Advertisement
০৬ মে ২০২৪

‘বড় সাহেবদের দাপট চলছেই’

বিশেষ সূত্রে জানা যায়, ‘বড় সাহেব’ অর্থাৎ, কয়লা-মাফিয়াদের ‘মালিকানা’ রয়েছে এই খনিগুলিতে। কুয়ো খাদের ক্ষেত্রে সাধারণ ভাবে ১৫০ ফুট খনন করা হয়। এই কারবারের সঙ্গে জড়িয়ে বিশেষ কিছু সাঙ্কেতিক পরিচয়ও।

অনিয়ম: স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, অবৈধ ভাবে কয়লা কেটে এ ভাবেই চলে পরিবহণ। চুরুলিয়ায়। ছবি: ওমপ্রকাশ সিংহ

অনিয়ম: স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, অবৈধ ভাবে কয়লা কেটে এ ভাবেই চলে পরিবহণ। চুরুলিয়ায়। ছবি: ওমপ্রকাশ সিংহ

নীলোৎপল রায়চৌধুরী
জামুড়িয়া শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৮ ০১:৫৬
Share: Save:

ঘটনা এক: ২০১৭-র জুলাই। আচমকা দেখা গেল, জামুড়িয়ার নিউকেন্দা এলাকায় পরিত্যক্ত খোলামুখ খনিতে আগুন। অস্থায়ী পুনর্বাসন দিতে হয় লাগোয়া এলাকার প্রায় দু’শো বাসিন্দাকে।

ঘটনা দুই: চলতি বছরের অগস্ট। টানা কয়েক দিন আগুন দেখা গেল খনিতে। এ বার ঘটনাস্থল, চুরুলিয়া। এলাকাবাসী শ্বাসকষ্টের অভিযোগও করলেন।

ঘটনা তিন: চলতি মাসে নর্থ সিহারসোল খোলামুখ খনি এলাকায় হেনস্থার অভিযোগ করলেন খনিরই এক নিরাপত্তারক্ষী। — সবকটি ঘটনারই নেপথ্যে একটাই অভিযোগ, এলাকায় কয়লার অবৈধ খনন চলছেই। তার জেরেই প্রভাব পড়ছে বৈধ খননে, জীবন-জীবিকায় ও পরিবেশে। সোমবারই ঝাড়গ্রামের প্রশাসনিক সভা থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্য জুড়ে সব বেআইনি খাদান বন্ধ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু আসানসোল-রানিগঞ্জ-জামুড়িয়া শিল্পাঞ্চলে অবৈধ খননে লাগাম পড়েনি বলেই অভিযোগ বিরোধী দল ও শ্রমিক সংগঠনগুলির।

সিপিএম, কংগ্রেস ও বিজেপি নেতৃত্বের অভিযোগ, রানিগঞ্জের তৃপ্তিগড়িয়া, হাড়াভাঙা, রতিবাটি স্টাফ কোয়ার্টার, বক্তারনগর গ্রামে, নারায়ণকুড়ি, জামুড়িয়ার শ্রীপুর, আসানসোল দক্ষিণের কাল্লা, বারাবনি, অণ্ডালের কাজোড়া লাগোয়া জেকে রোপওয়েজের কাছে ২ নম্বর জাতীয় সড়কের অদূরে রীতিমতো মাটিকাটার যন্ত্র দিয়ে অবৈধ খোলামুখ খনি চলছে। রয়েছে কয়েক হাজার কুয়ো খাদও।

কী ভাবে চলে এই খনিগুলি? বিশেষ সূত্রে জানা যায়, ‘বড় সাহেব’ অর্থাৎ, কয়লা-মাফিয়াদের ‘মালিকানা’ রয়েছে এই খনিগুলিতে। কুয়ো খাদের ক্ষেত্রে সাধারণ ভাবে ১৫০ ফুট খনন করা হয়। এই কারবারের সঙ্গে জড়িয়ে বিশেষ কিছু সাঙ্কেতিক পরিচয়ও। যেমন, ‘মালকাট্টা’ (সুড়ঙ্গে ঢুকে গাঁইতি দিয়ে কয়লার স্তর কেটে ঝুড়িতে ভরেন যাঁরা), ‘ঝিকাপার্টি’ (খননস্থল থেকে ঝুড়ি-ভর্তি কয়লা সুড়ঙ্গের মুখ পর্যন্ত যাঁরা বয়ে আনেন), ‘রসাটানা’ (সুড়ঙ্গের মুখ থেকে কয়লার ঝুড়ি কপিকলের সাহায্যে কুয়ো থেকে যাঁরা উপরে তোলেন) ইত্যাদি। কাজভেদে প্রত্যেকের মজুরি আলাদা। বৈধ খনির মতো এখানেও কাজের ‘পালি’ রয়েছে। বিশেষ সূত্রে জানা যায়, এই অবৈধ কয়লার ক্রেতা রয়েছে এলাকাতেই। বেশ কিছু ছোট কারখানার মালিক জানান, ইসিএলের প্রতি টন বৈধ কয়লার দাম ছ’হাজার টাকার বেশি। সেখানে অবৈধ কয়লার এক টনের দাম, চার হাজার টাকা।

কিন্তু যাঁরা এই কয়লা কাটেন তাঁদের পকেট ভরলেও জীবনের ঝুঁকি রয়েছেই, জানান শ্রমিক নেতৃত্ব। আর এর প্রভাব পড়ছে এলাকায়। যেমন, চুরুলিয়ায় শ্বাসকষ্টের অভিযোগ উঠেছিল। নিউ কেন্দায় খনিরক্ষায় আবার পাহারা দিতে দেখা গিয়েছিল বৈধ খনির কর্মীদের। তার পরেও অনেক সময়ে চাষযোগ্য জমিতেও খনন চলেছে বলে অভিজ্ঞতা এলাকাবাসীর। কাজোড়ার বাসিন্দা ননীগোপাল চক্রবর্তী জানান, নবকাজোড়ায় তাঁদের পারিবারিক জমির পাশেই অবৈধ খননের জেরে ভূগর্ভের জল শুকিয়ে যায়। বছরখানেক ধরে চাষ করা যাচ্ছে না। রাসকোলের গঙ্গারাম চক্রবর্তী, ধীরেন চক্রবর্তীরা জানান, অবৈধ খননের জেরে পরিবারের চাষযোগ্য জমি প্রায় হাতছাড়া হওয়ার জোগাড়।

মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পরে এলাকার বিরোধী দলগুলি অবশ্য শাসক দলের বিরুদ্ধেই এই কারবারের জড়িত থাকার অভিযোগ করেছে। সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তুফান মণ্ডল, কংগ্রেসের প্রদেশ কমিটির সদস্য বিশ্বনাথ যাদবেরা বলেন, ‘‘এই অবৈধ কারবারে মদত রয়েছে তৃণমূলের নেতাদেরই। আর তাই ‘বড় সাহেব’দের দাপট চলছেই।’’ যদিও অভিযোগ অস্বীকার করে তৃণমূলের জেলা সভাপতি ভি শিবদাসন বলেন, “বামফ্রন্টের আমলেই কয়লাচোরদের রমরমা বাড়ে। আমাদের সরকারই তা বন্ধ করেছে।’’

তবে ইসিএলের সিএমডি-র কারিগরি সচিব নীলাদ্রি রায় বলেন, ‘‘অবৈধ খনন দেখলেই পুলিশে অভিযোগ করা হয়। আমরা নিজেরাও অভিযান চালাচ্ছি।’’ আসানসোল-দুর্গাপুরের পুলিশ কমিশনার লক্ষ্মীনারায়ণ মিনার বক্তব্য, ‘‘কোথাও কোনও অবৈধ খনন হচ্ছে না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jamuria Coal Mafia
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE