পুজোয় বাচ্চাদের একটা নতুন জামা দেওয়ার সামর্থ্য থাকে না। বুক ফেটে যায়। কিন্তু ‘নিচু জাত’ বলে পুজো মণ্ডপে ঢোকা নিয়ে উচ্চবর্ণের মানুষজনের নানা বাঁকা কথা আর সহ্য হচ্ছিল না। বছর দ’শেক আগে উস্থির নৈনানপুর ডোমপাড়ার বাসিন্দারা তাই ঠিক করেন, নিজেরাই পুজো করবেন। সারা বছর ধরে বুকের রক্ত জল করে টাকা জমাবেন। যেমন ভাবা, তেমন কাজ।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার এই ডোমপাড়ায় ৩০টি পরিবার বংশ পরম্পরায় বসবাস। জনসংখ্যা মেরেকেটে শ’দুয়েক। সকলেই ভূমিহীন দিনমজুর। ঝুড়ি বানান ঘরের মহিলারা। তাঁদের বানানো ঝুড়িতেই পুজোর ডালা সাজানো হয় দক্ষিণেশ্বর, কালীঘাটের মন্দিরে। দুঃস্থ পাড়ার কারও ঘর খড়ে ছাওয়া, কারও পলিথিন দিয়ে ঢাকা। এ হেন পাড়ায় দুর্গা পুজোর আনন্দ বিলাসিতা! কিন্তু ডোমপাড়ার লোকজন জানালেন, আশপাশের পাড়ায় বা গ্রামে পুজো দেখতে গেলেই কপালে জুটত কটূক্তি, তাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞা। এমনকী, দেবীর পায়ে প্রণামটুকুও করার সুযোগ মিলত না। তাঁরা বুঝে গিয়েছিলেন, পুজো করতে গেলে যে করেই হোক, নিজেরা উদ্যোগ না করলে অন্য উপায় নেই।
বছর দ’শেক আগে গ্রামের ধর্মঠাকুর মন্দিরের মাঠে সকলে সভা করেন সকলে। সিদ্ধান্ত নেন, দেবীর আরাধনা করতে আর অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবেন না। কিন্তু পুজো করতে যে অনেক খরচ! সে দিনই সিদ্ধান্ত হয়, প্রতিটি পরিবার নিজেদের একটি করে ভাণ্ডার রাখবে। সাধ্য মতো তাতে সারা বছর ধরে কিছু কিছু অর্থ সঞ্চয় করা হবে। সেই সঞ্চিত অর্থ পুজোর জন্য বরাদ্দ হবে। তবে তাতেও পুরোটা কুলনো সম্ভব নয়।
ফলে পুজোর প্রায় ৪-৫ মাস আগে প্রতি বছর গ্রামবাসীরা একটি সভা ডাকেন। মোট কত অর্থ সঞ্চয় হল এবং কত টাকা আরও লাগবে সে নিয়ে চলে আলোচনা। পরিবারের মহিলারাও এতে সামিল হন। ওই সভাতেই সিদ্ধান্ত হয়ে যায় কোন পরিবারকে কত টাকা করে চাঁদা দিতে হবে।
ডোমপাড়ার ধর্মঠাকুর মন্দিরের মাঠেই পুজো মণ্ডপ তৈরির কাজ চলছে। এ বারে কাল্পনিক মন্দিরের আদলে মণ্ডপ তৈরি হবে। গ্রামের কচিকাঁচা থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সকলেই সেই নিয়ে ব্যস্ত। মন্দিরের চাতালে বসে কয়েক জন প্রবীণ ঝুড়ি তৈরি করছিলেন।
এত দারিদ্র্যের মধ্যেও কেন এই পুজোর আয়োজন?
জানতে চাওয়ায় ক্ষোভ উগরে দিলেন সকলে। বললেন, “অনেক অপমান সহ্য করেছি। কিন্তু ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোকে যাতে কথা শুনতে না হয়, সে জন্য নিজেরাই পুজোর উদ্যোগ করেছি।” গ্রামবাসী বিষ্টুুপদ সাঁতরা, গৌতম সাঁতরারা জানালেন, এই গ্রামটিতে দুঃস্থ মানুষের বসবাস। তাঁদের নিজেদেরকেই মণ্ডপ তৈরির কাজে হাত লাগাতে হয়। প্রতিমা শিল্পীরাও তাঁদের কথা ভেবে সাধ্য মতো কম দাম নেন।
এলাকার মহিলারা কাপড়ের খুঁটে চোখ মুছে বলেন, “পুজো করতে গিয়ে আমাদের সন্তানদের নতুন জামা কাপড় কিনে দিতে পারি না। অন্য পাড়ার বাচ্চারা নতুন জামা পড়ে আমাদের মণ্ডপে এলে ওরা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তখন নিজেদের খুব অপরাধী মনে হয়।” শম্পা সেনাপতি, রুমা সাঁতরার চোখের জলে তা-ও আটকে থাকে না ভেতরের আরও বড় লড়াইয়ের জেদ।
আশপাশের গ্রামের আর পাঁজ জন অবশ্য এমন সমস্যা আছে বলে মানতেই চাইলেন না। উস্তি পঞ্চায়েতের প্রধান পাবর্তী খন্না বলেন, “জাতপাত নিয়ে এমন কোনও সমস্যার কথা আমার কানে আসেনি। তবে এটা যদি হয়ে থাকে, তবে ঠিক নয়। সব মানুষই সমান।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy