Advertisement
০৩ মে ২০২৪
Abhishek Banerjee

প্রায় পাঁচ দশক পর বাংলার রাজনীতিতে ফিরে এসেছে সেই শব্দ, এক সময়ে যা মুখে মুখে ঘুরত গ্রামেগঞ্জে

যেহেতু গ্রামীণ মানুষের দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন, তাই কি এই শব্দটিকে প্রাত্যহিক রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনা হল সচেতন ভাবে? যাতে গ্রামীণ জনতার মধ্যে প্রাচীন ‘শ্রেণিঘৃণা’ জাগিয়ে তোলা যায়?

Abhishek Banerjee

রাজভবনের সামনে ধর্নামঞ্চে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। —পিটিআই।

শোভন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০২৩ ০৯:৩৫
Share: Save:

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি? না কি নতুন প্রেক্ষাপটে পুরনো শব্দের ফিরে আসা? প্রায় পাঁচ দশক আগে যে শব্দ বাংলার রাজনীতিতে উচ্চারিত হত প্রতি দিন গ্রামেগঞ্জে, ২০২৩ সালে শারদীয়ার প্রাক্কালে তা-ই ফিরে এল বঙ্গ রাজনীতির আঙিনায়। পাঁচ দশক আগে যা ছিল বামপন্থীদের মূল স্লোগান, হঠাৎ করে সেই শব্দবন্ধই এখন তৃণমূলের ‘হাতিয়ার’।

ষাটের দশকের গোড়া থেকে সত্তরের দশকের শেষ পর্যন্ত বাংলায় বামেদের স্লোগান ছিল জোতদার, জমিদারদের বিরুদ্ধে। ১০০ দিনের কাজ এবং আবাস যোজনার বকেয়া অর্থ নিয়ে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে যে সম্মুখসমর শুরু করেছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, সেখানেও উচ্চারিত হচ্ছে সেই শব্দ— ‘জমিদার’। ‘জমিদারি’।

কেন্দ্রীয় সরকার থেকে রাজ্যপাল— সকলের বিরুদ্ধেই তৃণমূল ‘জমিদারি’ শব্দটি ব্যবহার করছে। দিল্লির যন্তর মন্তর, কৃষি ভবন, মুখার্জিনগর থানা থেকে কলকাতার রাজভবনের সামনের রেড ক্রস প্লেসের ধর্নামঞ্চ— স্লোগান একটাই: জমিদারি মানব না। গত ২ অক্টোবর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত অজস্র বার ‘জমিদারি’ শব্দে বিজেপি তথা কেন্দ্রীয় সরকারকে বিদ্ধ করতে চেয়েছেন তৃণমূলের ‘সেনাপতি’ অভিষেক। কখনও জমিদারের জায়গায় বসানো হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী মোদীকে, কখনও কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী গিরিরাজ সিংহকে, কখনও কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী প্রজ্ঞা নিরঞ্জন জ্যোতিকে, কখনও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসকে।

বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে দু’টি খাদ্য আন্দোলন মাইলফলক হয়ে রয়েছে। একটি ১৯৫৯ সালে। দ্বিতীয়টি ১৯৬৬ সালে। অনেকের মতে, তৎকালীন খাদ্যসঙ্কটই জমি আন্দোলনের সলতে পাকিয়ে দিয়েছিল। ষাটের দশকের গোড়া থেকেই আমূল ভূমিসংস্কারের দাবিকে মূল রাজনৈতিক হাতিয়ার করে ফেলেছিল বামেরা। স্লোগান ছিল ‘লাঙল যার, জমি তার’, ‘জমিদার, জোতদারদের হাত থেকে বেনামি জমি উদ্ধার করে বিলি করতে হবে’ কিংবা ‘গ্রামে গ্রামে জমিদারদের বাস্তুঘুঘুর বাসা ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’। কিন্তু ১৯৬৭ এবং ১৯৬৯ সালে দু’টি যুক্তফ্রন্ট সরকার হলেও সার্বিক ভাবে ভূমিসংস্কারের পথে যেতে পারেনি বামেরা। ১৯৭৭ সালে প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের সময় তার সূচনা হয়েছিল। রাজনৈতিক মহলের অনেকের মতে, সেই জমি আন্দোলনই গ্রামবাংলায় বামেদের ‘রাজনৈতিক জমি’র ভিত শক্ত করে দিয়েছিল।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয় বদলে যায়। কিন্তু সেই রাজনীতিরই অমোঘ নিয়মে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দেখেছিল বাংলার রাজনীতি। যে জমি আন্দোলন বাংলায় বামেদের শাসন এবং সাফল্যের ভিত গড়ে দিয়েছিল, সেই জমি আন্দোলনই তাদের ৩৪ বছরের ইমারত ধসিয়ে দিয়েছিল। সৌজন্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলন। জোর করে জমি নেওয়ার সরকারি চেষ্টার বিরুদ্ধে নাছোড়বান্দা রাজনৈতিক লড়াই। রাজনৈতিক মহলের অনেকে এই বিষয়টিকে ইতিহাসের সমাপতন হিসাবেও দেখেন। তাঁদের বক্তব্য, যে জমি আন্দোলন বামেদের পালে হাওয়া দিয়েছিল ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে, সেই জমি আন্দোলনেই ২০১১ সালে মসনদ খোয়াতে হয়েছিল তাদের।

কিন্তু হঠাৎ কেন ‘জমিদারি’ শব্দটি ব্যবহার করতে শুরু করলেন অভিষেক? প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিদ্যা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান প্রশান্ত রায়ের কথায়, ‘‘সম্ভবত জমিদারি বলতে এখানে গা-জোয়ারি বোঝাতে চাওয়া হচ্ছে। হয়তো অভিধানগত দৈন্যের কারণেই এই শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে। তার জায়গায় সামন্ততান্ত্রিক বা অন্য শব্দও ব্যবহার করা যেত।’’ যে হেতু গ্রামীণ মানুষের দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন, তাই কি এই ‘জমিদারি’ শব্দটিকে ফিরিয়ে আনা হল সচেতন ভাবে? যাতে একেবারে প্রান্তিক অংশের মানুষের মধ্যে জমিদার সম্পর্কে প্রাচীন ‘শ্রেণিঘৃণা’ জাগিয়ে তোলা যায়? অধ্যাপকের জবাব, ‘‘হতে পারে সেটা একটা কারণ। তবে এর ফল উল্টো হওয়ারও একটা সম্ভাবনা রয়েছে। তৃণমূলের সঙ্গে জমিদারি মানসিকতার যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা এ ক্ষেত্রে দূরে সরে যেতে পারেন।’’

তবে এ কথা ঠিক যে, মাঝের পাঁচ দশকে জমি নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও ‘জমিদারি’ শব্দের এত ঘন ঘন উচ্চারণ বা তাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করার ঘটনা বঙ্গ রাজনীতিতে দেখা যায়নি। প্রেক্ষিত ভিন্ন হলেও পাঁচ দশক আগে যে শব্দ উচ্চারণ করতেন জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্ত, হরেকৃষ্ণ কোঙাররা, ২০২৩-এ সেই শব্দেই শান দিচ্ছেন অভিষেক। সায় দিচ্ছে ‘নতুন তৃণমূল’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE