শুধু স্থানীয় চাষিরা নন। ঠাকুরনগর ফুল বাজারে পসরা নিয়ে আসেন নদিয়া জেলার হরিণঘাটা, রানাঘাট, নগরউখরা-সহ একটি বিস্তীর্ণ এলাকার চাষিরা। এক কথায় গাইঘাটা এলাকার মানুষের অর্থনীতি মূলত এই ফুল বাজারের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু বাজারের পরিকাঠামো গত নানা সমস্যা আজও থেকেই গিয়েছে।
বাজারের অন্যতম বড় সমস্যা, সরকারি ভাবে এখানে ফুল সংরক্ষণের জন্য আজও গড়ে ওঠেনি কোনও হিমঘর। যার ফলে ফুল চাষি থেকে শুরু করে ফুল ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। রয়েছে নিকাশি, পানীয় জল ও আলোর সমস্যাও। চাষিদের ক্ষোভ, পরিকাঠামোর উন্নয়নের ব্যপারে সরকার কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। একটু ভারী বৃষ্টি হলেই বাজার চত্ত্বরে জল দাঁড়িয়ে যায়। সমস্যা থাকলেও এখনও আশার কথা শোনাতে পারেননি গাইঘাটার বিডিও পার্থ মণ্ডলও। তিনি বলেন, ‘‘ওই এলাকায় হিমঘর করার মতো কোনও সরকারি জমি নেই। কোনও তহবিলও আমাদের কাছে নেই।’’
ঠাকুরনগর রেল স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় প্রায় তিন বিঘা জমির উপর গড়ে উঠেছে ঠাকুরনগর ফুল বাজার। বাজারের জমি স্থানীয় কয়েকজনের ব্যক্তি মালিকানায় রয়েছে। স্থানীয় শিমুলপুর এলকার ফুলচাষি প্রদীপ বিশ্বাসের ২৫ বিঘা জমিতে ফুল চাষ রয়েছেন। তিনি জানালেন, গাইঘাটা ব্লকের মানুষের অর্থনীতি ওই বাজারকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। দূর দূরান্ত থেকে খুচরো ও পাইকারি চাষিরা এই বাজারে আসেন। রোজ সকাল ৭টার মধ্যে বাজার বসে যায়। চলে দুপুর আড়াইটে, তিনটে পর্যন্ত। সন্ধ্যার পর মূলত বসে জবা ফুলের বাজার। ফুল বিক্রির জন্য রয়েছে অস্থায়ী প্রায় এক হাজার দোকান ঘর। এক হাজারেরও বেশি ব্যবসায়ী এই বাজারের সঙ্গে যুক্ত। আর চাষি প্রায় কুড়ি হাজার। ঠাকুরনগর, শিমুলপুর ও সংলগ্ন এলাকার বহু মহিলা এখান থেকে ফুল নিয়ে কলকাতার বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করেন। অভাবের সংসারে স্বামীর পাশাপাশি স্ত্রীরাও এই ফুল ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় তাঁদের পরিবারের আর্থিক হাল ফিরেছে। শয়ে শয়ে মহিলারা রোজ ভোরে বনগাঁ থেকে শিয়ালদহগামী ট্রেনে করে কলকাতায় যান। বেচাকেনা করে দুপুর সাড়ে বারোটার পরে বাড়ি ফেরেন। মহিলারা ঠাকুরনগর বাজার থেকে ফুল কিনে বাড়িতে বসে মালা গাঁথেন। কলকাতার বাজারে তাঁরা খুচরো ফুলের পাশাপাশি ফুলের মালাও বিক্রি করেন। মহিলাদের কথায়, ‘‘ফুল কিনে মালা তৈরি করে বিক্রি করলে লাভ একটু বেশি হয়।’’ কিন্তু এত বড় বাজার হলেও কী হবে? উৎপাদন বেশি হলে বা বিক্রি না হলে চাষি বা ব্যবসায়ীরা ফুল বাজারে ফেলে দিয়ে যেতে বাধ্য হন। কারণ, উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাব। বাজারের এক মালিক পিনাকী বিশ্বাস বলেন, ‘‘বাজারে ব্যক্তিগত মালিকানায় ক্ষুদ্র তিনটি হিমঘর রয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা কিছুই নয়। চাষি ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থে সরকারি ভাবে একটি বড় হিমঘর দ্রুত তৈরির প্রয়োজন রয়েছে। আর আছে পর্যাপ্ত আলোর অভাব।’’ ফুল ব্যবসায়ী প্রদীপ মজুমদার বলেন, ‘‘এত বড় ফুলের বাজার। অথচ এখানে আর্সেনিক মুক্ত কোনও গভীর পানীয় জলের নলকূপ নেই। ব্যবসায়ী বা চাষিরা বাজারে এসে পানীয় জল সমস্যায় ভোগেন। বাজারে একটি পানীয় জলের নলকূপ ছিল। কিন্তু কিছুদিন হল তা খারাপ হয়ে গিয়েছে।’’
বাজারে গিয়ে দেখা গেল, দূর দূরান্ত থেকে চাষিরা ফুল নিয়ে এসেছেন। ব্যবসায়ীরা তা কিনে খুচরো বিক্রি করছেন। টিন ও টালির ছাউনি দেওয়া ছোট ছোট দোকান ঘরে পলিথিনের উপর ফুল ঢেলে বিক্রি চলছে। কী ফুল নেই— গোলাপ, রজনীগন্ধা, গাঁধা, জবা, দোপাটি আরও কত রকমের ফুল। গাঁধা ফুলের কেজি প্রতি ১৮ টাকা, রজনীগন্ধার কেজি প্রতি মূল্য ২৫ টাকা, এক হাজার জবার মূল্য ৭০ টাকা। সময় বিশেষে ফুলের মূল্য ওঠানামা করে। স্বপন বিশ্বাস নামে এক ফুল বিক্রেতা জানালেন, ‘‘এখানে গাঁধা ফুলটাই বেশি বিক্রি হয়ে থাকে। যেদিন ফুল বিক্রি হয় না সেদিন ফুল ফেলে দিয়ে যেতে হয়।’’ হরিণঘাটা থানা এলাকা থেকে ফুল বিক্রি করতে এসেছিলেন পরাণ সরকার। তিনি চার বিঘা জমিতে ফুল চাষ করেছেন। জানালেন, ‘‘হরিণঘাটা থেকে ঠাকুরনগর ফুল বাজারের দূরত্ব কম হয়। তাছাড়া আমাদের কাছের ফুল বাজার বলতে কলকাতার বড়বাজার। ফুল নিয়ে ওই বাজারে গেলে লাভ কিছুই থাকে না। ঠাকুরনগরে হিমঘর না থাকায় ফুল বিক্রি না হলে ফেলে দিয়ে যেতে হয়।’’
শুধু পুরুষেরা নন, মহিলারাও এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। এখানকারই জারবেরা ফুল জাপান সহ বিদেশের নানা দেশে রফতানি হচ্ছে। এই বাজারে ফুল কিনতে এসেছিলেন প্রৌঢ়া কুসুম হালদার। বললেন,‘‘স্বামীর পাশাপাশি আমিও ফুল নিয়ে কলকাতায় যাই। দু’জনে মিলে কাজ করি। এখানকার কয়েক হাজার মহিলাও ফুল বিক্রির সঙ্গে যুক্ত।’’ শেফালি বিশ্বাস নামে এক মহিলার কথায়, ‘‘স্বামী ভ্যান চালায়। দুই ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করে। একজনের আয়ে লেখাপড়া শিখিয়ে সংসার চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। তাই আমি ফুলের ব্যবসা শুরু করায় সমস্যা অনেকটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি।’’
তবে ক্রেতা বিক্রেতা সকলের বক্তব্য ঠাকুরনগর ফুল বাজারের পরিকাঠামোর উন্নতি হলে এলাকার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আরও ভাল হত। গাইঘাটা পঞ্চায়েত সমিতির সহসভাপতি ধ্যানেশ নারায়ণ গুহ বলেন, ‘‘পনেরো দিনের মধ্যে গভীর নলকূপ বসিয়ে দেওয়া হবে। নিকাশি সমস্যা সমাধানের জন্য ব্যবসায়ী ও মালিকদের বলেছি একটি নকশা তৈরি করে দিতে।’’ এ়সব সমস্যা দূর করতে আশার কথা শোনা গেলেও সংরক্ষণের বিষয়ে কিন্তু আশা দেখছেন না ব্যবাসীয়া। ধ্যানেশবাবু বলেন, ‘‘এখানে কোনও জমি পাওয়া যাচ্ছে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেল মন্ত্রী থাকাকলীন রেলের জমিতে রেল হিমঘর তৈরি করে দিতে রাজি হয়েছিল। তারপর আর তারা আগ্রহ দেখায়নি। তবে হিমঘর তৈরির বিষয়টি রাজ্য সরকারকে জানানো হয়েছে।’’ চাষি, ব্যবসায়ী— সকলের ক্ষোভ, বাম আমলেও হয়নি, তৃণমূল আমলে ফুল বাজারের পরিকাঠামো এখনও বদল দেখা গেল না।