Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

অ্যাসিডে পোড়া জীবন জুড়ে নীহারিকার আলো

চোখেমুখে অ্যাসিড-ক্ষতের দাগ ১৪ বছর ধরে ঘাড় সোজা করে বয়ে বেড়াচ্ছেন সোনালি। সাজা হয়নি অভিযু্ক্তদের এক জনেরও। হার না-মানা মেয়ের প্রেমে পড়ে তাঁর জীবনসঙ্গী হয়েছেন, তরুণ ইঞ্জিনিয়ার চিত্তরঞ্জন তিওয়ারি। আর এক বছর আগে জীবনে এসেছে এক খুদে তারা, যার নাম নীহারিকা।

খুদের জন্মদিন: দক্ষিণ কলকাতার এক রেস্তোরাঁয় মেয়ে নীহারিকার সঙ্গে সোনালি। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

খুদের জন্মদিন: দক্ষিণ কলকাতার এক রেস্তোরাঁয় মেয়ে নীহারিকার সঙ্গে সোনালি। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৩:৫১
Share: Save:

ফুটফুটে এক কন্যের এক বছরের জন্মদিন আর তার তরুণ মা-বাবা।

এটাই মোদ্দা কথা। কিন্তু এটুকু বললে কিচ্ছুটি বোঝা যাবে না। পাঁচ বছর আগে চরম হতাশায় তাঁর অ্যাসিডে পোড়া জীবন শেষ করে দিতেই মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন সোনালি মুখোপাধ্যায়। কাউকে পাশে না-পেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে স্বেচ্ছামৃত্যুর আর্জি জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন তিনি। তবে সোমবার সন্ধ্যার কলকাতা বলল অন্য কথা। বলল তাঁর জীবন কানায় কানায় ভরে ওঠার কথা।

চোখেমুখে অ্যাসিড-ক্ষতের দাগ ১৪ বছর ধরে ঘাড় সোজা করে বয়ে বেড়াচ্ছেন সোনালি। সাজা হয়নি অভিযু্ক্তদের এক জনেরও। কিন্তু ঝাড়খণ্ডের খনি অঞ্চলের মেয়ের জীবন থমকে থাকেনি। সোনালি এখন বোকারোর ডিসি অফিসের কর্মচারী। হার না-মানা মেয়ের প্রেমে পড়ে তাঁর জীবনসঙ্গী হয়েছেন, তরুণ ইঞ্জিনিয়ার চিত্তরঞ্জন তিওয়ারি। আর এক বছর আগে জীবনে এসেছে এক খুদে তারা, যার নাম নীহারিকা।

‘নীহারিকা’ নামটি যিনি রেখেছেন, সোনালির সেই ‘দাদা’ সুব্রত ঘোষই বোনের নির্দেশ মেনে ‘ভাগ্নি’র জন্মদিনের আয়োজনের পুরোভাগে। অ্যাসিড-হানায় চোখের জ্যোতি নিভে গিয়েছে সোনালির, তাই তাঁর হাত ছুঁইয়ে নীহারিকার ‘বার্থ ডে কেক’-এর গায়ে খুদে খুদে তারার সাজ ‘সুব্রতদা’ই চেনাচ্ছিলেন আদরে। জন্মদিনের পার্টির হইহুল্লোড়ের পরিবেশেও তখন কিছু চোখ চিকচিকিয়ে উঠছে। তাঁদের প্রায় সকলেই অনাত্মীয়, রক্তের সম্পর্কহীন। মেয়ের জন্মদিনের সন্ধ্যায় সোনালি ও তাঁর পরিবারকে ঘিরে থাকল এই ‘বৃহত্তর পরিবার’ই।

‘‘এত লোকের ভালবাসা ছাড়া কিছুতেই ঘুরে দাঁড়াতে পারতাম না আমি’’, বারবার বলছিলেন সোনালি। নীহারিকার প্রথম জন্মদিনটা কলকাতায় ‘কাছের জনদের’ মধ্যে কাটানোর তাগিদ সেই থেকেই। পাঁচ বছর আগে যখন কেউ ছিল না, তখন পাশে ছিলেন এই বন্ধুরাই। তাঁদেরে বেশির ভাগই কাগজে খবরটা পড়ে এগিয়ে এসেছেন। কেউ ‘ফেসবুক পেজ’ খুলে সোনালির কথা জনে-জনে পৌঁছে দিয়েছেন, কেউ জটিল সব অস্ত্রোপচারের টাকা জোগাড় বা বস্টনে সোনালিকে ডাক্তার দেখাতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন। কেউ বা রোজ ফোন করে কথা বলে নিরন্তর সাহস জুগিয়েছেন ‘বাহাদুর’ মেয়েকে!

সোনালির ‘পাতানো মামা’ মাস্কাটবাসী শৈবাল মিত্র, পেশায় স্থপতি ‘সুব্রতদা’, তাঁর ছাত্রী সোনিয়া গুহ, প্রোমোটার সৌম্য দাশগুপ্ত বা বেঙ্গালুরুর ডিজাইনার বিদিশার দাসের মতো অনেকেই ঘা-খাওয়া মেয়ের ঘুরে দাঁড়ানোর শরিক। বড়সড় প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য ছাড়াই নাগাড়ে সোনালির পাশে থেকে গিয়েছেন যাঁরা। সারা সন্ধ্যা তাঁদেরই কোলে কোলে ঘুরে বেড়াল নীহারিকা।

‘‘এক সময়ে ভাবতাম, মায়ের পুড়ে যাওয়া মুখ দেখে ও ভয় পাবে না তো! এখন আমায় দেখলেই ঝাঁপিয়ে কোলে আসতে চায় আমার পরি,’’ বললেন গর্বিত জননী। চোখে না-দেখলেও নিজের হাতে মেয়ের দেখাশোনায় ঝটপট সড়গড় হয়ে উঠেছেন সোনালি। কেক-পায়েস-খেলনা-পুতুলে সন্ধ্যার গা গড়িয়ে ঝরে ঝরে পড়ে খুশির আলো।

মেয়ের জন্মদিনের আসরই তখন মায়ের যুদ্ধজয়ের স্মারক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE