কারাবাস থেকে মুক্তি পাওয়ার পর প্রথম বারের জন্য নিজের বিধানসভা কেন্দ্র হাবড়ায় পা রাখলেন প্রাক্তনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। দীর্ঘ ১৫ মাস পর হাবড়া বিধানসভা এলাকার তৃণমূলের কর্মীরা দেখা পেলেন তাঁদের ‘বালুদা’র। রবিবার সকাল সকাল তিনি পৌঁছে যান হাবড়ায়। দীর্ঘ অন্তরালের পর বিধায়কের আগমনের হাবড়ায় ছিল সাজ-সাজ রব। তবে ১৫ মাস আগের বালুর তুলনায় রবিবারের জ্যোতিপ্রিয়কে কিছুটা ‘ভিন্ন’ লেগেছে হাবড়াবাসীর। আগের তুলনায় অনেক সংযমী দেখিয়েছে বিধায়ককে। হাবড়া গিয়ে সর্বপ্রথম তিনি যান পুরসভার অফিসে। সেখানে কাউন্সিলরদের সঙ্গে বেশ কিছু ক্ষণ কথাও বলেন। বিধায়কের আগমনের খবরে হাবড়া বিধানসভা এলাকার চারটি জায়গায় পিকনিকের আয়োজন করেছিলেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। তাঁদের আবদার মেনে সেই সব পিকনিকেও যোগদান করবেন বলে আগেই কথা দিয়েছিলেন বালু। প্রতিশ্রুতিমতো সব অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন তিনি।
জেলমুক্তির পরেই হাবড়া বিধানসভা অপেক্ষায় ছিল বালুর। ঘনিষ্ঠমহলে জ্যোতিপ্রিয় জানিয়েছিলেন, শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাঁর নিজের বিধানসভায় যেতে সময় লাগছে। তবে আইনি কাজকর্ম একটু কমলে এবং শরীর ভাল হলেই তাঁর প্রথম গন্তব্য হবে হাবড়া। রবিবার সেই হাবড়া পুরসভার ১৬ ও ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে দু’টি পৃথক পিকনিকে অংশ নেন জ্যোতিপ্রিয়। এ ছাড়াও কুমড়ো গ্রাম পঞ্চায়েত এবং মছলন্দপুর-২ গ্রাম পঞ্চায়েতেও তৃণমূল নেতা-কর্মীদের যে পিকনিকের আয়োজন হয়েছিল তাতেও যোগদান করেছেন তিনি। তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ‘খাদ্যরসিক’ হিসেবে পরিচিত বালু। চারটি পিকনিকের আসরে গেলেও খুব বেশি খাওয়াদাওয়া করতে দেখা যায়নি তাঁকে। বরং চিকিৎসকদের পরামর্শ মেনে নিজের খাদ্যাভ্যাসে অনেক বদল এনেছেন বলেই জানিয়েছেন হাবড়ার এই প্রবীণ বিধায়ক। অনেকে বিধায়ককে রাজনৈতিক বক্তৃতা করার অনুরোধ জানালেও, তা থেকে বিরত থেকেছেন আদালতের নির্দেশের কারণেই।
আরও পড়ুন:
প্রসঙ্গত, বর্ধমানের মন্তেশ্বরের আদিবাসী না হলেও জ্যোতিপ্রিয় ছাত্রজীবন ও যৌবনকাল কেটেছে কলকাতার রাজনীতিতে। পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশেই হাল ধরেছিলেন উত্তর ২৪ পরগনা জেলার রাজনীতির। তারই ফলস্বরূপ ২০০১ সালে গাইঘাটা বিধানসভা থেকে তাঁকে প্রার্থী করেছিলেন মমতা। ২০০১ সাল তো বটেই, ২০০৬ সালেও গাইঘাটা থেকে তৃণমূলের প্রতীকে বিধায়ক হয়েছিলেন জ্যোতিপ্রিয়। আসন পুনর্বিন্যাসের কারণে গাইঘাটা তফসিলি জাতির জন্য সংরক্ষিত হলে নতুন বিধানসভা কেন্দ্রের সন্ধানে হাবড়া এসে পৌঁছন বালু। ২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদলের নির্বাচনে হাবড়া থেকেই বিধায়ক হয়ে রাজ্য মন্ত্রিসভায় খাদ্য দফতরের দায়িত্ব পান তিনি। ২০১৬ সালে দ্বিতীয় বারের জন্য হাবড়া থেকেই জয় পান তিনি। কিন্তু ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে সেই হাবড়াতেই অপ্রত্যাশিত ফলে বিমর্ষ হয়ে পড়েন বালু। বারাসত লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূল সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদার জয় পেলেও জ্যোতিপ্রিয়ের হাবড়া থেকে ১৯ হাজারের বেশি ভোটে এগিয়ে গিয়েছিল বিজেপি। অভিমানের কারণে সেই ফলাফলের পর আর হাবড়ায় দাঁড়াবেন না বলে ঘনিষ্ঠমহলে জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দলীয় নির্দেশে ২০২১ সালে আবারও হাবড়া থেকে প্রার্থী হয়ে জেতেন। তবে ১০ বছর খাদ্য দফতরের দায়িত্বে থাকার পর এ বার তাঁকে পাঠানো হয় বন দফতরের দায়িত্বে। আর ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসের রেশন দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার। এই আবহে এ বারের লোকসভা নির্বাচনেও হাবড়া থেকে লিড পেয়েছে বিজেপি। এ বার বিজেপির এগিয়ে ছিল ১৯ হাজার ৯৩৩ ভোটের।
উল্লেখ্য, জ্যোতিপ্রিয়কে রেশন দুর্নীতি মামলায় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) ২০২৩ সালের ২৭ অক্টোবর গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর তিনি প্রায় ১৪ মাস জেল হেফাজতে ছিলেন। ২০২৫ সালের ১৫ জানুয়ারি বিশেষ ইডি আদালত ৫০ লক্ষ টাকার ব্যক্তিগত বন্ড এবং ২৫ হাজার টাকার দু’টি জামিন বন্ডে শর্তসাপেক্ষে তাঁর জামিন মঞ্জুর করে। সেই দিন সন্ধ্যায় তিনি আলিপুরের প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগার থেকে মুক্তি পান এবং সল্টলেকের বাসভবনে ফিরে আসেন। জামিনের শর্ত ছিল, জ্যোতিপ্রিয়কে তদন্তকারী আধিকারিকদের সহযোগিতা করতে হবে, বিচারপ্রক্রিয়ায় নিয়মিত উপস্থিত থাকতে হবে, সাক্ষীদের প্রভাবিত করা চলবে না, পাসপোর্ট জমা রাখতে হবে এবং আদালতের অনুমতি ছাড়া রাজ্যের বাইরে যেতে পারবেন না। গ্রেফতারের প্রায় সাড়ে ৩ মাস পর, ২০২৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি, রাজ্যপাল সংবিধানের ১৬৬(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জ্যোতিপ্রিয়কে বন দফতর এবং শিল্পোদ্যোগ ও শিল্প পুনর্গঠনের দফতরের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এখনও হাবড়ার বিধায়ক পদে রয়েছেন তিনি। তাই দ্রুত নিজের বিধানসভা নিয়ে কাজ শুরু করতে চেয়েছিলেন বালু। রবিবার শীতের মরসুমের শেষ লগ্নে সেই কাজ শুরু করে দিলেন হাবড়ার তিন বারের বিধায়ক।