Advertisement
E-Paper

বিবাদ অতীত, লড়াই শুধু কবিগানে

পাড়ার এক দল গায়ক অন্য পাড়ার উদ্দেশে ছুড়ে দিলেন প্রশ্ন, গানের ভঙ্গিতে। অন্য পাড়ার কবিয়ালেরাও তৈরি। পাল্টা দিতে দেরি হয় না তাঁদেরও। এ ভাবেই ‘বাধাই উৎসবে’ কবিগানের লড়াইয়ে মজেছে মেমারির মণ্ডল গ্রাম।

উদিত সিংহ

শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৫ ০১:২৯
বাধাই উৎসবে তোলা নিজস্ব চিত্র।

বাধাই উৎসবে তোলা নিজস্ব চিত্র।

পাড়ার এক দল গায়ক অন্য পাড়ার উদ্দেশে ছুড়ে দিলেন প্রশ্ন, গানের ভঙ্গিতে। অন্য পাড়ার কবিয়ালেরাও তৈরি। পাল্টা দিতে দেরি হয় না তাঁদেরও।

এ ভাবেই ‘বাধাই উৎসবে’ কবিগানের লড়াইয়ে মজেছে মেমারির মণ্ডল গ্রাম। কবিগানের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, এখানে অনেক আপত্তিকর শব্দ ব্যবহার হয়। আর তার জেরেই গ্রামের পূর্ব, উত্তর, পশ্চিমপাড়ার মধ্যে গানের লড়াই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এক দশকেরও বেশি সময় আগে। ফের গ্রামের যুবকেরা সে সব ভুলে গানের লড়াইয়ে নামলেন, লোকসঙ্গীতকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য।

গ্রামে ঢুকতেই দেখা গেল, রাস্তার মোড়ে মোড়ে জটলা করে গান বেঁধেছেন কবিয়ালরা। এই গানের লড়াইয়ের অন্যতম উদ্যোক্তা উত্তরপাড়ার বণমালী কৈবর্ত্য বলেন, ‘‘গ্রামে প্রায় দু’শো বছর আগে এই প্রতিযোগিতার আসর বসতো। এই গানের লড়াই শুরু হতো ভাদ্র মাসে। উত্তর পাড়াতেই এ বার ৩৫টি কবিগানের আখড়া বসেছে। মোট ১৫০ জন যোগ দিয়েছেন এই গানের লড়াইয়ে।’’ আখড়ায় গিয়ে জানা গেল, প্রতিটি দলের মূল গায়েন একজন আর দোয়ারি বা দোহারি হিসেবে সঙ্গত দিচ্ছেন তিনজন। শিল্পীদের সাজানোর জন্য বাইরে থেকে রীতিমতো মেকআপ আর্টিস্ট ভাড়া করেছেন অনেকে।

বাংলায় কবিগানের ইতিহাস অত্যন্ত পুরনো। গোঁজলা গুঁই, চারণ কবি মুকুন্দ দাস, হরু ঠাকুর, ভোলা ময়রা, নিতাই বৈরাগী থেকে শুরু করে অ্যান্টনী ফিরিঙ্গী— সকলেই ছিলেন বাংলার বিখ্যাত কবিয়াল। কবিয়ালদের গান সংগ্রহ ও গবেষণার কাজ করেছিলেন ঈশ্বর গুপ্ত, হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, অধ্যাপক সুশীল কুমার দে প্রমুখ। এই গানে পৌরাণিক, সামাজিক বিভিন্ন প্রসঙ্গ থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত জীবনও বিষয় হিসেবে উঠে আসে।

দেখা গেল, দুর্গাতলা, কালীতলা, নাট মন্দির, মনসা মন্দির— কার্যত গোটা গ্রাম জুড়েই চলছে কবিগান। আখড়ায় সামিল তুহিন দাস, দিবাকর দাস, সন্তু দাসদের মতো কয়েকজন স্কুল পড়ুয়া জানায়, এ বার তাদের বিষয় ‘ভূতের গান’। যুবকদের ঝোঁক আবার প্রেমের গান রচনার দিকেই। রমেন ঘোষ, মুক্তিপদ ঘোষ, রমাপ্রসাদ চক্রবর্তীদের মতো কয়েকজন কবিয়ালের গানে উঠে এসেছে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার কথা। কবিয়াল শুভঙ্কর ঘটকের গান ‘বহুদিন পর’ ঘরে ফেরার কথা বলে।

কী ভাবে চলছে এই গানের লড়াই? পশ্চিমপাড়ার গান রচয়িতা সুমঙ্গল চৌধুরী বলেন, ‘‘কবিগানের মধ্য দিয়ে গ্রামে লোক সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। ১৫ দিন আগে উত্তরপাড়ার কবিরা কিছু পংক্তি গেয়ে আমাদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন তুলেছেন। আমরাও তার জবাব দেব।’’ পশ্চিমপাড়ার হয়ে এ বার লড়াইয়ে রয়েছেন বিশিষ্ট কবিয়াল শেখ সামসের আলি। জানা গেল, এ বছর পশ্চিমপাড়া গানের মধ্য দিয়ে যে প্রশ্ন তুলবে, পরের বছর উত্তর বা পূর্বপাড়ার কবিরা তার জবাব দেবেন। উত্তরপাড়ার নারায়ণ পাল বলেন, ‘‘পাড়াগুলির মধ্যে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা সকলেরই প্রতিভার বিকাশ ঘটায়। মানুষও আনন্দ পান।’’ আজ, রবিবার লড়াইয়ে নামছে পূর্বপাড়াও।

গানের লড়াই দেখতে ভিড় জমিয়েছেন বাদুলিয়া, হলধরপুর, বসতেপোতা, মালম্বা-সহ প্রায় দশটি গ্রামের মানুষ। সেই দলে সামিল স্থানীয় বধূ চামেলি বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে বৃদ্ধা স্বর্ণ কৈবর্ত্য— সকলেই।

কবিগানে আপত্তিকর শব্দ ব্যবহার পাড়ায় পাড়ায় তিক্ততা তৈরি করেছিল এক সময়। আবার যাতে তা না ফেরে তার জন্যও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক বাসিন্দা জানান, কোনও আপত্তিজনক শব্দের ব্যবহার যাতে না হয়, তার জন্য আমরা পাড়াগত ভাবে কমিটি করে সেগুলি পরীক্ষা করা হচ্ছে। আপত্তিজনক কিছু থাকলে সেগুলি বাতিল করতেও কসুর করছেন না আশিসবাবুরা। জানা গিয়েছে, প্রায় ৫০জন গান রচয়িতা বিভিন্ন জায়গা থেকে তাঁদের গান বিবেচনার জন্য পাঠিয়েছিলেন।

সব মিলিয়ে জমজমাট গানের লড়াইয়ের মধ্যে দিয়েই মণ্ডল গ্রাম ফিরে পেতে চাইছে বাংলার লোকসঙ্গীতের ‘হারানো সুর’।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy