Advertisement
E-Paper

মেয়েদের স্বনির্ভর করার শপথ সুনীতার

অন্ধ্রপ্রদেশে গুন্টুরের এক অখ্যাত শহর তেনালির নাম এখন হাবরা শহর সংলগ্ন ফুলতলার মানুষের মুখে মুখে। সৌজন্যে, ফুলত‌লার বৌ সুনীতা দাস। আদি বাড়ি তেনালিতে। পুরো নাম, এনামাদ্রি সুনীতা। ক্যারাটে ব্ল্যাক বেল্ট সুনীতা বিয়ে করেছেন ফুলতলার বাসিন্দা গৌতম দাসকে। সুনীতার জন্য অবশ্য এ পরিচয়টুকু যথেষ্ট নয়। অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারের মহিলাদের নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন বিভিন্ন স্বনির্ভর গোষ্ঠী। হাতে-কলমে কাজ শিখিয়ে তাঁদের অর্থনৈতিক ভাবে সাবলম্বী করেছেন। স্বামীর সঙ্গে এ মেয়েরা সংসারের হাল ধরছেন। ছেলেমেয়েদেরও পড়াচ্ছেন। সামাজিক পরিচয় খুঁজে পেয়েছেন।

সীমান্ত মৈত্র

শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৫ ০১:১৭
ঢেঁকিতে ছেঁটে মশলা তৈরির কাজ করছেন মহিলারা। হাবরায় তোলা নিজস্ব চিত্র।

ঢেঁকিতে ছেঁটে মশলা তৈরির কাজ করছেন মহিলারা। হাবরায় তোলা নিজস্ব চিত্র।

অন্ধ্রপ্রদেশে গুন্টুরের এক অখ্যাত শহর তেনালির নাম এখন হাবরা শহর সংলগ্ন ফুলতলার মানুষের মুখে মুখে। সৌজন্যে, ফুলত‌লার বৌ সুনীতা দাস। আদি বাড়ি তেনালিতে। পুরো নাম, এনামাদ্রি সুনীতা। ক্যারাটে ব্ল্যাক বেল্ট সুনীতা বিয়ে করেছেন ফুলতলার বাসিন্দা গৌতম দাসকে।

সুনীতার জন্য অবশ্য এ পরিচয়টুকু যথেষ্ট নয়। অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারের মহিলাদের নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন বিভিন্ন স্বনির্ভর গোষ্ঠী। হাতে-কলমে কাজ শিখিয়ে তাঁদের অর্থনৈতিক ভাবে সাবলম্বী করেছেন। স্বামীর সঙ্গে এ মেয়েরা সংসারের হাল ধরছেন। ছেলেমেয়েদেরও পড়াচ্ছেন। সামাজিক পরিচয় খুঁজে পেয়েছেন।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাটি উত্‌সবে অন্যতম মুখ এই সুনীতা। স্থানীয় বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, “সুনীতাদির সমাজসেবা আমাদের সকলের কাছে দৃষ্টান্ত। ঢেঁকির ব্যবহার করে যে আর্থিক ভাবে মহিলারা স্বনির্ভর হতে পারেন, তা সুনীতাদি দেখিয়ে দিয়েছেন। ওঁকে বলেছি, একটি রেশন দোকান দেব। যা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা চালাবেন।”

বহু প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে সাফল্য এসেছে। পারিপার্শ্বিক নানা চাপ তো ছিলই, দুষ্কৃতীদের হামলা সহ্য করতে হয়েছে সুনীতাকে। তবু নিজের লক্ষে অবিচল থেকেছেন। সুনীতার কথায়, “যখন দেখি মহিলারা অর্থনৈতিক ভাবে স্বনির্ভর হয়েছেন, মনটা শান্তিতে ভরে যায়।” তিনি বিশ্বাস করেন, বাংলার গরিব মেয়েদের মধ্যেও প্রচুর শক্তি আছে। তাঁরা রান্নার কাজ করেন, সংসার সামলাতে পারেন, সন্তান মানুষ করতে পারেন। নিজের পায়ে অর্থনৈতিক ভাবেও দাঁড়াতেও পারেন।

আর্থিক কারণে নবম শ্রেণির বেশি পড়াশোনার সুযোগ হয়নি সুনীতার। শিক্ষক বাবা এনামাদ্রি মুসালাইয়াকে ছোটবেলা থেকেই সমাজসেবার কাজে ব্যস্ত থাকতে দেখেছেন। তাঁর থেকেই পান অন্যের ভাল করার অনুপ্রেরণা। বাবার কাছেই শুনেছিলেন বিবেকানন্দ-রবীন্দ্রনাথের কথা। পরে একটু একটু করে পড়েছেন তাঁদের লেখা। বাবার শিক্ষায় দীক্ষিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন সমাজসেবায়। সুনীতার কথায়, “প্রত্যেক মানুষের দৈনন্দিন কাজের মতোই সমাজসেবা করা উচিত।”

সুদূর তেনালির সঙ্গে ফুলতলার যোগসূত্রটা তৈরি হল কী ভাবে?

১৯৮০ সালে বেঙ্গারুলুতে জাতীয় ক্যারাটের আসর বসেছিল। সেখানেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল হাবরার বাসিন্দা গৌতম দাসের। গৌতমবাবুও প্রতিযোগিতায় গিয়েছিলেন। সুনীতা সেখানে মহিলাদের ৬০ কেজি বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হন। গৌতম পুরুষদের ৬০ কেজি বিভাগে রানার্স হন। ব্ল্যাকবেল্ট সুনীতার সঙ্গে গৌতমবাবুর ঘনিষ্ঠতা বাড়ে এবং দু’জনে বিয়েও করেন। সুনীতার পরবর্তী ঠিকানা, এ রাজ্যের এক বিপিএল পরিবারভুক্ত পরিবারে।

বিয়ের পর স্বামীর ঘরে এসে প্রথম দিকে প্রতিবেশীদের উপহাসের পাত্র হন সুনীতা। তিনি বাংলা জানতেন না। চারপাশের মানুষজন তাঁকে এড়িয়ে চলত। মাটির ঘরে বসে দিনের পর দিন দিন কেঁদেছেন, জানিয়েছেন সুনীতা। গৌতমবাবু সে সময় পাশে থেকেছেন। সুনীতা বলেন, “ওই সময়ে খুব কষ্ট হত। পরে জেদ চেপে যায়। আদর্শলিপি এনে শ্লেট-পেনসিল দিয়ে বাংলা ভাষা শিখতে শুরু করি। নিজের চেষ্টায় অল্প কিছু দিনের মধ্যেই বাংলা ভাষা বলতে ও খবরের কাগজ পড়তে শিখলাম। ওই কাজে স্বামী আমাকে সাহায্য করেছেন।” নিজে শেখার পরে গ্রামের গরিব মহিলাদের শ্লেট-পেনসিল দিয়ে সই করানো শিখিয়ে তাঁদের স্বনির্ভর গোষ্ঠীতে নাম নথিভুক্ত করাতে শুরু করেন সুনীতা।


সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

২০০১ সালে এলাকার মহিলাদের নিয়ে তিনি তৈরি করেন ‘নিবেদিতা’ ও ‘মাতঙ্গিনী’ নামে দু’টি স্বনির্ভর গোষ্ঠী। পরবর্তী সময়ে ২০০৪ সালে ওই দু’টি গোষ্ঠীর অভাবনীয় সাফল্য জন্ম দেয় আরও বেশ কয়েকটি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর। গোষ্ঠীর মহিলাদের সুনীতা বিভিন্ন ধরনের রান্নার গুঁড়ো মশলা, বড়ি, আচার, পাঁপড় তৈরি করা শেখানোর ব্যবস্থা করেন। বাজারে সে সব ক্রেতার কাছে বেশ গ্রহণযোগ্যও হয়ে ওঠে। গুঁড়ো মশলার পাশাপাশি সুনীতা মহিলাদের নিয়ে জামা-কাপড় তৈরি, হাত ব্যাগ তৈরি করতেও শেখান। বর্তমানে ফুলতলা ছাড়িয়ে বৃহত্তর হাবরা, বর্ধমান-সহ গোটা পশ্চিমবঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সুনীতাদেবী একশোটির বেশি মহিলাদের স্বনির্ভর দল তৈরি করেছেন। গোটা রাজ্যে ঘুরে ঘুরে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে তিনি মহিলাদের কাছে গিয়ে প্রশিক্ষণ দেন। বর্তমানে সরকারি ভাবে তিনি উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় রান্নার মশলা তৈরি শেখানোর প্রশিক্ষক।

তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, ভাঙা টিনের ছাউনি দেওয়া ঘর। আর্থিক সঙ্গতির অভাব চতুর্দিকেই। যদিও সে দিকে হেলদোল নেই স্বামী-স্ত্রীর। গৌতমবাবু তাই হাসতে হাসতে বললেন, “আমরা তো আর মশলায় ভেজাল দিতে পারি না। তাই এই পরিস্থিতি। তবে এই দারিদ্র্য আমাদের অহঙ্কার।” সুনীতার একমাত্র ছেলে গৌরব এলাকায় কম্পিউটারের দোকান করেছেন। গ্রাফিক্সের কাজ করেন।

স্থানীয় বাসিন্দা গীতা হালদার, বিভা মাতব্বর, মিনতি মাতব্বর, সবিতা সিংহ, চন্দনা হালদারের মতো মহিলারা এখন মোটামুটি অর্থনৈতিক ভাবে স্বনির্ভর। তাঁদের সকলের কথায়, “সুনীতাদির জন্যই আমরা এখন ঘর থেকে বেরোতে পেরেছি। দিদির জন্যই আমরা অর্থনৈতিক ভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি।”

রোশেনারা বিবির স্বামী আলি মণ্ডল রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। ছেলে সুকুর আলি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। মেয়ে রেশমা এখন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। অভাবের সংসার রোশেনারার। বছর কয়েক আগে তাঁকে হাতে ধরে বাড়ি থেকে এনে রান্নার মশলা তৈরি করার কাজ শেখান সুনীতাদেবী। এখন বাড়িতে বসে ওই মশলা তৈরি করে সপ্তাহে ১৫০০-১৮০০ টাকা আয় করছেন বলে জানালেন রোশনারা। বললেন, “সবই সম্ভব হয়েছে দিদির জন্য।” সঞ্চিতা দাসের স্বামী কাপড়ের দোকানে কাজ করেন। দুই ছেলে-মেয়ে লেখাপড়া করে। এখন তিনি পঞ্চায়েতে একশো দিনের কাজের প্রকল্পে সুপারভাইজারের কাজ করছেন। সঞ্চিতা বললেন, “সুনীতাদির জন্য আজ আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে সম্মান নিয়ে বাইরের কাজও করছি। দিদি সব সময় বলতেন, ঘরে বসে থাকলে কোনও লাভ হবে না। উনি আমাকে বাইরে বেরিয়ে কাজ করার মতো মানসিক জোর দিয়েছেন।”

শ্যামলী দত্ত নামে এক মহিলাও সুনীতাদেবীর কাছে মশলার কাজ শিখে এখন স্বনির্ভর হয়েছেন। জানালেন, সপ্তাহে ১৫০০-২০০০ টাকা আয় হয়। মহিলারা বাড়িতে ঢেঁকিতে মশলা তৈরি করে প্যাকিং করে দিদির বাড়িতে পৌঁছে দেন। রাজ্য তথা ভারতের বিভিন্ন মেলাতে সেই মশলার স্টল দেওয়া হয়। সরকারও তাঁদের বিভিন্ন মেলায় পাঠায়। গৌতমবাবু তাঁর স্ত্রীর বৃহত্তর ওই কর্মকাণ্ডের অনেকটাই সামলান।

স্থানীয় মহিলাদের অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর করার পাশাপাশি সুনীতাদেবী সামাজিক কাজেও নিযুক্ত করেছেন নিজেকে। অসহায় দরিদ্রের চিকিত্‌সার ব্যবস্থা করা, বৃদ্ধদের চক্ষু চিকিত্‌সা করে চশমার ব্যবস্থা করা, বিনামূল্যে ছানি কাটানো, পোলিও আক্রান্ত শিশুর চিকিত্‌সার ব্যবস্থা করা এই সবই হাসিমুখে করে চলেছেন সুনীতা। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য রক্তদান শিবিরেরও আয়োজন করেন তিনি। চক্ষুদান শিবিরও করেছেন। পুলিশের সাহায্য নিয়ে এলাকায় মদের ঠেক ও মদ বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন। সকলের ভাল হয় এমন আরও হাজার রকমের কাজের জন্য দিনে-রাতে এক পায়ে খাড়া এনামাদ্রি সুনীতা দাস।

২০০১ সালে দূরদর্শনে স্বর্ণ জয়ন্তী গ্রাম স্বরোজগার যোজনার অধীন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর একটি অনুষ্ঠান দেখে তিনি স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরিতে উদ্যোগী হয়েছিলেন বলে জানালেন। ২০০৩ সালে এলাকায় বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করে আর্সেনিক মুক্ত পানীয় জলের পাম্পসেট বসিয়েছিলেন সুনীতা। কিন্তু দুষ্কৃতীরা সেই সময়ে তা বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছিল। তবুও অকুতোভয় সুনীতা। বলেন, “আমি মরার ভয় পাই না। কারণ একটা সুনীতা মরে গেলে স্বনির্ভর গোষ্ঠী থেকে হাজার হাজার সুনীতা জন্ম নেবে।”

২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁর উপরে দুষ্কৃতী হামলা হয়। দু’বার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন। তবু তাঁর লড়াইটা কিন্তু জারি আছে। ইতিমধ্যে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন জায়গা থেকে স্বীকৃতি, সম্মান এসেছে। ইদানীং তিনি জড়িয়ে রয়েছেন বিশ্বব্যাঙ্কের ন্যাশনাল রুরাল লাইভলিহুড মিশনের (এনআরএলএম) ‘আনন্দধারা’ প্রকল্পর কাজে, মালদহে। সেখানে দশটি গ্রামে অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে আসা গবেষকদের দোভাষীর কাজ করছেন।

তাঁর কথায়, “কারও কোনও বিপদ হলে সে চলে এল সুনীতার কাছে। এই ভরসার তো একটা দাম আছে। সমস্যাগুলো তো আমাদেরই আশপাশের মানুষজনের। এড়িয়ে চলা যায় কি? তা হলে তো বাঁচারই কোনও মানে হয় না।”

e sunita sunita das self help group habra simanta moitra southbengal amar shohor
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy