Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

স্থানীয় সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না দলগুলি, হতাশ বনগাঁর ভোটাররা

কেউ বলছেন কেন্দ্রের সরকার কতটা খারাপ, কী কী কারণে ব্যর্থ, কী কী প্রতিশ্রুতিপূরণের সদিচ্ছা নেই তাদের। আরও বলছেন, সারদা কেলেঙ্কারিতে আদৌ জড়িত নন তাঁরা, রাজ্য জুড়ে উন্নয়নের তুফান তুলেছেন তাঁরাই, দিল্লির নেতারা ক’দিন বাদে হেরে ভূত হয়ে কেমন করে এলাকা ছাড়বেন ইত্যাদি ইত্যাদি। কেউ আবার সারদা নিয়ে পাল্টা দুষছেন অন্য দলকে। তাঁরা বলছেন, রাজ্যে গণতন্ত্র নেই, শান্তি নেই, আইনের শাসন নেই।

গাইঘাটা থেকে কলাসিমা যেতে যশোহর রোডের হাল।

গাইঘাটা থেকে কলাসিমা যেতে যশোহর রোডের হাল।

সীমান্ত মৈত্র
বনগাঁ শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:০১
Share: Save:

কেউ বলছেন কেন্দ্রের সরকার কতটা খারাপ, কী কী কারণে ব্যর্থ, কী কী প্রতিশ্রুতিপূরণের সদিচ্ছা নেই তাদের। আরও বলছেন, সারদা কেলেঙ্কারিতে আদৌ জড়িত নন তাঁরা, রাজ্য জুড়ে উন্নয়নের তুফান তুলেছেন তাঁরাই, দিল্লির নেতারা ক’দিন বাদে হেরে ভূত হয়ে কেমন করে এলাকা ছাড়বেন ইত্যাদি ইত্যাদি। কেউ আবার সারদা নিয়ে পাল্টা দুষছেন অন্য দলকে। তাঁরা বলছেন, রাজ্যে গণতন্ত্র নেই, শান্তি নেই, আইনের শাসন নেই। কেউ আবার অন্য সব দলের সমালোচনা করে নানা তাত্ত্বিক আলোচনায় ব্যস্ত। এখনও ‘ভুল স্বীকার’-এর পালা শেষ হয়নি তাদের। আবার কেউ নিজেদের ঘরোয়া কোন্দলে এমনই জর্জরিত, প্রচারে তেমন জোরই নেই। তার উপরে কে কত মতুয়া-ঘনিষ্ঠ তা প্রমাণের দায় আছে সকলেরই। বড়মা কাকে আশীর্বাদ দিলেন, কাকে দেবেন দেবেন করেও দেননি, কাকে ঘরে ডেকে দিলেন, কাকে বাইরে বসিয়ে এ সব প্রমাণের চাপানউতোরও তো আছেই।

সব মিলিয়ে প্রচারে ঘুরে ফিরে এমনই নানা প্রসঙ্গ উঠে আসছে বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন ঘিরে। এ সব নিয়েই যেন বেশি ব্যস্ত রাজনৈতিক দলগুলি। কিন্তু স্থানীয় মানুষের বক্তব্য, এলাকার উন্নয়ন নিয়ে কে কী ভাবছেন, সে সব নিয়ে আরও দু’কথা বেশি খরচ করলে ভাল হত।

আর মাত্র কয়েকটা দিন পরেই, ১৩ ফেব্রুয়ারি বনগাঁয় ভোট। সাধারণ মানুষ মাইকে নেতাদের ভাষণ শুনতে শুনতে ক্লান্ত। কয়েক মাস আগেই এই সব নেতা-নেত্রীরাই অধিকাংশ এসে প্রচার সেরেছিলেন। প্রচুর প্রতিশ্রুতি ছিল বনগাঁকে ঘিরে। তারপর থেকে জীবনযাত্রার মান কিছু এগোলো কি, এমন অস্বস্তিকর প্রশ্ন বারবারই ঘুরে ফিরে আসছে বনগাঁবাসীর মাথায়।

ইছামতীর পূর্ণাঙ্গ সংস্কার হবে কবে, প্রশ্ন বনগাঁবাসীর।

ইছামতী নদীর পূর্ণাঙ্গ সংস্কার যেমন স্থানীয় মানুষের বহু কালের দাবি। বনগাঁ মহকুমায় নদী এখন মৃতপ্রায়। কচুরিপানায় মুখ ঢেকেছে। কেন্দ্র ও রাজ্যের পক্ষ থেকে বিক্ষিপ্ত ভাবে কয়েক বার সংস্কার হলেও পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের অভাবে নদী প্রতিদিনই প্রাণ হারাচ্ছে একটু একটু করে। নির্বাচনের আগে সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দোপাধ্যায় বনগাঁয় এসে কচুরিপানা তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছেন। ইছামতীর উৎসমুখ নদিয়ার পাবাখালিতেও সংস্কারের দাবি রয়েছে। কিন্তু পারস্পরিক রাজনৈতিক চাপানউতোরে ব্যস্ত রাজনৈতিক দলগুলি এ সব নিয়ে আদৌ ভাবিত তো, ভাবতে হচ্ছে ভোটারদের।

বেহাল যশোহর রোড বা ৩৫ নম্বর জাতীয় সড়ক নিয়েও ক্ষোভ আছে বিস্তর। রয়েছে আর্সেনিক দূষণের সমস্যা। বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের সর্বত্র কাঁটাতার না থাকা নিয়েও বহু অভিযোগ আছে। যে কারণে রাতের অন্ধকারে বাংলাদেশ থেকে দুষ্কৃতীরা ঢুকে চুরি-ডাকাতি করে পালিয়ে যাচ্ছে সীমান্তবর্তী গ্রামে। কিছু দিন আগে বাগদার কুলিয়া গ্রামে বাংলাদেশি দুষ্কৃতীরা ঢুকে ডাকাতি করে পালিয়ে যায়। গাইঘাটার আংরাইলে বাংলাদেশি দুষ্কৃতীরা এক আরপিএফ জওয়ানকে খুন করে গিয়েছে। অবাধে চলছে পাচার। সীমান্তের মানুষের বিএসএফ জওয়ানদের ভূমিকাতেও ক্ষুব্ধ। তাঁদের কথায়, “বছরের পর বছর ভোট দিয়েই চলেছি। কাঁটাতার পড়ছে না। বাংলাদেশি দুষ্কৃতীদের জন্য বসবাস করা কঠিন হয়ে উঠেছে। অথচ নেতাদের সে দিকে লক্ষ্য নেই।”

বিধানচন্দ্র রায়ের আমলে তৈরি কল্যাণী শিল্প নগরী আজ অন্ধকারে ডুবে গিয়েছে। বহু কারখানা বন্ধ। বহু মানুষ কর্মহীন হয়েছেন। কর্মসংস্থানের অভাব রয়েছে। সেখানকার মানুষ চাইছেন বন্ধ কল-কারখানা ফের চালু হোক। কল্যাণী ফের রাজ্যের শিল্প মানচিত্রে তার অতীত গরিমা ফিরে পাক। এখানকার মানুষের ক্ষোভ রয়েছে প্রস্তাবিত এইমস তৈরি না হওয়া নিয়েও। অতীতে কল্যাণী পর্যন্ত মেট্রো চালুর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। সেই প্রকল্প বিশ বাঁও জলে।

হরিণঘাটার মানুষ চান দুগ্ধ প্রকল্পের আধুনিকরণ ও একটি দুগ্ধ গবেষণাগার। এই বিধানসভার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক। জমি ও অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণের দাবি না মেটায় ওই জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণে গতি আসেনি। এলাকার মানুষ চাইছেন, দ্রুত সমস্যা মিটিয়ে কাজ শেষ করা হোক। তা হলে নদিয়া জেলার একটা বড় অংশের মানুষের সড়ক পথে কলকাতায় যাতায়াত সহজ হবে। সময়ও অনেক কম লাগবে।

যশোহর রোড বা ৩৫ নম্বর জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের দাবি দীর্ঘ দিনের। ওই রাস্তায় দুর্ঘটনায় মৃত্যু বা জখম হওয়াটা নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংকীর্ণ সড়কে বেপরোয়া ভাবে গাড়ি চলাচল তার প্রধান কারণ। গুরুত্বপূর্ণ ওই সড়কের দু’ধার জবর-দখল করে তৈরি হয়েছে দোকানপাট। হাবরা ও বনগাঁর কুখ্যাত যানজটে পড়ে দীর্ঘক্ষণ নাকাল হওয়াটাও মানুষের গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। বিশেষ করে বারাসতের পর থেকে পেট্রাপোল সীমান্ত পর্যন্ত ৬২ কিলোমিটার অংশে সড়কের অবস্থা ভয়াবহ আকার নিয়েছে। পেট্রাপোলে সীমান্ত বাণিজের জন্য বহু পণ্য-বোঝাই ভারি ট্রাক এই রাস্তায় যাতায়াত করে। বাসিন্দাদের বক্তব্য, রাজনৈতিক দলগুলি ভোট হারানোর ভয়ে জবরদখল সরানোয় উদ্যোগী হয় না। বাম আমলে মানুষের দাবি মেনে বারাসত থেকে পেট্রাপোল পর্যন্ত যশোহর রোডের বিকল্প রাস্তা ইস্ট-ওয়েস্ট করিডরের জন্য জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয়েছিল। সাড়ে ৬২ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২৭ মিটার চওড়া বিকল্প রাস্তার জন্য ২০০৫ সালের ডিসেম্বর মাসে জমি মাপজোকের কাজও শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তালিকাভুক্ত ছিল বিকল্প রাস্তাটি। কিন্তু চাষিদের বাধা ও কয়েকটি রাজনৈতিক দলের অসহযোগিতায় কাজ আর হয়নি। বাসিন্দাদের বক্তব্য, সে সব প্রসঙ্গ প্রচারে তেমন ভাবে আসছে কই?

জেলার আরও একটি বড় সমস্যা আর্সেনিক দূষণ। আর্সেনিক দূষণ প্রতিরোধ কমিটির দাবি, জেলার ২২টি ব্লকই কমবেশি আর্সেনিক দূষণের সমস্যা রয়েছে। প্রথম সারিতে রয়েছে গাইঘাটা ব্লক। ১৯৯৮ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত এই ব্লকে আর্সেনিক দূষণের কারণে মারা গিয়েছেন ১৭ জন। মূলত সকলেই মারা গিয়েছেন ক্যান্সারে। ওই সময়ের মধ্যে গোটা জেলায় মারা গিয়েছেন প্রায় আড়াইশো জন। জেলায় অসুস্থ হাজার দু’য়েক মানুষ। কমিটির রাজ্য সম্পাদক অশোক দাস বলেন, “আর্সেনিক দূষণের সমস্যার সমাধানের কথা বলে বিদেশ থেকে কোটি কোটি টাকা আনা হয়েছে। কিন্তু ওই টাকা দিয়ে অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়নি। ফাইভ স্টার হোটেলে নানা সেমিনার হয়েছে। কিন্তু সমস্যা মেটেনি। সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিরই গণ্ডগোল রয়েছে।”

এ সব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলি বেশি মাথা ঘামালে তাঁরা খুশি হতেন, এমনটাই বলছেন বনগাঁর ভোটাররা। এ ছাড়াও আছে বনগাঁ শহরের যানজট সমস্যা, মজে যাওয়া যমুনা নদী ও গোবরডাঙায় টাউনহল তৈরির কাজ শেষ না হওয়া নিয়ে ক্ষোভ। কৃষিপ্রধান বাগদা এলাকায় সরকারি কোনও হিমঘর নিয়েও মানুষের চাহিদা আছে।

প্রার্থী ও রাজনৈতিক নেতাদের অবশ্য দাবি, তাঁরা সমস্যাগুলি প্রচারে তুলে ধরছেন। কিন্তু মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে, সবই নাম কা ওয়াস্তে। সমাধানের আগ্রহ তার পিছনে কতটুকুই বা!

নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

icchamati river simanta moitra bangaon
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE