ধান কেটে নেওয়ার পরে গোড়া থেকে কয়েক ইঞ্চি থেকে যায় জমিতে। হাতে কাটা হোক বা যন্ত্র কোনওটাতেই গোড়া থেকে তোলা যায় না গাছ। বছরের পর বছর ধরে সেই অংশে আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার অভ্যাস রয়েছে চাষিদের। নাড়ার সেই আগুনে ধ্বংস হয়ে যায় জমিতে থাকা কীটপতঙ্গ। জমির উপরিভাগ কালো হয়ে যায়। পরিবেশেরও ক্ষতি হয়। তবুও দেশলাই জ্বালিয়ে জমির স্বাস্থ্যের কথা না ভেবে সেটাই চাষিদের অভ্যাস।
এখন ধান কাটার জন্য খরিফ মরসুমেও ‘কম্বাইন্ড হারভেস্টর’ যন্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। আমনেও নাড়া পোড়ানো দিন দিন বাড়ছে, যা চিন্তা বাড়িয়েছে রাজ্য সরকারের। প্রচার, সচেতনতার পাশাপাশি কী ভাবে বিকল্প ব্যবস্থার মাধ্যমে নাড়া নষ্ট করা যায় তারও গবেষণা শুরু হয়েছে।
গত বছর মেমারির কলানবগ্রামে নাড়া পোড়াতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গিয়ে এক চাষির মৃত্যু হয়। সেই ঘটনাকে সামনে রেখে কৃষি দফতর নাড়া পোড়ানোর বিরুদ্ধে প্রচারেও নেমেছিল। কিন্তু ঘটনা হল, দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের দু’ধার কিংবা আউশগ্রাম থেকে কালনা পর্যন্ত জমির দিকে তাকালেই বোঝা যাবে চাষিরা সচেতন নন। নাড়া পোড়ানো যেন অধিকারে দাঁড়িয়ে গিয়েছে!
কৃষি দফতর ও চাষিদের দাবি, যন্ত্রে ধান কাটার পরে অপেক্ষাকৃত বড় গোড়া পড়ে থাকছে জমিতে। ধান ঝাড়ার পরে প্রচুর খড় পড়ে থাকছে। খড়খড়ে, শক্ত সে সব জিনিস আক্ষরিক অর্থে গরুও ছুঁয়ে দেখে না। ওই সব পরিষ্কার করার জন্য পর্যাপ্ত শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। আবার শ্রমিক মিললেও অনেক বেশি মজুরি দিতে হচ্ছে। তাতে চাষের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। কৃষি দফতর বিকল্প পদ্ধতিতে নাড়া নষ্ট করে জৈব সার তৈরির পরামর্শ দিলেও তা সময় সাপেক্ষ। ফলে, ধান ওঠার পরে সেই জমিতে আলু, সর্ষে কিংবা অন্য কোনও অর্থকরী ফসল চাষ করতে দেরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার অনেক চাষির মতে,এতে জমি ভাল হয়। তাঁদের দাবি, ‘‘আগে তো পোকামাকড় মারতে আগুন দেওয়াই রীতি ছিল। আমাদের বাবা-কাকারাও তাই করেছেন।’’ তাই খরচ ও সময় বাঁচাতে এখনও সেই পথেই হাঁটছেন তাঁরা। ‘নাড়া’ পোড়ালে কী হয়?
কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানান, দীপাবলি পার করার পরেই শীতের আমেজ শুরু হয়ে যায়। শীতে ভাসমান শ্বাসযোগ্য কণা (রেসপিরেবল সাসপেন্ডেড পার্টিকুলার ম্যাটার) বেড়ে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার উপরে নাড়া পোড়ানো পূর্ব বর্ধমানের বাসিন্দাদের কাছও আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। গুসকরা শহরের বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, নাড়া পোড়ানোর কালো ধোঁয়াই অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। বিজ্ঞান মঞ্চের গুসকরার সম্পাদক অমল দাসের দাবি, নাড়া পোড়ালে আখেরে চাষিদেরই ক্ষতি।
কৃষি বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, চাষের জন্য জমির ছ’ইঞ্চি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আগুনে সব থেকে ক্ষতি হয় জমির ওই অংশের। বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৌশিক ব্রহ্মচারী বলেন, “নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সালফার-সহ ১৭টি মৌল গাছের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এগুলি গাছের মধ্যেই থাকে। নাড়া পোড়ানোর ফলে ওই সব মৌল বিষাক্ত গ্যাসে পরিণত হয়ে বাতাসে মিশছে।” চিকিৎসকেরা জানান, ওই গ্যাস ফুসফুসকে কষ্ট দেয়। কীটতত্ত্ববিদরা জানান, আগুনে উপকারী পোকা, জীবাণু নষ্ট হয়ে যায়। ঘুমন্ত অবস্থায় মাটির ভিতরে থাকা বন্ধু কীট পুড়ে যায়। আদতে চাষেরই ক্ষতি হয়।
জেলার উপ কৃষি অধিকর্তা (প্রশাসন) নকুল মাইতির দাবি, “চাষিদের সচেতন করা হচ্ছে। নাড়া পোড়ানো উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে। বিক্ষিপ্ত ভাবে যা চলছে, সেটাও বন্ধ করতে পদক্ষেপ করা হচ্ছে।”
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)