দেশে চলছে যুদ্ধ। যুদ্ধ তাঁর জীবনেও।
ইরানের তেহরানের বাসিন্দা বছর বাষট্টির ফুলগিয়াসি সারা নাবালক ছেলেকে বৃদ্ধা মায়ের কাছে রেখে আসতে বাধ্য হয়েছেন ভারতে। কারণ, পূর্ব বর্ধমানের কালনায় তাঁর স্বামী ও এক নাবালক ছেলেকে চুরির অভিযোগে ধরেছে পুলিশ। পর্যটক-ভিসার মেয়াদও শেষ তাঁদের। সারার চিন্তা, এক দিকে স্বামী-ছেলে জামিন পাচ্ছেন না, তাঁর নিজের পর্যটক ভিসার মেয়াদ ফুরোতেও দিন দশেক বাকি। অন্য দিকে, তেহরানে ইজ়রায়েলের যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্রের হামলা। তাঁর কথায়, “কী করব, কোথায় যাব, বুঝতে পারছি না!”
পুলিশ জানিয়েছে, গত ১৬ মে মন্তেশ্বরের ঘোড়াডাঙার বুদ্ধদেব হাজরা অভিযোগ করেন, তাঁর গয়নার দোকানে সোনার গয়না দেখার নাম করে তা নিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন দুই অপরিচিত। স্থানীয়দের সাহায্যে তেহরানের বাসিন্দা আল মাহবুবি ও তাঁর ১৫ বছরের ছেলেকে তুলে দেওয়া হয় পুলিশের হাতে। তখন থেকেই মাহবুবি জেলে। নাবালককে পাঠানো হয় হোমে। আইনজীবী ইন্দ্রজিৎ চক্রবর্তী বলেন, “প্রথমে পুলিশ চুরির মামলা করেছিল। পরে, বিদেশি আইনের ১৪-এ ধারা যোগ হয়।” শুক্রবার কালনা আদালতের বিচারক মাহবুবিকে ১৪ দিনের পুলিশ হেফাজতে পাঠান।
আদালত চত্বরে কাঁদতে দেখা যায় সারাকে। জানান, তেহরানে বুটিকের ব্যবসা তাঁদের। আগেও তাঁরা ভারতে এসেছেন। দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে। এ বার তাঁর স্বামী, বড় ছেলেকে নিয়ে ভারতে বেড়াতে এসেছিলেন। মাসখানেক আগে তাঁদের গ্রেফতার হওয়ার খবর পেয়ে এক মাসের পর্যটক ভিসায় ভারতে আসেন সারা। তার মধ্যেই ইজ়রায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায় ইরান। সারা বলেন, “তেহরানে ইন্টারনেট বন্ধ। টাকা পাঠাতে পারছেন না আত্মীয়েরা। ভিসার মেয়াদ দিন দশেকও নেই। মায়ের কাছে ছোট ছেলেকে রেখে এসেছি। এখানে ছেলে হোমে, স্বামী জেলে। বিপদে পড়েছি।”
তাঁর দাবি, দিল্লি থেকে ছেলেকে নিয়ে স্বামী কলকাতায় এসেছিলেন। সেখান থেকে গাড়িতে দিল্লি ফিরছিলেন। পথে বর্ধমানের মন্তেশ্বরে সোনার জিনিস কিনতে দাঁড়ান। সঙ্গে আমেরিকান ডলার ছিল। বাবা-ছেলে গয়না চুরির চেষ্টা করেননি। তবে ভিসার মেয়াদ ফুরোনোর কথা খেয়াল ছিল না তাঁদের।
আদালত চত্বরে সারার সঙ্গে ছিলেন কলকাতার শিয়ালদহের বাসিন্দা ঐশিক দাস। আল মাহবুবি কলকাতা থেকে যে গাড়ি নিয়েছিলেন, তার চালক মারফত ঘটনা জেনে এ দিন এক আইনজীবীকে সঙ্গে নিয়ে আদালতে এসেছিলেন ঐশিক। তিনি বলেন, “সারা কলকাতায় একটি হোটেলে উঠেছেন। ওঁর হাতে বিশেষ টাকা নেই। মামলার জট কাটিয়ে স্বদেশে ফেরার জন্য ওঁকে যেটুকু সাহায্য করা যায়, করছি।” আইনজীবীরা জানান, আল মাহবুবি এবং তাঁর ছেলের ভিসার মেয়াদ শেষ না হলে, জটিলতা কিছুটা কম হত। সাধারণত, এ সব ক্ষেত্রে ইরানের ভারতীয় দূতাবাসে খবর পাঠিয়ে তথ্য চাওয়া হয়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তা কত দূর সম্ভব হবে, তা নিয়ে ধন্দ রয়েছে। হাই কোর্টে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে জানান ঐশিক।
সারা বলেন, “ছেলে, স্বামীকে নিয়ে দেশে ফিরতে চাই। ওখানে সবার পথ চেয়ে বসে আছে ছোট ছেলে।”
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)