Advertisement
E-Paper

নেতাবন্দনায় ট্যাটু সংস্কৃতি বঙ্গে! হাতে অভিষেকের মুখ খোদাই মেটিয়াবুরুজের তরুণের, হুগলির সিপিএম কর্মীর বুকে মিনাক্ষী

বঙ্গের রাজনীতিতে নেতাবন্দনায় এই ধারা নতুনই বটে। কিন্তু ট্যাটু নতুন নয়। ইতিহাস বলছে সাত হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দেও মানুষ ট্যাটু করাত। মিশরীয় সভ্যতা থেকে শুরু করে মায়া সভ্যতার নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে সেই ছাপ রয়েছে। ২০২৫ সালেও ক্রীড়া ও বিনোদন জগতে ট্যাটু ফ্যাশনের মাধ্যম।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০২৫ ২০:৪১
(উপরে) তৃণমূলকর্মী প্রীতম পান্ডের সঙ্গে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের ট্যাটু-সহ সিপিএমকর্মী (নীচে)।

(উপরে) তৃণমূলকর্মী প্রীতম পান্ডের সঙ্গে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের ট্যাটু-সহ সিপিএমকর্মী (নীচে)। —সংগৃহীত

২০১৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। সাতসকালে তামিলনাড়ুর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার বাড়ির সামনে পৌঁছে গিয়েছিলেন ১,০০১ জন মহিলা। উপলক্ষ: ‘আম্মা’র জন্মদিন। সেই মহিলারা অভিনব উপহার দিয়েছিলেন এআইডিএমকে নেত্রীকে তাঁর জন্মদিনে। প্রত্যেকে তাঁদের হাতে ট্যাটু করিয়েছিলেন জয়ললিতার মুখ।

২০১৮ সালে কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে বাসবরাজ নামের এক তরুণ নিজের সারা পিঠ জু়ড়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মুখ খোদাই করিয়েছিলেন। ১৫ ঘণ্টা ধরে নিজের শরীরে মোদীকে আঁকিয়ে পৌঁছেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সভায়।

২০২২ সালে উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা ভোটের সময়ে গোরক্ষপুরের ২৫ জন যুবক একসঙ্গে যোগী আদিত্যনাথের মুখ ট্যাটু করিয়েছিলেন নিজেদের হাতে।

নেতাবন্দনায় দক্ষিণ ও উত্তর ভারতের ট্যাটু সংস্কৃতি কি এ বার পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতেও ডালপালা মেলতে ‌শুরু করল? ইতিহাস বলছে, সাত হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দেও মানুষ ট্যাটু করাত। মিশরীয় সভ্যতা থেকে শুরু করে মায়া সভ্যতার নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে সেই ছাপ রয়েছে। ২০২৫ সালেও ক্রীড়া ও বিনোদন জগতে ট্যাটু ফ্যাশনের মাধ্যম। সাধারণের মধ্যেও ট্যাটু করানোর প্রবণতা বাড়ছে। প্রেমিক রণবীর কপূরের নাম এবং পদবির দুই আদ্যক্ষর ‘আর’ এবং ‘কে’ নিজের গ্রীবায় ট্যাটু করিয়েছিলেন দীপিকা পাড়ুকোন। সে প্রেম ভেঙে গিয়েছে। রণবীর বিয়ে করেছেন আলিয়া ভট্টকে। দীপিকা বিয়ে করেছেন আরেক রণবীর, রণবীর সিংহকে। ঘাড়ের ট্যাটু তোলাতে হয়েছে তাঁকে। রসিকতা করে অনেকে তখন বলেছিলেন, শুধু ‘আর’ হলে সমস্যা ছিল না। পদবিটাই গোলমাল পাকাল। আসুন ফুটবলে। দিয়েগো মারাদোনার বাহুতে ছিল চে গেভারার ট্যাটু। লিওনেল মেসির দু’পা জুড়ে ট্যাটু। ভারতীয় ক্রিকেটারদের মধ্যে ট্যাটুবিলাসীর তালিকা নেহাত ছোট নয়। বিরাট কোহলি, কেএল রাহুল, হার্দিক পাণ্ড্য, সূর্যকুমার যাদবের দেহবল্লরী ট্যাটুময়। হালের নীতীশ রেড্ডিও কম যান না।

চরম ভালবাসা বোঝাতে অত্যন্ত পছন্দের বস্তু বা মানুষের অথবা আরাধ্য দেবতার ছবি বা মুখ শরীরে উল্কি করে চিরকালীন রাখা— এই হল ট্যাটু করানোর মোদ্দা কথা। দক্ষিণ ভারতের মানুষ স্বভাবতই আবেগপ্রবণ। সেখানকার রাজনীতিতে ট্যাটুর ব্যবহার সম্ভবত তা-ই সবচেয়ে আগে নজরে পড়েছে। অতঃপর উত্তর ভারতের ‘উত্তমপ্রদেশ’। পশ্চিমবঙ্গেও ট্যাটু-করিয়ের সংখ্যা নেহাত কম নয়। কিন্তু তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর মুখ ট্যাটু করানো? এবং অতঃপর বঙ্গদেশও প্রবেশ করল সেই যুগে।

তৃণমূলের ‘ক্যাপ্টেন’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ নিজের হাতে ট্যাটু করিয়েছেন প্রীতম পান্ডে। সোমবার নিজের লোকসভা কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবারের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বিজয়া সম্মিলনীতে যোগ দিয়েছিলেন অভিষেক। সেখানেই পৌঁছে যান মেটিয়াবুরুজের বাসিন্দা প্রীতম। বছর তিরিশের তরুণ পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে অভিষেককে দেখান, তাঁরই মুখাবয়ব তিনি ট্যাটু করিয়েছেন। দৃশ্যতই আপ্লুত অভিষেক প্রীতমের সঙ্গে সেই ছবি ‘ইনস্টাগ্রাম স্টোরি’তে ‘শেয়ার’ করে ফেলেন সোমবার রাতেই।

গত বছর লোকসভা ভোটের আগে হুগলিতে বামেদের একটি সমাবেশে বছর পঁয়তাল্লিশের এক সিপিএম কর্মী কাঁধে লালঝান্ডা নিয়ে আদুড় গায়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন মঞ্চের কাছে। তখনই দেখা যায় তাঁর বাঁ-দিকের বুকে যুবনেত্রী মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের ট্যাটু। চুঁচুড়ার বাসিন্দা সুজিত বসু রাতারাতি ‘ভাইরাল’ হয়ে গিয়েছিলেন বাম মহলে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাদ দিয়ে অভিষেকের মুখ কেন মেটিয়াবুরুজের তৃণমূলকর্মীর ট্যাটুতে? বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-জ্যোতি বসুদের বাদ দিয়ে কেনই বা নিজের বুকে মিনাক্ষীর মুখ খোদাই করালেন হুগলির সিপিএম কর্মী?

কেন তরুণ প্রজন্মের নেতা বা নেত্রীর মুখের ট্যাটু করানোর ঝোঁক বাংলার রাজনীতিতে?

তৃণমূলকর্মী প্রীতম বলছেন, ‘‘আমি প্রথম ভোটার হই ২০১৪ সালে। প্রথম বার ভোট দিয়েছিলাম অভিষেকদাকে। সে বারই প্রথম সাংসদ হন তিনি। তার পর থেকে এতগুলো বছর ধরে তাঁর কাজ দেখছি। ভাল লাগে। তাই করেছি।’’ মমতার মুখ নয় কেন? প্রীতম একটু ইতস্তত করলেন। তার পর বললেন, ‘‘আমার কেউ নেই। বাবা-মা দু’জনেই মারা গিয়েছেন। অভিষেকদাই আমার সব।’’ প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে ট্যাটুটি করিয়েছেন পেশায় কাপড় ব্যবসায়ী প্রীতম। দক্ষিণা গুনে দিয়েছেন প্রায় পাঁচ হাজার টাকা।

সিপিএমের সুজিত কেন বাছলেন মিনাক্ষীকে? তাঁর কথায়, ‘‘আমি সকলকেই শ্রদ্ধা করি। কিন্তু মিনাক্ষীকে অন্য রকমের নেতা মনে হয়। ক্যাপ্টেন। তা-ই করিয়েছি।’’ ঘটনাচক্রে অভিষেককেও তৃণমূলের বড় অংশ ‘ক্যাপ্টেন’ বলে অভিহিত করেন। প্রীতমের না হয় নিজের পরিবার বলতে কিছু নেই। কিন্তু সুজিতের পরিবারে মা, স্ত্রী, সন্তান, দাদা, বৌদি রয়েছেন। কেউ বারণ করেননি? পেশায় কেটারিং ব্যবসায়ী সুজিতের কথায়, ‘‘কেন বারণ করবে? আমাদের গোটা বাড়ি তো সিপিএম!’’ সুজিতের ট্যাটু করাতে সময় লেগেছিল প্রায় চার ঘণ্টা। খরচ হয়েছিল সাড়ে চার হাজার টাকা।

বঙ্গের রাজনীতিতে নেতাবন্দনায় এই ধারা নতুন বটে। কিন্তু ট্যাটু নতুন নয়। এ রাজ্যে অনেক বামনেতার হাতে চে-র ট্যাটু রয়েছে। একদা বামনেতা বর্তমানে বিজেপি বিধায়ক শঙ্কর ঘোষের হাতেও চে-র ট্যাটু ছিল। তবে এই প্রজন্মের রাজনীতিকদের মুখকে ট্যাটু করানোর ধারা একেবারেই নতুন। কংগ্রেসনেতা তথা আইনজীবী ঋজু ঘোষাল ট্যাটুবিলাসী। নিয়মিত জিম করেন। সমাজমাধ্যমে জিমের ছবিও পোস্ট করেন। ঋজুর দু’হাতে দু’টি প্রকাণ্ড ট্যাটু আছে। সারা বুক জুড়ে নতুন ট্যাটু করানোর পরিকল্পনাও চলছে। সেই ঋজু কি কখনও ভেবেছেন হাতে বা শরীরের অন্যত্র কখনও ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী বা রাহুল গান্ধীর মুখাবয়ব কখনও ট্যাটু করাবেন? ঋজুর বক্তব্য, ‘‘না। আমার কাছে ট্যাটু হল আত্ম অনুভূতির প্রতিফলন। আমি সে ভাবেই দেখি।’’ তবে রাজনৈতিক কর্মীদের হাতে বুকে নেতা-নেত্রীর ট্যাটু করানোকেও ঋজু বাঁকা চোখে দেখতে রাজি নন। তাঁর কথায়, ‘‘করাতেই পারেন। অনেকেই তো নিজেদের সন্তান, প্রিয়জন, পোষ্যের মুখাবয়বও ট্যাটু করান!’’

তবে দীপিকার সঙ্গে মেটিয়াবুরুজের প্রীতম বা হুগলির সুরজিতের তফাত আছে— এ প্রেমের ভাগ হবে না। ভাগ্যিস!

tattoo Abhishek Banerjee Minakshi Mukherjee Bengal politics
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy