Advertisement
E-Paper

ছবি দেখে দেশের হাল জানতেন রাজা

পশ্চাৎপটে সমুদ্র রেখে কাঁধে হাত দিয়ে ছবি তোলার জন্য একসময় হাসিমুখে স্টুডিওর সামনে অপেক্ষা করতেন নবদম্পতি। ক্যামেরার খুঁটিনাটি শিখতে নামী আলোকচিত্রীদের স্টুডিওতে সকাল-সন্ধ্যে হত্যে দিতেন উঠতিরা।আর এখন নিত্যনতুন মোবাইল ক্যামেরা, ফোটোশপ, এসএলআর হাতে সবাই শিল্পী। বন্ধ হয়ে গিয়েছে বেশির ভাগ স্টুডিও। যে ক’টি টিমটিম করে চলছে তাও ঝাঁপ ফেলবে যে কোনও দিন।

উদিত সিংহ

শেষ আপডেট: ১৮ অগস্ট ২০১৫ ০২:০৯
৭০-র দশকে, নারায়ণ দাসের তোলা, ডানদিকে রধারানি দেবী, বিজয়চাঁদের স্ত্রী।

৭০-র দশকে, নারায়ণ দাসের তোলা, ডানদিকে রধারানি দেবী, বিজয়চাঁদের স্ত্রী।

পশ্চাৎপটে সমুদ্র রেখে কাঁধে হাত দিয়ে ছবি তোলার জন্য একসময় হাসিমুখে স্টুডিওর সামনে অপেক্ষা করতেন নবদম্পতি। ক্যামেরার খুঁটিনাটি শিখতে নামী আলোকচিত্রীদের স্টুডিওতে সকাল-সন্ধ্যে হত্যে দিতেন উঠতিরা।আর এখন নিত্যনতুন মোবাইল ক্যামেরা, ফোটোশপ, এসএলআর হাতে সবাই শিল্পী। বন্ধ হয়ে গিয়েছে বেশির ভাগ স্টুডিও। যে ক’টি টিমটিম করে চলছে তাও ঝাঁপ ফেলবে যে কোনও দিন।
বর্ধমানের এক পুরনো আলোকচিত্রী পঞ্চানন মুখোপাধ্যায় প্রায় চার দশক ধরে ছবির নেশায় মগ্ন। তিনিই জানালেন ফ্লাশ আসার আগে রাতে ক্যামেরায় ছবি তোলা হতো কীভাবে। বললেন, ‘‘সাবেক বর্ধমানে ২৭৫ টাকা দামের আইসোল ২ ক্যামেরার খুব চল ছিল। নির্দিষ্ট ফোকাসের এই ক্যামেরাতেই বিয়েবাড়ি থেকে সমস্ত অনুষ্ঠানের ছবি তোলা হতো। আর রাতে ম্যাগনিফায়িং পাউডার ছড়িয়ে তুবড়ির মতো আলো জ্বালিয়ে ছবি তোলা হতো, তাতেই অন্ধকারেও ছবি উঠত। অনেকে আবার দড়ি-বাতি জ্বালিয়েও ফ্ল্যাশের মতো ব্যবহার করতেন।’’ এরপরে আসে বাল্ব ব্যাটারি দিয়ে আলো জ্বালনো। এ ছাড়া বর্ধমানের রাজাদের এল-প্লেট ক্যামেরা স্ট্যান্ডে বসিয়ে কালো কাপড় দিয়ে ঘিরেও ছবি তোলা হতো।
স্মৃতি হাতড়ে জানালেন, রানিগঞ্জ বাজার, বিচিত্রা সিনেমার গলি, বিসি রোড— এ সব জায়গায় এক সময় পরপর স্টুডিও ছিল। এখন অবশ্য সেই সেন আর্ট স্টুডিও, নাগ স্টুডিও সবই বন্ধ। ভোল বদলে টিকে আছে প্রীতি স্টুডিও। খোসবাগানের ডন স্টুডিও ছিল নামকরা। সেটির মালিক ছিলেন নামী আলোকচিত্রী নারায়ণচন্দ্র দাস। পঞ্চাননবাবু বলেন, ‘‘তখন তো ফোটোগ্রাফি সেভাবে কোথাও শেখানো হতো না, নারায়ণবাবুর মতো লোকেরাই ক্যামেরার খুঁটিনাটি শেখাতেন স্টুডিওতে বসে।’’ নারায়ণবাবুর ছেলে সোমনাথ দাসও বলেন, ‘‘বাবার আমলের সঙ্গে এখনকার প্রযুক্তির মিল নেই। আগে লাইন দিয়ে আমাদের স্টুডিওর সামনে ভিড় করতেন মানুষ। আর এখন বারবার ক্যামেরা বদল করেও ক্রেতা জোটে না।’’ পাশের চিত্রায়ন স্টুডিওর মালিক নিত্যরঞ্জন রায়ও বলেন, ১৯৬৮ সাল থেকে ছবি তুলছি। এখন পাসপোর্ট, অফিসের প্রয়োজন খুব বেশি হলে পুরনো ছবি সংস্কার করাতে আসেন মানুষ।’’ দশ বছর আগেও বিয়ের পরে স্টুডিওতে এসে ছবি তোলার যে চল ছিল, তা হারিয়েছে বলে তাঁর দাবি।

অথচ বছর তিরিশেক আগেও এক একটি স্টুডিওতে ৭-৮ জন করে কাজ করতেন। ছবি তোলা, ডেভেলপ করা, ডার্ক রুমের কাজ, ডেলিভারি দেওয়ার জন্য নানা লোক ছিল। ছবির দামও ছিল অনেক কম। সত্তরের দশকে ৭৫ পয়সায় এক কপি ছবি মিলত। নেগেটিভ থাকলে ১০ টাকায় তিন কপি ছবি উঠত। ৮০-র দশকে একএকটি বিয়েবাড়িতে খুব বেশ হলে ৩০০ টাকা খরচ হতো ছবি তোলার জন্য। ৯০-এর দশকে পোস্টকার্ড মাপের ছবির দাম পৌঁছয় ২০ টাকা প্রতি ছবিতে। ভিডিও এবং স্টিল ছবি মিলিয়ে বিয়েবাড়ির খরচ পৌঁছয় প্রায় বিশ হাজারে। আর এখন তো ছবির কারিকুরি বেড়েছে আরও। বিয়ে-শাদিতে ডিজিট্যাল ছবি, ডিজিট্যাল অ্যালবাম ছাড়া চলে না। অনেকে আবার বিয়ের ক’দিন আগে থেকেই পেশাদার আলোকচিত্রীদের কাছে যান। যোগাযোগ, ছবি ডেলিভারিও অনেক সময় হয় অনলাইনে। প্রয়োজন ফুরিয়ে আসে স্টুডিওর।

বরাবরই ছবির কদর করতেন বর্ধমানের রাজারা। রাজবাড়িতে টাঙানো বিভিন্ন ছবি কিংবা চিঠি থেকে জানা যায় এ কথা। ১৯৩৫ সালের সেপ্টেম্বরে কলকাতার আলিপুরের বিজয়মঞ্জিল থেকে বর্ধমানের জনৈক আলোকচিত্রী চন্দ্রনাথকে চিঠি লিখেছিলেন রাজা বিজয়চাঁদ। তিনি লিখেছিলেন, ‘‘বন্যার ছবিগুলি বড়ই সুন্দর হইয়াছে। ছোটোর উপর এক সেট যদি পাঠানো যায় তাহলে ভাল হয়। আমি যত্ন সহকারে রাখিয়া দিব।’’

তবে শুরুর দিকে আঁকা ছবিরই প্রাধান্য ছিল বেশি। কাঠের ফ্রেমে বন্দি রাজপরিবাররে নানা মুহূর্ত সেটাই প্রমাণ করে। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের মিউজিয়ামে রাজবাড়ির এমন কিছু ছবি সংরক্ষিত আছে। কিউরেটর রঙ্গনকান্তি জানা জানান, অনেক ছবিই খোওয়া গিয়েছে। তবু যে কয়েকটা আছে, তা ওই সময়ের প্রমাণ। বর্ধমানের প্রবীণ ইতিহাসবিদ নীরদবরণ সরকার জানান, ১৯ শতকের মাঝামাঝি, মহতাবচাঁদের সময় থেকে এই চর্চা শুরু হয়। তৈলচিত্রের পাশাপাশি আলোকচিত্রকেও সমান গুরুত্ব দিতেন রাজারা। নীরদবাবু বলেন, ‘‘বর্ধমান রাজবাড়ির হলঘরে বিভিন্ন ফোটোগ্রাফি টাঙিয়ে রাখা হতো।’’

কাঁচের নেগেটিভে ছবি তোলা হতো সেই সময়। রাজারা মাঝেসাঝেই স্থানীয় কোনও আলোকচিত্রীকে ডেকে ছবি তোলাতেন। তবে বড় অনুষ্ঠানে ডাক পড়ত কলকাতার বেইন অ্যান্ড শেপার্ড কোম্পানির ফোটোগ্রাফারদের। তবে সাধারণ মানুষের সাধ্যের অনেকটাই বাইরে ছিল তা। পরে অবশ্য এই কোম্পানিই নেগেটিভ ফিল্মে ছবি তোলা শুরু করে। আধুনিক হতে শুরু করে আলোকচিত্রও। ইতিহাসবিদ নীরদবাবুর দাবি, আলোকচিত্রীরা রাজাদের সামাজিক পরিস্থিতির খবরাখবর দিতেন। প্রামাণ্য হিসেবে ছবিও দিতেন। রাজবাড়ির পাশাপাশি বিভিন্ন দেবালয়ের ছবিও তোলাতেন রাজারা।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy