সে দিনের পর থেকে ফাঁকাই পড়ে আছে বাড়িটি, দেখাচ্ছেন পূর্ণিমাদেবীর ছেলে মাখন। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।
তখন সন্ধ্যা নেমেছে। শাঁখ বাজছে ঘরে ঘরে। পূর্ণিমাদেবীও মাথায় আঁচল দিয়ে তুলসীতলায় প্রদীপ দিচ্ছিলেন। হঠাৎ চিৎকার-দৌড়াদৌড়ি-বোমার শব্দ, বিপদ আন্দাজ করে কোনও রকমে ছেলে-স্বামীকে ঠেলে দিয়েছিলেন পাঁচিলের বাইরে। কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে পারেননি। উঠোনে পরপর ছোড়া বোমায় আঘাত পান তিনি তিনি। দীর্ঘক্ষণ রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয়।
ঘটনাস্থল, মঙ্গলকোটের খেঁড়ুয়া। দিন, ২০১০ সালের ২৯ নভেম্বর। মায়ের জোরাজুরিতে সে দিন বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলেও পরের দিনই ছেলে মাখন মাঝি মঙ্গলকোট থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগে তিনি জানিয়েছিলেন, ছ’জনের নেতৃত্বে ২৭ জন বাড়িতে হামলা চালিয়েছিল ওই দিন। তারাই বোমা ছুড়ে মাকে খুন করেছে। তৃণমূল কর্মী মাখনবাবু অভিযোগে সিপিএমের তৎকালীন লোকাল কমিটির সম্পাদক কিরীটি ঘোষ, খেঁড়ুয়া গ্রামের নেতা অশোক ঘোষের নামও ছিল। তবে ছ’বছর পরেও কাটোয়া আদালতে বিচারই শুরু হয়নি মামলার। কারণ, সাক্ষী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের গরহাজিরা।
অথচ ঘটনার তিন মাসের মধ্যে মঙ্গলকোট থানার তদন্তকারী অফিসার শরৎ চট্টরাজ আদালতে চার্জশিট জমা দিয়েছেন। সেখানে ছ’জন প্রত্যক্ষদর্শী-সহ ১৫ জনকে সাক্ষী করেছেন তদন্তকারী অফিসার। তারপরেও আদালতের দীর্ঘসূত্রতা ও আইনের ফাঁক গলে সমস্ত অভিযুক্ত নির্দিষ্ট দিনে আদালতে হাজির থাকছেন না, বলে আইনজীবীদের দাবি। স্বাভাবিক ভাবেই পিছিয়ে যাচ্ছে বিচারের সময়।
মাখনবাবু জানান, ওই দিন খুদরুনে মঙ্গলকোট বিধানসভার বুথভিত্তিক বৈঠক সেরে বাড়ি ফিরেছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই এক দল দুষ্কৃতী তাঁদের বাড়িতে হামলা চালায়। ভয়ে তিনি পাঁচিল টপকে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। স্বামী শিশিরবাবুকেও জোর করে বের করে দিয়েছিলেন পূর্ণিমাদেবী। দুষ্কৃতীদের ছোড়া একের পর এক বোমা পড়তে থাকে উঠোনে। রক্তাক্ত অবস্থায় দীর্ঘক্ষণ পড়েছিলেন মাঝবয়েসী মহিলা। বেশ কিছু্ক্ষণ পরে ওই দুষ্কৃতীরা চলে গেলে পড়শিদের সাহায্যে বাড়ি ফেরেন মাখনবাবু। ফিরে দেখেন মা আর নেই। মাখনবাবু বলেন, “ওই সময় আমরা মাসের পর মাস বাড়িছাড়া ছিলাম। অনেক অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। আমাকে বাঁচাতে গিয়ে মায়ের প্রাণটাও চলে গেল। এখন যদি খুনিদের সাজা না হয়, তাঁরা যদি বুক ফুলিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, কত কষ্ট হয়। কিছুই ভাল লাগে না!” মাখনের বাবা শিশিরবাবু বলেন, “আমাকে ও (পূর্ণিমাদেবী) জোর করে পাঁচিল টপকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য করে। যেতে যেতেই শুনতে পাই পরপর বোম পড়ছে।’’
• ২০১০ সালের ২৯ নভেম্বর মঙ্গলকোটের খেঁড়ুয়া গ্রামে বাড়িতেই পরপর ছোড়া বোমার আঘাতে মৃত্যু হয় তৃণমূল কর্মী মাখন মাঝির মা পূর্ণিমাদেবীর।
• সিপিএমের লোকাল কমিটির নেতা, স্থানীয় নেতা-সহ ২৪ জনের নামে অভিযোগ হয় পরের দিন।
• তিন মাসের মধ্যে চার্জশিট জমা দেন তদন্তকারী অফিসার।
• সাক্ষী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা নির্দিষ্ট দিনে হাজির না থাকায় ছ’বছর পরেও বিচার শুরু হয়নি মামলার।
পুলিশ জানিয়েছে, রাজনৈতিক সংঘর্ষে খেঁড়ুয়া তখন উত্তপ্ত। সিপিএম-বিরোধীরা গ্রামছাড়া। তার মধ্যেও মনে সাহস নিয়ে মাখন মাঝি সহ কয়েকজন গ্রামে ফিরেছিলেন। ‘প্রতিরোধ বাহিনীও’ গড়ে তুলেছিলেন তাঁরা। সেই খবর তৎকালীন শাসক দলের কাছে যায়। ২৯ নভেম্বর ছিল নবান্ন উৎসব। সেই দিনই লোকজন জড়ো করে হাতে ধারালো অস্ত্র ও বোমা নিয়ে আক্রমণ করা হয়। ঘটনাস্থলের কাছে পুলিশ ক্যাম্প থাকলেও কিছুই করার ছিল না তাদের। ওই গ্রামের তৃণমূলের নেতা দেবকুমার ধারা বলেন, “আমরা বা আমাদের গ্রাম যে নৃশংসতা দেখেছে, তা যেন স্বপ্নেও ফিরে না আসে। আমরা চাই দোষীদের উপযুক্ত সাজা হোক।” আইনজীবীরা জানিয়েছেন, তদন্তকারী অফিসার ঘটনাস্থল থেকে রক্ত মাখা মাটি, বোমার টুকরো, বোমা তৈরির উপকরণ উদ্ধার করলেও তদন্তে অনেক গাফিলতি করেছেন। বাজেয়াপ্ত করা সামগ্রী ও পূর্ণিমাদেবীর আঘাতের জায়গার চুল সংগ্রহ করে ফরেন্সিক রিপোর্ট সংগ্রহ করেননি। বর্তমান সময়ে ফরেন্সিক রিপোর্ট আদালতের কাছে খুবই গুরুত্বর্পূ বিষয়।
৬ বছরে গ্রাম অনেক বদলেছে। কিন্তু বদলায়নি পূর্ণিমাদেবীর বাড়ির চেহারা। দু’কামরার মাটির বাড়ি, সামনের উঠোন এখনও রয়েছে। তবে তুলসীতলায় আর প্রদীপ জ্বলে না। কারণ তুলসীতলাটাই নেই! পূর্ণিমাদেবীর পারলৌকিক কাজ মিটে যাওয়ার পর থেকে ওই বাড়িতে মাখনবাবুরাও রাত্রিবাস করেন না। শিশিরবাবু বলেন, “যে আমাদের বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দিয়ে দিল, সেই বাড়িতে আমরা কোন ভালবাসায় থাকব?” পূর্ণিমাদেবীর বাড়িতে তাই নিত্য অমাবস্যা!
“যে দিন দোষীরা সাজা পাবে, সেই দিন ফের এই অন্ধকার বাড়িতে আলো জ্বলবে”— উঠোনে দাঁড়িয়ে বলে ওঠেন মাখনবাবু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy