কখনও বারুইপুর, কখনও ক্যানিং। আবার কখনও পূর্বস্থলি বা ঘাটাল। একের পর এক অ্যাসিড হামলার ঘটনায় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে তরুণী, কিশোরীদের মুখ-সহ সারা শরীর। তবু অ্যাসিড হামলায় রাশ টানতে পারছে না পুলিশ-প্রশাসন।
পরিসংখ্যান বলছে, গত কয়েক বছরে এ রাজ্যে অ্যাসিড হামলার ঘটনা বেড়েছে। শুধুমাত্র দক্ষিণ ২৪ পরগনাতেই গত ১৫ ডিসেম্বর থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অ্যাসিড আক্রান্তের সংখ্যা সাত। আর প্রতি ক্ষেত্রেই ঘটনার পরে প্রশ্ন উঠছে, এত সহজে সাধারণ মানুষের হাতে অ্যাসিড পৌঁছচ্ছে কী করে? কেউ পুলিশ-প্রশাসনের নজরদারি নেই বলে অভিযোগ করছেন। কেউ আবার বলছেন, সচেতনতার অভাবের কথা।
কিন্তু বাস্তব চিত্রটা ভিন্ন। খাস কলকাতার মতো শহরে পাড়ার দোকানে অ্যাসিড কিনতে পাওয়া যায়। তা কিনতে যেমন দোকানদার পরিচয়পত্র নেন না, তেমনই কী কাজের জন্য কেনা হচ্ছে তা-ও নথিভুক্ত করা হয় না। অথচ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, শুধুমাত্র লাইসেন্সপ্রাপ্ত দোকানদারেরাই অ্যাসিড বিক্রি করতে পারবেন। তিনি কাকে তা বিক্রি করছেন, তা খাতায় স্পষ্ট লেখা থাকবে। যিনি কিনছেন, তিনি কেন কিনছেন তা-ও সেখানে জানাতে হবে। সর্বোপরি ক্রেতাকে নিজের পরিচয়পত্রের একটি ফটোকপি জমা দিতে হবে। তবে এই নির্দেশিকা কাগজে-কলমেই রয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ একাধিক বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার।
অ্যাসিড আক্রান্তদের নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি মনে করছে, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ বাস্তবে বিক্রেতারা মেনে চলেন না। আর পুলিশ-প্রশাসনেরও যে নজরদারি রাখা প্রয়োজন, অভাব রয়েছে তারও। কারণ ওই নির্দেশিকায় স্পষ্ট বলা রয়েছে, যাঁরা অ্যাসিড বিক্রির অনুমতি পান, তাঁদের তালিকা স্থানীয় পুলিশের কাছে থাকা বাধ্যতামূলক। প্রতি মাসে তালিকা দেখে এলাকার অ্যাসিড বিক্রেতাদের কাছে গিয়ে কাকে, কখন অ্যাসি়ড বিক্রি করা হচ্ছে, সেই পরিসংখ্যান নিজের কাছে রাখবে পুলিশ। কিন্তু দক্ষিণ ২৪ পরগনা তো বটেই, এ রাজ্যের কোনও জেলাতেই সেই নজরদারি নেই বলেই অভিযোগ ওই সংস্থার। এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহ-অধিকর্তা (কলকাতা) বিক্রমজিৎ সেনের পর্যবেক্ষণ অবশ্য আলাদা। তাঁর কথায়, ‘‘সম্প্রতি কিছু ঘটনার পরে অভিযুক্তদের কাছ থেকে জানা গিয়েছে, পাড়ার সোনার দোকান কিংবা ব্যাটারি কারখানা থেকে কারও মাধ্যমে অ্যাসিড জোগাড় করেছিল তারা। ফলে শুধু মাত্র লাইসেন্সপ্রাপ্ত দোকানদারদের উপরে নজরদারি রেখে সুফল মিলবে না।’’
কিন্তু সেই নজরদারিটাও তো পুলিশকেই রাখতে হবে! বিক্রমজিৎবাবুর দাবি, ‘‘আমাদের মতো সংস্থাগুলি পুলিশের সঙ্গে প্রায়ই আলোচনায় বসে। বিভিন্ন রেল স্টেশন, থানায় পোস্টার লাগিয়ে সচেতনতা বাড়ানোরও চেষ্টা করছি।’’ কিন্তু তাতেও তো হামলা কমছে না। পুলিশের এক শীর্ষকর্তা জানালেন, অ্যাসিড বিক্রির উপরে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব নয়। বাড়ির কাজে এখনও তা ব্যবহার হয়। ফলে কেউ তা কিনতে গেলে, কী উদ্দেশ্যে কিনছেন, তা পুলিশের পক্ষে জানা সম্ভব নয়।
রাজ্যের মহিলা কমিশন সূত্রের খবর, দৈনন্দিন কাজে অ্যাসিড ব্যবহার বাড়ার ফলে বাজারে অ্যাসিড তৈরির পাশাপাশি বেড়েছে তার কেনা-বেচাও। কিন্তু সেই অ্যাসিড কাকে এবং কেন বিক্রি করা হচ্ছে, কোথাও তার উল্লেখ থাকে না। এমনকী অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিক্রেতার লাইসেন্সও থাকে না। বেআইনি ভাবে অ্যাসিড বিক্রির সাজা প্রায় নেই বললেই চলে। প্রায় একশো বছরের (১৯১৯ সাল) পুরনো সেই আইন অনুযায়ী, অ্যাসিড বিক্রি করার অপরাধে কাউকে গ্রেফতার করলে তার সাজা ছ’মাস। জরিমানা মাত্র ৫০০ টাকা। ফলে বিক্রেতার উপরে কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকে না পুলিশের। অন্য দিকে, দোষীদের শাস্তি দিতে আইন সংশোধন হলেও বেশির ভাগ সময়েই পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত প্রমাণ পেশ করতে পারে না বলে অভিযোগ। এতে অভিযুক্তরাও সহজেই জামিন পেয়ে যায়। এ সব কারণে অ্যাসিড হামলা এত বেড়ে চলেছে বলে মত কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায়ের। সুনন্দাদেবী বলেন, ‘‘বাংলাদেশ এক সময়ে অ্যাসিড হামলার খবরের শিরোনামে থাকত। সেখানে আইন, বিচারব্যবস্থা এবং পুলিশ-প্রশাসনে আমূল পরিবর্তন এসেছে। তাতে এই ধরনের হামলা অনেক নিয়ন্ত্রণে। এখানেও একই পরিবর্তন দরকার।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy