Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
নৈহাটি

স্থায়ী মঞ্চে সারা বছর ধরে চলে অভিনয়

১৮৬২ সালে তৈরি হওয়া স্টেশনের ফলকে লেখা, ‘সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও বন্দেমাতরম-এর জন্মভূমি’। যে দিন কলকাতা থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত প্রথম ট্রেন চালু হল, এই স্টেশনে ট্রেন থেমেছিল বেশ কিছু ক্ষণ। শোনা যায়, সে দিন রেলগাড়ি দেখতে ভিড় উপচে পড়েছিল।

উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের ফলে এখনও এই চেহারায় আছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িটি।

উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের ফলে এখনও এই চেহারায় আছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িটি।

বিতান ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:২১
Share: Save:

১৮৬২ সালে তৈরি হওয়া স্টেশনের ফলকে লেখা, ‘সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও বন্দেমাতরম-এর জন্মভূমি’। যে দিন কলকাতা থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত প্রথম ট্রেন চালু হল, এই স্টেশনে ট্রেন থেমেছিল বেশ কিছু ক্ষণ। শোনা যায়, সে দিন রেলগাড়ি দেখতে ভিড় উপচে পড়েছিল।

আরও একবার ভিড় জমেছিল নৈহাটি স্টেশনে। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় ‘আনন্দময়ীর আগমন’ কবিতাটি প্রকাশের জন্য হাজতবাস হয় কাজি নজরুল ইসলামের। পরাধীন ভারতে ১৯২৩ সালে কবিকে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে হুগলি জেলে নিয়ে যাওয়ার পথে নামানো হয়েছিল নৈহাটি স্টেশনে। কয়েদির পোশাকে, কোমরে দড়ি বাঁধা কবিকে দেখতে সে দিনও অশ্রুসজল চোখে ভিড় করেছিলেন বহু মানুষ।

প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী জনপদ নৈহাটি। সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাস খুঁজলেও নৈহাটি রীতিমতো রত্নগর্ভা। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তাঁর দাদা সঞ্জীবচন্দ্র, অনুশীলন সমিতির জন্মদাতা ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্র, চর্যাপদের আবিষ্কর্তা, বিখ্যাত ভাষাবিদ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, সাহিত্যিক সমরেশ বসু, কিংবদন্তী গায়ক-সুরকার শ্যামল মিত্রের জন্ম নৈহাটিতেই। এ ছাড়াও তালিকাটি সমৃদ্ধ করেছেন কবি খগেন্দ্রনাথ ঘোষ, বিনয়তোষ ভট্টাচার্য, গিরিজাপতি ভট্টাচার্যেরা। হালফিলের গায়ক রাঘব চট্টোপাধ্যায়ও নৈহাটির বাসিন্দা। ভারতের প্রথম শ্রমিক নেত্রী, যাঁর হাত ধরে ‘শ্রমিক’ পত্রিকার আত্মপ্রকাশ, সেই সন্তোষকুমারী গুপ্তর শিকড়ও নৈহাটিতে। সন্তোষকুমারীর মা নগেন্দ্রকুমারী নৈহাটিতে প্রথম নারীশিক্ষার প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা নেন। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ১৮৯০ সালে গরিফায় নগেন্দ্রকুমারীর বিয়েতে ‘আনন্দমঠ’ বইটি উপহার দিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। সঙ্গে উপদেশ দিয়েছিলেন, “সংসারের কাজকর্ম ছাড়াও গরিব-দুঃখীদের সেবা করা ও নারীকল্যাণ ব্রত নিলে তোমার লেখাপড়া শেখা সার্থক হবে।”


এই বাড়িতেই থাকতেন শ্যামল মিত্র। যা বিক্রি হয়ে গিয়েছে।

এই সব বরেণ্য মানুষের জীবনের নানা কথা ইতিহাসের বইতে জায়গা পেলেও তাঁদের স্মৃতি সংরক্ষণে তেমন কোনও উদ্যোগ কারও কখনও চোখে পড়েনি। বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়ি ছাড়া হেরিটেজের তকমা দূরঅস্ৎ, ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণই হয়নি বহু জিনিস। অধিকাংশের উত্তরসূরিরা বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন। নয় তো ফ্ল্যাট উঠেছে ইতিহাসের আকর এই বাড়িগুলি ভেঙেচুরে। খোদ হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর বাড়িরই একটা অংশে উঠেছে ঝাঁ চকচকে বহুতল। বিক্রি হয়ে গিয়েছে শ্যামল মিত্রের বাড়ি।

তবে শিল্প-সংস্কৃতির পরিমণ্ডলটুকু আজও অমলিন এই শহরে। বন্ধ কলকারখানার শ্মশান আগলেই নৈহাটিতে গান-বাজনা, নাটক, সিনেমা নিয়ে আগ্রহ আছে মানুষের। রং-আলো-শব্দ-সুরে এখনও প্রাণবন্ত এই শহর।

অভিনয়ের নেশা এ শহরের মজ্জায় মজ্জায়। উৎপল দত্ত, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায় নৈহাটিতে নাটকের টানে একাধিকবার এসেছেন এই সব দিকপাল অভিনেতা-নাট্যকারেরা। এখনও মনোজ মিত্র, ব্রাত্য বসু, চন্দন সেনরা নৈহাটির দর্শকের টানে নিজেদের দল নিয়ে আসেন। শুধু নৈহাটি শহরেই ১৯টি নাটকের দল আছে। এই মাল্টিপ্লেক্সের যুগেও কলকাতা থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরের এই শহরে সারা বছর ধরে নাট্য মেলার আয়োজন করে এই দলগুলি। যার শুরুর দিকে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন সমরেশ বসু ও তাঁর স্ত্রী গৌরীদেবী। তাঁদের মাইকেল নাটকে সমরেশ বসু নিজে অভিনয় করেছিলেন। নাটকের নানা ‘ফর্ম’ নিয়েও চলত তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা। সিধু গঙ্গোপাধ্যায়ের নবাব সিরাজদ্দৌলার অভিনয়, নৈহাটির পুরনো নাট্যপ্রেমীদের মনে আছে। ব্রজগোপাল চক্রবর্তীও ছিলেন এক জন দিকপাল নাট্যব্যক্তিত্ব। বাম আমলের শেষের দিকে নৈহাটি পুরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন রবীন্দ্র ভট্টাচার্য। নৈহাটিতে নাট্য আন্দোলনের কাণ্ডারী বলা যায় তাঁকে। এ ছাড়াও ছিলেন পরিচালক-অভিনেতা নিশীথরঞ্জন চক্রবর্তী। তাঁদের দল ছিল যাত্রিক। ঠাকুরপাড়া-দেউলপাড়ার দু’টি দল কুশীলব আর পথিকৃতের মধ্যে তো রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলত। এ ছাড়াও সপ্তর্ষি, যুগসন্ধি, ললিত কলামন্দির, বলাকা, রূপান্তর, রঙ্গরূপা, ওয়াইএমসিএ, এলএমএসি, ভিসুভিয়াস, নৈহাটি কালচারাল ইউনিট এমন অসংখ্য নাটকের দল নানা ভাবে মফস্সলের এই শহরের নাট্যচর্চাকে সমৃদ্ধ করেছে। নাটকের স্থায়ী মঞ্চ আছে স্টেশনের কাছেই। পুরসভার পুরনো বাড়ির মঞ্চটি এক সময়ে নাট্যকর্মীদের কাছে বড়ই আদরের ছিল। কম টাকায় ভাড়া পাওয়া যেত এই মঞ্চ। তার পাশেই পরে তৈরি হয় ঐকতান’ মঞ্চটি।


হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর এই বাড়ির একটি অংশ ভেঙে তৈরি হয়েছে ফ্ল্যাট।

সিনেমা, মেগা সিরিয়ালের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার দৌড়ে টিঁকে থাকার লড়াইটা সহজ ছিল না। এক সময়ে সাড়া জাগানো বেশ কিছু দল হারিয়ে গিয়েছে। তবে গত চার-পাঁচ বছরে নবীন প্রজন্মের হাত ধরে নাটকে ফের জোয়ার এসেছে নৈহাটিতে। এলাকার গণ্ডী ছাড়িয়ে কলকাতা, এমনকী ভিন রাজ্যের মঞ্চও কাঁপাচ্ছে নৈহাটি। সময় ১৪০০ নাট্য সংস্থা, অর্জুন, সেমন্তী, শুক্র চক্র, ন্যাশনাল পার্ক, ভগ্নস্তূপ, ইউনিটি মালঞ্চ, উন্নয়নী সংসদের মতো দলগুলি আছে সামনের সারিতে। নৈহাটির বিধায়ক পার্থ ভৌমিক নিজেও থিয়েটার করেন। বললেন, “নৈহাটিতে নাটকের পরিবেশ আছে। আমরা সেটা আরও সুন্দর করতে চাই। অন্তত নাটকের জন্য কলকাতা থেকে মানুষ এখানে আসুন, নৈহাটিকে আমরা সেই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।” পার্থবাবুর হাত ধরেই গত কয়েক বছর ধরে সংস্কৃতির মেলা নৈহাটি উৎসব শুরু হয়েছে। স্থানীয় সংস্কৃতি কর্মীরা অনেক বেশি দর্শক পাচ্ছেন।

শুধু থিয়েটার নয়, যাত্রাতেও এগিয়ে থেকেছে নৈহাটি। নট্ট কোম্পানি, আর্য অপেরা কে আসেনি? শান্তিগোপাল, স্বপনকুমার, বেলা সরকার রাতের পর রাত নৈহাটির যাত্রার দর্শককে মাতিয়ে রেখেছেন।


নাট্যকর্মীদের বড় ভরসার জায়গা, ঐকতান।

নির্বাক চলচ্চিত্রের আমলেই নৈহাটিতে প্রথম সিনেমা হল তৈরি হয়, রামকৃষ্ণ টকি। স্বাধীনতার পরে তৈরি হয় নৈহাটি সিনেমা হল। পরবর্তী সময়ে কল্যাণী সিনেমা হল। সমরেশ বসুর উদ্যোগে ১৯৬৪ সালে নৈহাটি সিনে ক্লাবের জন্ম হয়। বঙ্কিমচন্দ্র থেকে সমরেশ বসু নৈহাটির দুই কালজয়ী সাহিত্যিকের বহু গল্প নিয়ে সিনেমা তৈরি হয়েছে। যা চলচ্চিত্রপ্রেমী নৈহাটিবাসীর কাছে বড় গর্বের বিষয়। দেবী চৌধুরানি, আনন্দমঠ, দুর্গেশনন্দিনী তো বটেই, তালিকাটি সমৃদ্ধ করেছে অমৃত কুম্ভের সন্ধানে, পার, মৌচাকের মতো ছবি। নাসিরুদ্দিন শাহ, শাবানা আজমি, ওম পুরী অভিনীত পার ছবিতে নৈহাটির বেশ কিছু দৃশ্যও ছিল।

এক সময়ে সিনে ক্লাব থেকে সিনেমার দু’টি পত্রিকাও প্রকাশিত নৈহাটিতে আছে লালন ফকির চর্চা কেন্দ্র, লালন অ্যাকাডেমি। চৈতন্য ভাগবতের রচয়িতা বৃন্দাবন দাস নৈহাটির উল্লেখ করেছেন ‘নতি’ নামে। কাঁটালপাড়ায় বঙ্কিমচন্দ্রের বসতবাড়ি-লাগোয়া রাধাবল্লভের মন্দির সুপ্রাচীন। ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের অন্যতম বড় সর্বজনীন কালীপুজোও এই শহরে হয়। বৈদিক পাড়ায় শ্যামাসুন্দরী কালীমন্দির এবং জান মহম্মদ ঘাট রোডের পাশে মহাকালীতলার শতাধিক বছরের পুরনো কালী মন্দিরে দূর দূর থেকে ভক্তেরা আসেন। ধর্মগুরু স্বামী নিগমানন্দ সরস্বতী এবং ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের শৈশবও কেটেছে নৈহাটিতে।

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

amar sahar naihati bitan bhattacharya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE