আদালতের নির্দেশ আগে, নাকি সরকারের নির্দেশিকা— চূড়ান্ত টানাপড়েন চলছে আয়ুষ চিকিৎসকদের মধ্যে। এবং তাঁদের নিয়োগকর্তারাও বিভ্রান্ত।
কেন্দ্রের নির্দেশিকা (২০১৩) বলছে: আয়ুষ চিকিৎসকেরা বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য কার্যক্রমে অ্যালোপ্যাথি ওষুধ লিখতে পারেন। হোমিপ্যাথি, ইউনানি আর আয়ুর্বেদ (ভারতীয় চিকিৎসা পদ্ধতি) চিকিৎসকেরা সকলেই আয়ুষ প্রকল্পের অধীন। সে-ক্ষেত্রে ওই নির্দেশিকা অনুযায়ী তাঁদের সকলেই অ্যালোপ্যাথি ওষুধ লেখার অধিকারী। কিন্তু সেটা কি সত্যিই বৈধ? ধন্দ-সংশয় এখানেই।
রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর ২০১৪-য় একটি নির্দেশিকায় জানিয়েছিল, আয়ুর্বেদ চিকিৎসকেরা ক্ষেত্রবিশেষে ও শর্তসাপেক্ষে অ্যালোপ্যাথি ওষুধ লিখতে পারেন। বিভিন্ন জাতীয় স্বাস্থ্য কর্মসূচিতে ক্যানসারের ২২টি ওষুধ ছাড়া সব ওষুধ প্রেসক্রিপশনে লেখার ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছিল আয়ুষ প্রকল্পের অন্তর্গত চিকিৎসকদেরও।
তা হলে আয়ুষ চিকিৎসকদের অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা করা এবং প্রেসক্রিপশিন লেখা নিয়ে রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিল যুদ্ধ ঘোষণা করছে কেন, সেটা মাথায় ঢুকছে না স্বাস্থ্য ভবনের অনেকেরই। স্বাস্থ্য ভবনের আয়ুষ বিভাগের কর্তারা কেন্দ্র ও রাজ্যের নির্দেশ দেখিয়ে যতই যুক্তি সাজান, মেডিক্যাল কাউন্সিল বলছে, সুপ্রিম কোর্ট ও দিল্লি হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী আয়ুষ চিকিৎসকেরা কোনও ভাবেই অ্যালোপ্যাথি প্রেসক্রিপশন লিখতে পারেন না।
‘‘সরকারি নির্দেশের কথা জানি না। আমরা পুলিশকে জানিয়েছি, সুপ্রিম কোর্ট ও দিল্লি হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী আয়ুষ চিকিৎসকেরা অ্যালোপ্যাথি ওষুধ লিখতে পারেন না,’’ বলেন রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার মানস চক্রবর্তী। যে-সব আয়ুষ চিকিৎসক অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ জানাচ্ছে রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিল।
আয়ুষ চিকিৎসকেরা জানান, সুপ্রিম কোর্টের যে-নির্দেশের কথা বলা হচ্ছে, সেটা ১৯৯৬ সালের। আর কেন্দ্র ও রাজ্যের নির্দেশিকা বেরিয়েছে তার অনেক পরে, ২০১৩ এবং ২০১৪ সালে। ২০১৬ সালের এপ্রিলে দিল্লি হাইকোর্ট ফের আয়ুষ চিকিৎসকদের অ্যালোপ্যাথি প্রেসক্রিপশন লিখতে নিষেধ করার পরেও কেন্দ্র বা রাজ্য তাদের নির্দেশিকা পরিবর্তন করেনি।
‘‘কেউ কিছু বুঝতে পারছে না,’’ মন্তব্য রাজ্য আয়ুর্বেদ কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার গৌতম দত্তের। ইউনানি কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার ইমতিয়াজ হোসেন জানান, রাজ্যের পাঁচটি অ্যালোপ্যাথি মেডিক্যাল কলেজে ইউনানি ডাক্তারেরা ইন্টার্নশিপ করেন, মডার্ন মেডিসিন ও ফার্মাকোলজি পড়েন। কাজ করেন জাতীয় স্বাস্থ্য কর্মসূচিতেও। রাজ্য সরকার ২০১৪ সালের নির্দেশিকায় জানিয়েছিল, আয়ুষ ডাক্তারেরা কোন কোন অ্যালোপ্যাথি ওষুধ লিখতে পারবেন, তা পরে জানিয়ে দেওয়া হবে। এ ব্যাপারে ওই চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনওটাই হয়নি।
আরও পড়ুন: মেধা আগলে রাখতে স্কুলেই চাকরির দিশা
কেন্দ্র এবং রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর নিজেদের নির্দেশিকা সংশোধনের কথা বলছে না। আবার মেডিক্যাল কাউন্সিলের দাবি মানা হবে কি না, তা-ও পরিষ্কার করে জানানো হচ্ছে না। ফলে ভুয়ো চিকিৎসক হিসেবে অভিযুক্ত অনেকের বিরুদ্ধে মামলা সাজাতে গিয়ে সমস্যায় পড়েছে সিআইডি। এক গোয়েন্দা অফিসার বলেন, ‘‘এই ব্যাপারে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরকে আদালতে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে।’’
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক জানাচ্ছে, আদালতের নির্দেশ আছে ঠিকই। কিন্তু জরুরি ক্ষেত্রে চিকিৎসকের অভাবে আয়ুষ চিকিৎসকেরাই ভরসা। তাই রাজ্য সরকারগুলিকেই এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়েছে। ১৩টি রাজ্য আয়ুষ চিকিৎসকদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার করছে। কয়েকটি নির্দিষ্ট রোগ ছাড়া বাকিগুলির ক্ষেত্রে অ্যালোপ্যাথির প্রেসক্রিপশন লিখতে পারছেন ওই চিকিৎসকেরা।
পশ্চিমবঙ্গের মেডিক্যাল কাউন্সিল অবশ্য কেন্দ্রের ওই মনোভাবের বিরোধী। চিকিৎসক সংগঠন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য শাখা রয়েছে রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের দিকেই। রাজ্য সরকার কী করবে? প্রশ্ন শুনেই ‘ব্যস্ত আছি’ বলে ফোন রেখে দেন স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী। স্বাস্থ্যসচিব রাজেন্দ্র শুক্ল ফোন ধরেননি, এসএমএসেরও জবাব দেননি। আর স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy