রাতে প্রসব যন্ত্রণা নিয়ে মাহাতা গ্রামের এক প্রসূতী ভর্তি হন ভাতার গ্রামীণ হাসপাতালে। বেশ কিছুক্ষণ থাকার পরে নার্সরা ওই প্রসূতির পরিজনদের জানান, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় অস্ত্রোপচার করা সম্ভব নয়। রাতেই তাঁকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বাধ্য হন ওই খেতমজুর পরিবার।
মঙ্গলকোটের সিঙ্গত গ্রামীণ হাসপাতালেও অস্ত্রোপচারের জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্র রয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় কোনও প্রসূতিরই অস্ত্রোপচার হয় না। অগত্যা বছরের পর বছর ধুলো জমছে সেই সব যন্ত্রে।
জেলার সবচেয়ে বড় গ্রামীণ হাসপাতাল রয়েছে মেমারিতে। শহরের ভিতর হাসপাতাল হওয়ার জন্য রোগী, প্রসূতিদের চাপ সবসময়ই থাকে। কিন্তু এখানেও ওই কোনও স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। ফলে পরিকাঠামো থাকলেও সপ্তাহে একদিন মাত্র অস্ত্রোপচার হয়। তার মধ্যেও অ্যানাস্থেটিস্টের অভাব থাকায় প্রসূতিদের পরিষেবা দেওয়া সম্ভব হয় না। ভরসা সেই বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।
দেখা যাচ্ছে, জেলায় ৭১টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ১৩টি গ্রামীণ হাসপাতাল, ১০টি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকার পরেও রোগীদের ছুটতে হচ্ছে সেই বর্ধমান মেডিক্যালে। কারণ, সেই চিকিৎসকের অভাব। এলাকার মানুষজনেরাও জানান, আগে হাসপাতাল ভবনগুলি বেহাল ছিল। ছাদ দিয়ে জল পড়ত, বসার জায়গা ছিল না। এখন হাসপাতালের চেহারা পাল্টালেও সাধারণ মানুষের কোনও উপকার হয়নি। কারণ, চিকিৎসক ছাড়া হাসপাতাল ভবনের কোনও দাম নেই।
জেলা স্বাস্থ্য দফতরের রিপোর্টও বলে, রায়না ২ ব্লকের মাধবডিহিতে ৩০ শয্যার হাসপাতাল চলে শুধুমাত্র বিএমওএইচের ভরসায়। এখানে দু’জন সাধারণ চিকিৎসকের অনুমোদন থাকলেও রোগীরা কারও দেখা পান না। অন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিরও ভরসা নার্স কিংবা ফার্মাসিস্টরা। মেমারি ২ ব্লকের বড়পলাশন, রায়না ১ ব্লকের নারুগ্রাম, বিনোদপুর, খণ্ডঘোষের খুদকুরি, ভাতারের বলগোনা, পূর্বস্থলী ২ ব্লকের নিমদহ, সিঙ্গরি, কাটোয়া ১ ব্লকের চন্দ্রপুর, কৈথন, কেতুগ্রাম ১ ব্লকে আনখোনা ও কেতুগ্রাম ২ ব্লকের সিতাহাটি ও শিবলুনেও কোনও চিকিৎসকই নেই। অগত্যা জোড়াতালি দিয়ে চলছে চিকিৎসা ব্যবস্থা।
চিকিৎসক চলে গেলে আর পাওয়া যাবে না, এই শঙ্কায় অনেক জায়গায় গ্রামবাসীদের চিকিৎসককে ছাড়তে না চাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। কাটোয়া ২ ব্লকের নওয়াপাড়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই চিকিৎসককে ছাড়েননি বাসিন্দারা। আবার চিকিৎসকের দাবিতে পথ অবরোধও হয়েছে বেশ কিছু জায়গায়। পরিস্থতি সামাল দিতে ছুটে যেতে হয়েছে জেলার স্বাস্থ্য কর্তাদের। তাঁদের কথায়, “খাতায় কলমে চিকিৎসক থাকলেও অনেক স্বাস্থ্যকেন্দ্র দিনের পর দিন চিকিৎসক নেই। ওই সব স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসকরা উচ্চ শিক্ষার জন্য ছুটি নেওয়ায় নতুন কোনও চিকিৎসককে স্থায়ী ভাবে পাঠানোও যাচ্ছে না। আবার বাড়ির কাছে হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা না পেয়ে স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিচ্ছে।”
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা যায়, বেশিরভাগ ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে উন্নীত করে ১৫ থেকে ৩০ শয্যার গ্রামীণ হাসপাতালে পরিণত করা হয়েছে। তেমনি বেশ কিছু প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে ৬ থেকে ১০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের লাভ হয়েছএ কি না, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা বলেন, “চিকিৎসক না থাকলে কী করে লাভ হবে। সবটাই খাতা কলমে রয়ে গিয়েছে। অন্তর্বিভাগের জায়গাতে আগের মতো বহির্বিভাগই চালু রয়েছে।”
স্বাস্থ্য দফতরের রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্ধমানের গ্রামীণ হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্র মিলিয়ে ১১৩৮টি শয্যার জন্য চিকিৎসক থাকার কথা ১৯৬ জন। সেখানে রয়েছেন ১১৮ জন। শুধু তাই নয়, অনুমোদন থাকার পরেও গ্রামীণ হাসপাতাল ও স্বাস্থকেন্দ্রগুলিতে একজনও প্রসূতি, অ্যানাস্থেটিস্ট বা শিশু চিকিৎসক নেই। একাধিক হাসপাতালের নার্সদের দাবি, “আমাদের ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। পান থেকে চুন খসলেই তো যত তোপ আমাদের উপর। চিকিৎসকবিহীন অবস্থায় কী ভাবে দিনের পর দিন স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতাল চালানো সম্ভব?”
জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ নারায়ণ হাজরা চৌধুরীর দাবি, “জেলা জুড়ে প্রসূতিদের হাসপাতালে এসে প্রসব করানোর কথা বলছি। প্রচারে ও সচেতনতায় আমাদের জেলায় বাড়িতে শিশুপ্রসবের হার একদম তলানিতে পৌঁছে গিয়েছে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে জেলা জুড়ে চিকিৎসক-সঙ্কট খুবই বেদনাদায়ক।” জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক প্রণব রায়েরও আশা, খুব দ্রুত এই সমস্যা কেটে যাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy