Advertisement
E-Paper

একটা ব্লেডেই কামাল করল ৩ খুদে সাহসিনী

২ নম্বর প্ল্যাটফর্মের কাছে পুকুরের ধারটায় থোকা থোকা অন্ধকার। আড়ালে একটা বাঁশের মাচায় বসিয়ে রাখা হয়েছে ওদের। দড়ি দিয়ে হাত বাঁধা। এখানে নিয়ে আসার আগে লোকগুলো গায়ে কী একটা ছিটিয়ে দিয়েছিল। তার গন্ধে মাথাও ঝিমঝিম।

বাপি মজুমদার

শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:৪৫
কী ভাবে বাঁধা ছিল হাত, দেখাচ্ছে প্রিয়া (মাঝে)।  সঙ্গে ক্যাটরিনা (বাঁ দিকে) এবং কৃপা। — নিজস্ব চিত্র।

কী ভাবে বাঁধা ছিল হাত, দেখাচ্ছে প্রিয়া (মাঝে)। সঙ্গে ক্যাটরিনা (বাঁ দিকে) এবং কৃপা। — নিজস্ব চিত্র।

২ নম্বর প্ল্যাটফর্মের কাছে পুকুরের ধারটায় থোকা থোকা অন্ধকার। আড়ালে একটা বাঁশের মাচায় বসিয়ে রাখা হয়েছে ওদের। দড়ি দিয়ে হাত বাঁধা। এখানে নিয়ে আসার আগে লোকগুলো গায়ে কী একটা ছিটিয়ে দিয়েছিল। তার গন্ধে মাথাও ঝিমঝিম।

কিন্তু পালাতেই হবে যে!

ঘোর কেটে আসছিল কি না কে জানে। কিন্তু ক্লাস ফাইভের প্রিয়া চৌধুরি বুঝেছিল, তার মাথাটা কাজ করছে। পাশে হাত বাঁধা দুই বান্ধবী কৃপা আর ক্যাটরিনা। পালাতে হবে ওদের নিয়েই। টিউশনে যাচ্ছিল বলে ব্যাগগুলো সঙ্গেই ছিল। কপাল ভাল, হাত পিছমোড়া করে বাঁধা ছিল না। তাই দু’হাত বাঁধা অবস্থাতেই ব্যাগ থেকে পেন্সিল-বাক্সটা বের করতে অসুবিধে হয় না প্রিয়ার। বাক্সে ছিল পেন্সিল ছোলার ব্লেড। দেড় ঘণ্টার টানাটানিতে বাঁধন খানিকটা আলগাও হয়ে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে ব্লেড চালিয়ে শনের দড়ি কাটতে থাকে প্রিয়া। নিজের হাত খোলার পর বান্ধবীদের বাঁধন কাটতে আর কত ক্ষণ?

তার পর দৌড় দৌড়! লোকগুলো টের পেয়েছিল, তাড়া করে এসেওছিল অনেকটা। কিন্তু আর ধরতে পারেনি ওদের। ততক্ষণে ওষুধের ঘোর অনেকটাই কেটে গিয়ে রেললাইন থেকে পাথর তুলে দমাদ্দম ছুড়ছিল ওরা। আর সেই পাথর থেকে বাঁচতে গিয়ে লোকগুলোও পিছিয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত দিদিমণি জ্যোতি চৌধুরির বাড়িতে ঢুকে পড়ে ওরা। জ্যোতিদেবী ওদের বাড়িতে খবর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাবা-মায়েরা এসে পড়েছিলেন। গল্প শুনে বুঝতে পেরেছিলেন, প্রিয়ার উপস্থিত বুদ্ধি কাজ না করলে বুধবার রাতে নির্ঘাত পাচার হয়ে যেত মালদহের সামসির এই তিন মেয়ে।

পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছিল পরের দিন, বৃহস্পতিবার বেলা ১টা নাগাদ। থানায় সেই অভিযোগ জমা পড়ার পরে রাত গড়িয়ে গেলেও প্রিয়া, কৃপা বা ক্যাটরিনার বাড়িতে গিয়ে উঠতে পারেনি পুলিশ। প্রিয়ার বাবা কেদার চৌধুরি পেশায় ফেরিওয়ালা। বললেন, ‘‘পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বাড়িতেও আসেনি।’’ রতুয়া থানার ওসি হারাধন দে যদিও বলছেন, ‘‘তদন্ত শুরু করেছি। কিন্তু ওই বালিকাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে তেমন কোনও সূত্র পাইনি। দরকারে অবশ্যই ওদের বাড়ি যাব।’’ তিন মেয়ের বাড়ির লোকেরা বলছেন, যারা ওদের তুলে নিয়ে যাচ্ছিল, পুলিশের এই ‘ঢিলেমি’র জন্যই নিশ্চিন্তে লুকিয়ে পড়ার সময় পাবে তারা। তাদের গায়ে কী তরল ছেটানো হয়েছিল, তার কোনও পরীক্ষা এখনও হয়নি বলেই খবর। কেন হয়নি? ওসি-র জবাব, ‘‘অভিযোগে তেমন কিছু বলা হয়নি।’’

সামসি স্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের গায়ে কুলিপাড়ায় থাকে প্রিয়া, কৃপা আর ক্যাটরিনা। প্রিয়া ও কৃপা পড়ে পঞ্চম শ্রেণিতে। ক্যাটরিনা চতুর্থ শ্রেণিতে। রোজকার মতোই বুধবার সন্ধেবেলা পাড়ার কাছে জ্যোতিদেবীর বাড়িতে পড়তে যাচ্ছিল ওরা। কুলিপাড়া পেরিয়ে জ্যোতিদেবীর বাড়ি যাওয়ার রাস্তায় পড়ে লাইব্রেরির একটি ছোট মাঠ। জায়গাটা এমনিতেই নির্জন। রাস্তায় আলোও নেই। প্রিয়া জানিয়েছে, অন্ধকারে কেউ এক জন হঠাৎ তাদের গায়ে কোনও তরল ছিটিয়ে দেয়। তার পরেই কিছুটা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে ওরা। তবে সেই অবস্থাতেও প্রিয়া বুঝেছিল, ছুরি হাতে দু’জন অচেনা লোক ওদের পথ আটকেছে।

ওই দু’জন প্রিয়াদের বলে, তাদের কথামতো কাজ না করলে খুন করে দেবে। তিন মেয়েকে রেললাইন পার করিয়ে ২ নম্বর প্ল্যাটফর্মের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই পুকুরের পাশে বাঁশের মাচায় হাত বেঁধে তাদের অন্ধকারে বসিয়ে রাখা হয় ওদের। সামনেই পায়চারি করছিল ওই দু’জন। চিৎকার করলে খুন করার হুমকিও দিচ্ছিল। ঘণ্টা দেড়েক এ ভাবে ঠায় বসে থাকার পর ওদের বুঝতে না দিয়েই বাঁধনগুলো কেটে ফেলেছিল প্রিয়া। তার পর পাথর ছুড়তে ছুড়তে দিদিমণির বাড়ি।

জ্যোতিদেবী বলেন, ‘‘তিন জনেই ভয়ে থরথর করে কাঁপছিল। বুঝলাম বড় কিছু একটা ঘটেছে। তখন ওদের বাড়িতে খবর পাঠাই।’’ রেললাইনের গা-লাগোয়া কুলিপাড়ায় মূলত নিম্নবিত্ত মানুষের বাস। তাঁদের বেশির ভাগই দিনমজুর। অনেকেই বিহারের বাসিন্দা। তাঁদের ধারণা, দুষ্কৃতীরা সম্ভবত ভালই জানে, প্রিয়া-কৃপারা কখন কোথায় যায়। কৃপার বাবা ভোলা চৌধুরি বলেন, ‘‘মেয়েরা পাচারকারীদের হাতে পড়েছিল। পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকলে হবে কী করে?’’

পুলিশের সন্দেহ, তিন জনকে বিহারে নিয়ে যাওয়ারই চেষ্টা হচ্ছিল। রাত পৌনে ৭টায় সামসি থেকে কাটিহারের ট্রেন রয়েছে। প্রিয়াদের স্টেশনের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তার খানিক আগেই। কিন্তু ট্রেন আসে দু’ঘণ্টারও বেশি লেটে। ওই সময়টুকুই কাজে লেগে যায় প্রিয়ার। তার বাবার কথায়, ‘‘ট্রেন ঠিক সময়ে এলে আর ওদের দেখতে পেতাম না।’’

প্রিয়া কিন্তু বলছে, ‘‘ঠিক পালাতাম!’’

MostReadStories
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy