Advertisement
E-Paper

অডিয়োর পর রেকর্ড হয় ঘুষের ভিডিয়োও! ফোন করে মুছে দিতে মিনতি করেন ‘কালীঘাটের কাকু’, দাবি সিবিআই চার্জশিটে

প্রাথমিক মামলায় চার জন সাক্ষীর কাছ থেকে মোট ১০টি ডায়েরি উদ্ধার করেছে সিবিআই। তাঁদের বয়ানও রেকর্ড করা হয়েছে। অভিযোগ, মোট ৭৮ কোটি টাকা ঘুষ গিয়েছে সুজয়কৃষ্ণের কাছে।

সারমিন বেগম

শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২৫ ১১:২৯
A video was recorded of collecting bribe which Sujay Krishna Bhadra requested to delete

‘কালীঘাটের কাকু’ ওরফে সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র প্রমাণ লোপাটের জন্য নিজের ফোন আদিগঙ্গায় ফেলে দিয়েছিলেন, দাবি সিবিআইয়ের চার্জশিটে। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

প্রাথমিক নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় শুধু অডিয়ো নয়, একটি ভিডিয়ো রেকর্ডিংয়ের কথাও জানতে পেরেছে সিবিআই। চাকরিপ্রার্থীদের ঘুষের টাকা কী ভাবে লেনদেন করা হত, তা ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন সিবিআইয়ের কাছে ওই মামলায় বয়ান দেওয়া এক সাক্ষী। সিবিআই তাঁর বয়ান রেকর্ডও করেছে। ওই সাক্ষী জানিয়েছেন, ভিডিয়োটি মুছে ফেলতে তাঁকে ফোন করে বার বার অনুরোধ করেছিলেন স্বয়ং ‘কালীঘাটের কাকু’ ওরফে সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র। প্রাথমিক মামলার তদন্তে নেমে ওই সাক্ষীকে জেরা করে এই তথ্য জেনেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। তবে সংশ্লিষ্ট ভিডিয়োটি সিবিআই হাতে পায়নি। প্রাথমিক মামলার তৃতীয় অতিরিক্ত চার্জশিটে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রাথমিক মামলায় চার জন সাক্ষীর কাছ থেকে মোট ১০টি ডায়েরি উদ্ধার করেছে সিবিআই। তাঁদের বয়ানও রেকর্ড করা হয়েছে। ওই চার জন অরুণ হাজরার ‘এজেন্ট’ হিসাবে কাজ করেছেন বলে দাবি সিবিআইয়ের। তাঁরা চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে ঘুষের টাকা সংগ্রহ করে তুলে দিতেন সুজয়কৃষ্ণের হাতে। তেমনি এক এজেন্ট ঘুষ দেওয়া-নেওয়ার ভিডিয়ো নিজের ফোনে রেকর্ড করেছিলেন। সিবিআইয়ের কাছে তিনি দাবি করেছেন, সুজয়কৃষ্ণের ‘অনুরোধে’ পরে তিনি ওই ভিডিয়োটি ফোন থেকে মুছে দেন। উপরন্তু, সুজয়কৃষ্ণ ওই এজেন্টকে জানান, প্রমাণ লোপাট করতে নিজের দু’টি মোবাইল ফোনও কালীঘাটে আদিগঙ্গার জলে ফেলে দিয়েছেন তিনি।

মিনতি-ফোন এবং ৭৮ কোটি

সিবআইয়ের কাছে দেওয়া ওই এজেন্টের বয়ান (যার প্রতিলিপি আনন্দবাজার ডট কমের কাছে রয়েছে) অনুযায়ী, সুজয়কৃষ্ণের সহকারী নিখিল হাতির ঘুষ নেওয়ার ভিডিয়ো নিজের ফোনে রেকর্ড করেছিলেন তিনি। ঘটনাস্থলে সুজয়কৃষ্ণ নিজেও উপস্থিত ছিলেন। পরে ওই মামলায় ইডি এবং সিবিআই সক্রিয় হয়ে ওঠার পর ফোন করে ভিডিয়োটি মুছে দেওয়ার জন্য বার বার মিনতি করেন সুজয়কৃষ্ণ। একাধিক প্রমাণ লোপাটের কথা জানান। ঘুষের টাকা ফেরত দেওয়ারও আশ্বাস দেন। ওই সিবিআইকে এজেন্ট জানিয়েছেন, শুধু প্রাথমিক নয়, উচ্চ প্রাথমিক, একাদশ-দ্বাদশ, কর্ম ও শারীরশিক্ষা-সহ একাধিক চাকরির জন্য প্রার্থী ‘সংগ্রহ’ করতেন তিনি। কারণ, তিনি নিজেও একজন চাকরিপ্রার্থী ছিলেন। ঘুষের টাকা দিতে না-পারায় তাঁকে প্রার্থী খুঁজে দিতে বলা হয়েছিল। তাঁর মতো একাধিক এজেন্ট প্রার্থী সংগ্রহের কাজ করেছেন। এ ভাবে অরুণের মাধ্যমে সুজয়কৃষ্ণের হাতে গিয়েছে মোট ৭৮ কোটি টাকা। তবে সব প্রার্থী চাকরি পাননি। কার কাছ থেকে কী উপলক্ষে কত টাকা নেওয়া হয়েছে, তা লেখা থাকত এজেন্টদের ওই ডায়েরিগুলিতে।

ফেলো কড়ি, চাকরি কই!

সিবিআইকে দেওয়া ওই এজেন্টের বয়ান অনুযায়ী, ৪০ কোটি টাকার চাকরি পাকা করে দিয়েছিলেন সুজয়কৃষ্ণ। বাকি আর কাউকে চাকরি দিতে পারেননি। তিনি ফেরত দিয়েছেন ১৭ কোটি টাকা। প্রতিশ্রুতি দিলেও বাকি অর্থ ফেরত দেননি বলে অভিযোগ। এই সংক্রান্ত একটি চুক্তিতে অরুণ এবং এজেন্টরা সকলে স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু সুজয়কৃষ্ণ বা তাঁর সহকারী নিখিল (যাঁর মাধ্যমে মাঝেমধ্যেই ঘুষের টাকা সুজয়কৃষ্ণের কাছে গিয়েছে) ওই চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে চাননি। টাকা দেওয়ার পরেও চাকরি না-পাওয়ায় প্রার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। তাঁরা টাকা ফেরত চেয়ে এজেন্টদের চাপ দেন। এজেন্টরা আবার একসঙ্গে চেপে ধরেন অরুণকে। কিন্তু তাতেও লাভ হয়নি। অরুণ জানান, তিনি সুজয়কৃষ্ণকে টাকা দিয়ে দিয়েছেন। এর পরে অরুণই তাঁদের সকলকে নিয়ে যান সুজয়কৃষ্ণের বেহালার বাড়িতে।

‘কাকু’র হুমকি এবং মিনতি

ওই এজেন্ট সিবিআইকে জানিয়েছেন, ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে সকলের সঙ্গে তিনিও টাকা চাইতে সুজয়কৃষ্ণের বাড়িতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সুজয়কৃষ্ণ টাকা ফেরত দেননি। উল্টে এজেন্টদের সঙ্গে ‘দুর্ব্যবহার’ করেন। ওই এজেন্টের অভিযোগ, টাকার জন্য বেশি চাপ দিলে মাদকের ভুয়ো মামলায় ফাঁসিয়ে দেবেন বলে হুমকিও দিয়েছিলেন সুজয়কৃষ্ণ। নিয়োগ মামলার তদন্তে নেমে এর পরে হুগলির অধুনা বহিষ্কৃত তৃণমূল নেতা কুন্তলকে গ্রেফতার করে সিবিআই এবং ইডি। তল্লাশি চালানো হয় সুজয়কৃষ্ণের বাড়িতে। এজেন্টের বয়ান অনুযায়ী, ওই সময়েই সুজয়কৃষ্ণ তাঁকে একাধিক বার ফোন করেন। ফোন এসেছিল হোয়াট্‌সঅ্যাপে (হোয়াট্সঅ্যাপের ফোনালাপ সরাসরি মোবাইলে রেকর্ড করা যায় না)। ঘুষ দেওয়া-নেওয়ার যাবতীয় প্রমাণ মুছে ফেলতে বলেছিলেন সুজয়কৃষ্ণ। এমনকি, সমস্ত বকেয়া টাকা ফেরত দিয়ে দেবেন বলেও এই সময়ে ফোনে আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি। ওই এজেন্টের বয়ান অনুযায়ী, তাঁকে ফোনে সুজয়কৃষ্ণ জানান, ঘুষ নেওয়া সংক্রান্ত যাবতীয় ইমেল তিনি নিজে মুছে ফেলেছেন। নিখিলের ফোন থেকেও ইমেল মুছে দিয়েছেন। নিজের দু’টি মোবাইল ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন কালীঘাটের আদিগঙ্গায়। এজেন্টের দাবি, সুজয়কৃষ্ণের কথাতেই তিনি ওই ভিডিয়োটি মুছে ফেলেন। এ ছাড়াও নিজের ফোন থেকে ওই সংক্রান্ত একাধিক তথ্য মুছে ফেলেছিলেন ওই এজেন্ট তথা সাক্ষী।

টাকা মাটি, মাটি টাকা

সিবিআইকে দেওয়া এজেন্টের বয়ান অনুযায়ী, সুজয়কৃষ্ণ জানিয়েছিলেন, তিনি নগদ অর্থ ফেরত দিতে না-পারলে ৩৯ কাঠার একটি জমির বিনিময়ে টাকা শোধ করবেন। কিন্তু টাকা বা জমি, কোনওটাই পাওয়া যায়নি। ২০২৩ সালের মে মাসে সুজয়কৃষ্ণকে গ্রেফতার করে ইডি। এর পরে ওই এজেন্টকে ফোন করে গা-ঢাকা দিতে বলেছিলেন অরুণ। বন্ধ করে রাখতে বলেন মোবাইলও। সেই পরামর্শ মেনে ওই এজেন্ট ১৫ দিনের জন্য দিল্লি চলে যান। পরে সিবিআই ডাকলে তাদের দফতরে গিয়ে নিজের বয়ান রেকর্ড করান।

প্রসঙ্গত, প্রাথমিক মামলার তদন্তে নেমে সিবিআইয়ের হাতে যে অডিয়োটি এসেছে, তাতে সুজয়কৃষ্ণ ছাড়াও কুন্তল ঘোষ, শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়দের গলা শোনা গিয়েছে বলে দাবি। সরকারি চাকরির জন্য প্রার্থীদের কাছ থেকে বেআইনি ভাবে টাকা তোলার বিস্তারিত পরিকল্পনা রয়েছে সেই অডিয়োয়। এসেছে পার্থ চট্টোপাধ্যায়, মানিক ভট্টাচার্য, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়দের নাম। ওই অডিয়ো প্রাথমিক মামলার তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। তদন্তকারীদের মতে, এজেন্টের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার ভিডিয়োটি পাওয়া গেলে সেটিও ‘গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ’ হতে পারত।

উল্লেখ্য, সিবিআইয়ের তৃতীয় অতিরিক্ত চার্জশিটে অভিষেকের নামোল্লেখের খবর প্রথম প্রকাশ করেছিল আনন্দবাজার ডট কম। তার পরেই অভিষেকের আইনজীবী সঞ্জয় বসু বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিলেন, সিবিআই ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ ভাবে তাঁর মক্কেলের ভাবমূর্তি নষ্ট করার মরিয়া চেষ্টা করছে। অভিষেক নিজেও নেতাজি ইন্ডোরে তৃণমূলের সাংগঠনিক সভা থেকে ওই বিষয়ে সিবিআইকে পাল্টা আক্রমণ করেছিলেন। ওই খবরের সূত্র ধরে অভিষেক প্রকাশ্য সভায় বলেছিলেন, ‘‘চার্জশিটে দু’বার আমার নাম আছে। কিন্তু কোনও পরিচয় নেই। সিবিআই ভাববাচ্যে কথা বলছে কেন? এই অভিষেক কে?’’

প্রাথমিক মামলায় চার্জশিটে অভিষেকের নাম থাকলেও তাঁকে এখনও তলব করেনি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। তাঁকে নিয়ে যে দাবিগুলি করা হয়েছে, সেগুলিও ‘তদন্তসাপেক্ষ’।

Primary Recruitment Case Kalighater Kaku Sujay Krishna Bhadra CBI
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy