খাতায় কলমে বেড়েছে দুগ্ধ সমবায় সমিতির সংখ্যা। কিন্তু তা সত্ত্বেও দক্ষিণ ২৪ পরগনার দুগ্ধ সমবায়, ‘সুন্দরবন মিল্ক ইউনিয়ন’-এ পর্যাপ্ত পরিমাণ দুধের জোগান মিলছে না। গত তিন বছরে দুধের জোগান কমছে একটু করে। জেলায় গরু পালনে অনীহা ক্রমশ বাড়ছে কৃষকদের মধ্যে। সমবায়ের কাছে পর্যাপ্ত দর না মেলায়, বেসরকারি সংস্থার কাছেও দুধ বিক্রির হার বাড়ছে।
১৫ মে থেকে অগস্টের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত দুধের মরসুম ধরা হয়। এই সময়ে বিভিন্ন দুগ্ধ সমবায়ে দুধের জোগান সব থেকে বেশি। কিন্তু সুন্দরবন দুগ্ধ সমবায় অন্যান্য বারের তুলনায় এ বার মাত্র এক তৃতীয়াংশ দুধ পেয়েছে বিভিন্ন ছোট সমিতিগুলি থেকে।
২০০৩ সালে জেলার যখন দুগ্ধ সমবায় চালু হয়েছিল, তখন এর অধীনে ৮৬টি দুগ্ধ সমবায় সমিতি নথিভুক্ত ছিল। কিন্তু ৩৫টির বেশি সমিতি থেকে দুধ পাওয়া যেত না। বর্তমানে নথিভুক্ত সমিতির সংখ্যা ৯২টি হলেও সক্রিয় ভাবে দুধ সরবরাহকারী সমিতির সংখ্যা নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৭-১৮টিতে। জেলার ২৯টি ব্লক থেকে দুধ আসার কথা থাকলেও, কেবলমাত্র কাকদ্বীপ, কুলপি, মথুরাপুর এবং জয়নগর থেকে আসা দুধের উপরে ভরসা করেই কার্যত চলছে সুন্দরবন মিল্ক ইউনিয়ন।
সুন্দরবন দুগ্ধ সমবায় সমিতির ম্যানেজিং ডিরেক্টর অমিতাভ সিংহ বলেন, “এই জেলায় সামগ্রিক ভাবে দুধের উৎপাদন কমে গিয়েছে। কারণ, কৃত্রিম প্রজনন না হওয়ার জন্য জার্সি গরুর অভাব রয়েছে। দেশি গরু থেকে উদ্বৃত্ত দুধ পাচ্ছেন না দুগ্ধ কৃষকেরা। দূর দূরান্ত থেকে এই সমবায়ের চিলিং প্লান্টে দুধ আনার ক্ষেত্রে দুর্বল পরিবহণ ব্যবস্থার জন্য অনেক সময়ে দুধ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।” অমিতাভবাবুর অভিযোগ, গো-সম্পদ বিকাশ প্রকল্পে কৃত্রিম গো-প্রজননের পাশাপাশি ১৭ জনের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। কৃত্রিম প্রজননের প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য তাঁদের নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু গত এক বছর ধরে সেই প্রস্তাবে আমল দেননি প্রাণিসম্পদ বিকাশ কর্তারা।
দুধের জোগান কমার ক্ষেত্রে জেলার প্রাণিসম্পদ দফতরের সহ অধিকর্তা তপন রায় অবশ্য কৃত্রিম প্রজননের থেকেও বেশি দায়ী করেছেন নগরায়ণকে। তাঁর কথায়, “কৃত্রিম প্রজনন প্রকল্প চালু রয়েছে। তা ঠিকঠাক কাজও করছে। তবে কলকাতা-লাগোয়া জেলা বলে মাঠ-ঘাট ক্রমশ কমছে। খাটাল সরছে। গরু প্রতিপালন দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে। প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো কোনও তালিকা ফেলে রাখার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন তিনি।
কৃষক এবং দুধ সংগ্রহকারীদের কাছ থেকে জানা গিয়েছে, গত কয়েক দশকে জেলায় দুগ্ধ উৎপাদনকারী গরুর সংখ্যা কমেছে। আরও বেশি পরিমাণে শঙ্কর প্রজাতির গরু তৈরি করা সম্ভব হয়নি। রাজ্য সরকার দক্ষিণবঙ্গে গীর প্রজাতির গরু পালনে উৎসাহ দেওয়ার নীতি নিয়েছে। এই প্রজাতির গরু তিন বছরের মাথায় দুগ্ধবতী হয়। কিন্তু দু’বছরের মাথায় যে চেহারা ধারণ করে, তাতে একজন দুগ্ধ কৃষক আরও এক বছর অপেক্ষা করে সেই দুধ বিক্রির চেয়ে মাংস উৎপাদনের জন্য বেশি লাভের আশায় গরু চড়া দামে বিক্রি করে দিচ্ছেন। তার মধ্যেও যে সমস্ত কৃষকেরা সমিতি গড়ে দুধ উৎপাদনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা সংগ্রহকারী নিয়োগ করে সরকারি দরে দুধ বিক্রি করে লাভের মুখ দেখতে পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ। যে কারণে একে একে বন্ধ হতে বসেছে গোসাবা, বাসন্তী, ডায়মন্ড হারবার, পাথরপ্রতিমা, সাগর, ফলতা, নামখানা, মগরাহাট, বারুইপুরের মতো এলাকার দুধ উৎপাদন।
কথা হচ্ছিল মথুরাপুর ২ ব্লকের দুগ্ধচাষি প্রভাত দাসের সঙ্গে। তিনি আগে ওই ব্লকেরই দুগ্ধ সমবায় ‘লক্ষ্মীশ্রী প্রগতি’র কাছে দুধ বিক্রি করতেন। তিনি বলেন, “বাইরে আমরা ২৩ টাকা লিটার এবং পরবের সময় ২৫ টাকা লিটারে দুধ বিক্রি করতে পারি। সমবায়কে দুধ দিতে যাব কেন?”
জানা গেল, সমবায় সমিতিতে সরকারি দর, লিটার পিছু ২০ টাকা। উৎসবের মরসুমে দর দেওয়া হয় লিটার-পিছু ২১ টাকা।
সুন্দরবন সমবায় সমিতির সঙ্গে দুধ উৎপাদনকারী এলাকাগুলির দূরত্ব অনেকটা হওয়ায় বিভিন্ন এলাকায় ‘বাল্ক কুলার’ বা দুধ ঠান্ডা রাখার মেশিন বসেছে। কিন্তু অনেক জায়গায় বসেওনি।
অভিযোগ, যে সব এলাকায় দুধের জোগান বেশি, সে সব জায়গায় এই মেশিন না বসিয়ে অপরিকল্পিত ভাবে বসানো হয়েছে তুলনায় কম উৎপাদক এলাকাগুলিতে। লক্ষাধিক টাকা খরচা করে বসানো যন্ত্র অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে ডায়মন্ড হারবার, নামখানা, পাথরপ্রতিমা, বাসন্তী এবং সাগরের মতো ব্লকে।
(চলবে)