশ শিশু অপুষ্টির শিকার। তার উপর অর্ধাহারে, অনাহারে বাড়ছে ডায়েরিয়ার প্রকোপ। পরিস্রুত পানীয় জলেরও অভাব। যতটা কম খরচে চিকিৎসাটুকু পাওয়া যায়, তার জন্য গ্রামের মানুষ ভিড় করছেন হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে। সব মিলিয়ে দিশেহারা এলাকার বাসিন্দারা।

অবস্থা যে হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে তা স্বীকার করে নিচ্ছেন বাগডাঙা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক গুরুপদ মণ্ডলও। তাঁরও বক্তব্য, “এখনও পর্যন্ত কোনও ত্রাণ এসে পড়েনি এলাকায়। অনাহার তো রয়েইছে। তার সঙ্গে পানীয় জলেরও সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এই ভাবে চললে ম্যালেরিয়া, ডায়েরিয়ার প্রকোপ দেখা যাবে এলাকায়।”

চার দিন কেটে গেলেও এলাকায় এখনও সরকারি ত্রাণ না মেলায় ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন নিরাশ্রয় মানুষ। একটি প্রাথমিক স্কুলের ভবনে আশ্রয় নিয়েছেন মাসিদা বিবি, ভাস্কর মণ্ডল, গুরুপদ দিন্দারা। প্রশাসনের ভূমিকায় হতবাক তাঁরা। বললেন, “চার দিন ধরে আমরা এ ভাবে রয়েছি। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে এখনও ত্রাণ দেওয়া হল না আমাদের। বারবার বলা সত্ত্বেও ব্লক প্রশাসন বা পঞ্চায়েত থেকে কোনও উদ্যোগ করা হচ্ছে না।”

এলাকার প্রবীণদের দাবি, এই প্রথম এত বড় বিপর্যয় হল এলাকায়। যা ক্ষতি হয়েছে, তাতে হয়তো আগামী তিন চার বছর চাষাবাদ বা মাছ চাষ করা যাবে না।

এলাকায় গিয়েও দেখা যায়, কৃষিজমি কার্যত জলায় পরিণত হয়েছে। জলের তোড়ে নদীর মাছ জমির এসে মরে গিয়েছে। মরা মাছের গন্ধে তাঁবুর ভিতরে টেকাও দায় হয়ে গিয়েছে। বেড়েছে সাপের উপদ্রব।

মৌসুনি পঞ্চায়েতের সিপিএম প্রধান শেখ ইসমাইলের অভিযোগ, আয়লার সময়ে অনেক বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। প্রশাসনকে বারবার বলা সত্ত্বেও বাঁধ মেরামতের ব্যাপারে কোনও গুরুত্ব হয়নি। মাত্র এক কিলোমিটার বাঁধ নতুন করে তৈরি করা হয়েছিল। ইতিমধ্যেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে ১২ কিলোমিটার বাঁধ।

বুধবার বিকেলে এলাকায় যান প্রাক্তন সুন্দরবন উন্নয়নমন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়।
কিছু ত্রিপল বিলি করেন তিনি। ত্রাণ অমিল বলে অভিযোগ তুলে ক্ষোভ প্রকাশ
করে নিরাশ্রয় পরিবারগুলি। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বিষয়টি
নিয়ে কথা বলার আশ্বাস দেন কান্তিবাবু। —নিজস্ব চিত্র

বুধবার মৌসুনিতে নদীবাঁদ পরিদর্শন ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন প্রাক্তন মন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন কিছু ত্রিপল। সেগুলি বিলি করা হয়। বিকেলের দিকে, সামান্য কিছু খাবার এসে পৌঁছয় সরকারের তরফে। স্থানীয় বিধায়ক বঙ্কিম হালদার বলেন, “এলাকায় চাল, ডাল, চিঁড়ে পাঠানো হয়েছে।” পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি শ্রীমন্ত মালি বলেন, “আমরা নিরাশ্রয় পরিবারদের ত্রিপল পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। স্থানীয় পঞ্চায়েতকে বলা হয়েছে স্কুল বা পাকা বাড়িতে নিরাশ্রয়দের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে।

এ দিন কান্তিবাবু এলাকায় গেলে তাঁর কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। তাঁদের বক্তব্য, “জল নেমে গেলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব বলতে পারেন? কোনও ভাবে বাঁধ মেরামতি করা হলে আমরা অন্তত নিশ্চিন্ত হতে পারি।”

কান্তিবাবু অবশ্য তাঁদের আশ্বাস দিয়েছেন, সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে ক্ষতিগ্রস্তদের আশ্রয় ও ত্রাণের ব্যবস্থা করবেন। জেলা প্রশাসনকেও বিষয়টি জানাবেন। ক্ষতিগ্রস্তদের উদ্দেশে তাঁর পরামর্শ, “কোনও রাজনৈতিক রং না দেখে সবাই একত্রে ব্লক অফিসে গিয়ে ত্রাণের দাবি তুলুন।” ব্লক প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে, জল নেমে গেলেই বাঁধ মেরামতির কাজ শুরু হবে।

তবে তত দিন পর্যন্ত এই পরিবারগুলি কী ভাবে বাঁচবে, তা অবশ্য কেউ জানে না।

high tide no relief distress condition dilip naskar southbengal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy