Advertisement
E-Paper

শিল্পের কী হবে? প্রশ্ন শহরবাসীর

শহর ঝাঁ চকচকে হয়েছে বটে কিন্তু প্রদীপের নীচে অন্ধকার জমেছে বিস্তর। পুরবাসীর অন্যতম ক্ষোভ স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে। এলাকায় একটি স্টেট জেনারেল হাসপাতাল আছে বটে, কিন্তু সেখানকার পরিষেবা নিয়ে অভিযোগ ভুরি ভুরি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার টাকায় কেনা যন্ত্রপাতি বাক্সবন্দি হয়ে দীর্ঘদিন পড়ে রয়েছে। অথচ অপারেশন থিয়েটারই নেই এই হাসপাতালে। দীর্ঘদিন অব্যবহারের ফলে যন্ত্রপাতির যে কী হাল, তা কেউ জানেন না। আলট্রা সনোগ্রাফি মেশিন শেষ কবে এখানে ব্যবহার হয়েছিল, তা মানুষ ভুলে গিয়েছেন। শয্যা সংখ্যা মাত্র ৫০টি। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।

সীমান্ত মৈত্র

শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০১৪ ০২:১০
জীর্ণ দশায় কল্যাণী স্পিনিং মিল। ছবি: শান্তনু হালদার।

জীর্ণ দশায় কল্যাণী স্পিনিং মিল। ছবি: শান্তনু হালদার।

শহর ঝাঁ চকচকে হয়েছে বটে কিন্তু প্রদীপের নীচে অন্ধকার জমেছে বিস্তর।

পুরবাসীর অন্যতম ক্ষোভ স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে। এলাকায় একটি স্টেট জেনারেল হাসপাতাল আছে বটে, কিন্তু সেখানকার পরিষেবা নিয়ে অভিযোগ ভুরি ভুরি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার টাকায় কেনা যন্ত্রপাতি বাক্সবন্দি হয়ে দীর্ঘদিন পড়ে রয়েছে। অথচ অপারেশন থিয়েটারই নেই এই হাসপাতালে। দীর্ঘদিন অব্যবহারের ফলে যন্ত্রপাতির যে কী হাল, তা কেউ জানেন না। আলট্রা সনোগ্রাফি মেশিন শেষ কবে এখানে ব্যবহার হয়েছিল, তা মানুষ ভুলে গিয়েছেন। শয্যা সংখ্যা মাত্র ৫০টি। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। বাধ্য হয়েই এলাকাবাসীকে সামান্য প্রয়োজনেও হাবরা স্টেট জেনারেল হাসপাতাল বা বারাসত জেলা হাসপাতালে রোগীকে নিয়ে ছুটতে হয়। এলাকার তৃণমূল বিধায়ক ধীমান রায় অবশ্য বলেন, “তিন বছরে হাসপাতালের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। সব সময়ের জন্য জেনারেটরের ব্যবস্থা হয়েছে। চিকিৎসকের সংখ্যা বেড়েছে। ৩০ অগস্ট হাসপাতালে ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান চালু হয়েছে।” মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং অপারেশন থিয়েটার চালুর আশ্বাস দিয়েছেন বলেও জানিয়েছেন ধীমানবাবু।

পুরসভা পরিচালিত হাসপাতাল প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতী সেবাসদন ২০০৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর উদ্বোধন করেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ২০১১ সালের ৩১ জানুয়ারি বারাসতের সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদার এখানে চক্ষু ও দন্ত বিভাগের উদ্বোধন করেছেন। পুরসভা সূত্রে জানানো হয়েছে, এখানে ৩০টি শয্যা রয়েছে। ২৪ ঘণ্টা ওষুধের দোকান খোলা থাকে। নানা অস্ত্রোপচারও হয়। তবে সে জন্য যে খরচ ধার্য করা হয়েছে, তা সরকারি হাসপাতালের থেকে অনেকটাই বেশি। পুরপ্রধান সমীর দত্ত অবশ্য দাবি করেছেন, ন্যূনতম খরচে চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া হয়। গরিব মানুষের জন্য ছাড়ের ব্যবস্থাও আছে।

পানীয় জল, রাস্তা, বিদ্যুৎ নিয়েও ক্ষোভ আছে নানা এলাকায়। আর আছে কর্মস্থানের দাবি। নতুন কোনও শিল্প কারখানা এখানে বহু বছর ধরে গড়ে ওঠেনি। যা ছিল, তারও বেশির ভাগ বন্ধ হয়ে গিয়েছে বা হওয়ার মুখে। ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখানে এক জনসভায় এসে অভিযোগ করেছিলেন, বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পরে অশোকনগরে বহু কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। নতুন একটাও গড়ে ওঠেনি। মমতা মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন তিন বছরেরও বেশি। পরিস্থিতি কিন্তু যে কে সেই।

চুন তৈরির কারখানা রাধা কেমিক্যালস বহু দিন হল বন্ধ। সেই জমিতে এখন তৈরি হয়েছে বিবেকানন্দ কলেজ অফ ম্যানেজমেন্ট এবং সেন্ট ফ্রান্সসিস স্কুল। জামাকাপড়, কাঠের সরঞ্জাম ও পুতুল তৈরির কারখানা রিহ্যাবিলিটেশন ইন্ডাস্ট্রিয়াল কর্পোরেশন বা আরআইসি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কল্যাণী স্পিনিং মিলের সুতোর চাহিদা কমেছে বাজারে। যন্ত্রপাতি পুরনো হয়ে গিয়েছে। কর্মীরা ঠিক মতো বেতন পান না। এক কথায়, কারখানাটি ধুঁকছে। কিছু দিন আগেও বেতনের দাবিতে কর্মীরা থালা-বাটি নিয়ে যশোহর রোড অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন। বন্ধ আরআইসি-র এক কর্মী বলেন, “২০০০ সাল নাগাদ আরআইসি বন্ধ হয়ে যায়। উদ্বাস্তু পরিবারের শ’তিনেক মহিলা এখানে কাজ করতেন। ১৯৯৫ সালে অনেকে স্বেচ্ছাবসর নিয়েছিলেন।” সেলাই কারখানা নিউ প্রোডাকশন সেন্টারও ধুঁকছে।

অশোকনগরের প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক সত্যসেবী করের দাবি, “আমাদের সময়ে কল্যাণী স্পিনিং মিলের কর্মীরা ঠিক মতো বেতন পেতেন। এখন পরিস্থিতি বদলেছে।” সত্যসেবীবাবু জানালেন, কয়েক মাস আগে বাজেট বক্তৃতায় শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র ঘোষণা করেছিলেন, কল্যাণী স্পিনিং মিলে দেড়শো কোটি টাকা ব্যয়ে একটি ইনটিগ্রেটেট পাওয়ার লুম পার্ক তৈরি করবে রাজ্য। সে জন্য অর্থও মঞ্জুর করেছিলেন তিনি। কিন্তু তারপর আর কোনও উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। কর্মীরা অনিশ্চিতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। ধীমানবাবু অবশ্য জানিয়েছেন, মিলের কর্মীদের রাজ্য সরকারের অন্য দফতরে বদলি করা হবে। এই পাওয়ার লুম পার্ক তৈরির জন্য ইতিমধ্যেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও সরকারি আধিকারিকদের নিয়ে বৈঠক হয়ে গিয়েছে। কাজ শুরু হবে।

শহরের মানুষের আর একটা বড় অভিযোগ আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে। দিনে-রাতে বোমাবাজি, গুলি চলার ঘটনায় মানুষ কার্যত অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। এক ব্যবসায়ী বললেন, “বাম আমল বা তৃণমূল আমল সব সময়ে একটা বিষয় এখানে একই থেকেছে। তা হল, দুষ্কৃতীদের বাড়বাড়ন্ত। চুরি-ছিনতাই-কেপমারি-তোলাবাজির ঘটনা লেগেই আছে। রাজনৈতিক দলের মদতে দুষ্কৃতীরা ফুলে ফেঁপে উঠেছে বলেও অভিযোগ। এমনও দেখা যাচ্ছে, কোনও দুষ্কৃতী গ্রেফতার হওয়ার পরে তাকে ছাড়াতে নেতারা থানায় যাচ্ছেন বা ফোন করছেন। নিরাপত্তা বলে আমাদের কিছু নেই।” ব্যাঙ্ক থেকে পেনশনের টাকা তুলতে যেতে আতঙ্কে থাকেন বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা। কেপমারেরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়। কেউ নতুন জমি-বাড়ি কিনলে বা বিক্রি করলে তাঁকে ‘তোলা’ দিতেই হবে, এ যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। বাইরের দুষ্কৃতীরা এসে স্থানীয় মস্তানদের কাছে আশ্রয় নেয়। খুব প্রয়োজন ছাড়া মানুষ রাতে বের হন না। কচুয়া মোড়ে এক হোটেল মালিক তোলা না দেওয়ায় তাঁর হোটেলে ঢুকে গুলি-বোমা চালান হয় কিছু দিন আগেই। প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে দুষ্কৃতীদের দেখতেও অভ্যস্ত শহরবাসী।

সত্যসেবীবাবু বলেন, “সিপিএমের সময়ে দুষ্কৃতীরা ছিল না, এটা বলব না। কারণ, সমাজ থাকলে সমাজবিরোধীরাও থাকবে। কিন্তু সে সময়ে দুষ্কৃতীরা অন্ধকারে থাকত। আর এখন প্রকাশ্য রাজপথে দিনের বেলায় ঘুরছে।” ধীমানবাবু বলেন, “দুষ্কৃতীদের কারা আশ্রয় দিচ্ছে, তা এলাকার মানুষ জানেন। আমাদের কারও সঙ্গে দুষ্কৃতীদের কোনও সম্পর্ক নেই।” সব পক্ষ দায় এড়ালেও বাস্তব ঘটনা হল, দুষ্কৃতীদের তাণ্ডব কিন্তু অব্যাহত।

সিপিএমের দাবি, এলাকার যা উন্নয়ন হয়েছে, তা তাদের আমলেই হয়েছে। এলাকার মানুষও স্বীকার করছেন, বামেদের আমলে এলাকার ভোল বদলেছে অনেকটাই। সিপিএমের দাবি, তারা করে যাওয়ার পরে বর্তমান তৃণমূল পরিচালিত পুরবোর্ড পানীয় জলের লাইন আর সম্প্রসারণ করেনি। এমনিতে জলের সংযোগ পাওয়া না গেলেও দালালদের টাকা দিলে দ্রুত মিলে যায় বলেও অভিযোগ। নতুন রাস্তাঘাট সে ভাবে হয়নি। তবে পুরনো কিছু রাস্তা সংস্কার হয়েছে।

অশোকনগরের প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক তথা পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান শর্মিষ্ঠা দত্তের অভিযোগ, “ত্রিফলা আলো ও সিগন্যাল ব্যবস্থা ছাড়া কোনও উন্নয়ন বর্তমান তৃণমূল পরিচালিত পুরবোর্ড করতে পারেনি। সিগন্যালে আবার গাড়ি দাঁড়ায় না। আমরা যে উন্নয়ন করেছিলাম, তা এই সময়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।” শর্মিষ্ঠাদেবী জানান, নৈহাটি সড়কের পাশে ডাম্পিং গ্রাউন্ড তৈরির জন্য জমি কেনা হয়েছিল। বর্তমান পুরবোর্ড তা বিক্রি করে দিয়েছে। হার্টের চিকিৎসার জন্য পিপিপি মডেলে মাতৃসদন সেবা হার্ট ইউনিট তৈরির উদ্যোগ করা হয়েছিল। সেখানে জঙ্গলে ভরে গিয়েছে। চেয়ারম্যান সমীর দত্ত আবার পুরনো পুরবোর্ডের সমালোচনা করে বলেন, “ওরা উদ্বোধন করেই ছেড়ে দিয়েছিল। ধরে রাখতে পারেনি। শহরকে আলোয় সাজিয়েছি। রাস্তা করেছি। সিগন্যাল ব্যবস্থা করেছি। ওদের উদ্বোধন করা প্রকল্পগুলি আমরা রক্ষণাবেক্ষণ করছি এবং তার আরও উন্নতি করেছি। নিকাশি ব্যবস্থার জন্য মাস্টার প্ল্যান তৈরি করা হয়েছে। শহরকে হেরিটেজ ঘোষণা করার জন্য জেলাশাসকের কাছে দাবি করা হয়েছে।”

উন্নয়নের কৃতিত্ব নিয়ে এই চাপান-উতোর চলতেই থাকবে। তবু তারই মধ্যে ধীরে ধীরে ভোল বদলাচ্ছে উদ্বাস্তু কলোনি হিসাবে গড়ে ওঠা অশোকনগর -কল্যাণগড়।


(শেষ)

amar shohor simanta moitra ashoke nagar kalyangarh southbengal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy