Advertisement
E-Paper

এ কেমন ভোট, অচেনা মুখে হতবাক বসিরহাট

শনি-রবিবার দু’দিনের ছুটিতে বারাসত থেকে টাকি যাবেন ভেবেছিলেন প্রশান্ত কর্মকার। আগেও গিয়েছেন বহু বার। একাধিক হোটেলে চেনা-পরিচিতি আছে। কিন্তু এ বার বুকিং চেয়েও পেলেন না। হোটেল মালিকেরা জানিয়ে দিলেন, কিচ্ছু করার নেই। ভোট না মিটলে একটা ঘরও খালি পাবেন না!

সুকান্ত সরকার ও নির্মল বসু

শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:২২
প্রচারে। আসন্ন উপনির্বাচনে চৌরঙ্গির তৃণমূল প্রার্থী নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়।

প্রচারে। আসন্ন উপনির্বাচনে চৌরঙ্গির তৃণমূল প্রার্থী নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়।

শনি-রবিবার দু’দিনের ছুটিতে বারাসত থেকে টাকি যাবেন ভেবেছিলেন প্রশান্ত কর্মকার। আগেও গিয়েছেন বহু বার। একাধিক হোটেলে চেনা-পরিচিতি আছে। কিন্তু এ বার বুকিং চেয়েও পেলেন না। হোটেল মালিকেরা জানিয়ে দিলেন, কিচ্ছু করার নেই। ভোট না মিটলে একটা ঘরও খালি পাবেন না!

আগামী শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর বসিরহাট দক্ষিণ কেন্দ্রে উপনির্বাচন। তার দিন পনেরো আগে থেকেই টাকি-বসিরহাটের সব হোটেলের সব ঘরে লোক ঠাসা! ভোটের আগে বহিরাগতদের আনা হচ্ছে এলাকায়, এমন অভিযোগ করেছে বিরোধী সব দলই। টাকির কয়েক জন হোটেল ব্যবসায়ী বলছেন, এমনিতেই সারা বছর শনি-রবি বা ছুটির দিনে ভিড় হয়। তবে এ বার সপ্তাহের অন্য সময়েও বুকিং হয়ে যাচ্ছে। তাঁদের এক জনের কথায়, “আমরা নিয়ম মেনে, পরিচয়পত্র জমা রেখে তবেই ঘর দিয়েছি। তবে কে কোথা থেকে কী জন্য এসেছে, সেটা আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়।”

গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই টাকি-বসিরহাটের রাস্তায় অপরিচিত মুখের আনাগোনা বিস্তর। তাদের চেহারা-ছবি দেখে সন্দেহ হওয়াও অস্বাভাবিক নয়! কারও গলায় মোটা সোনার চেন, হাতে নানা রকম বালা, কালো সানগ্লাসে ঢাকা গম্ভীর মুখ। কারও হাতে, গালে গভীর কাটা দাগ! বারমুডা, টি-শার্টে মুশকো চেহারাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে অলি-গলিতে। আর কোনও দলের কোনও সভা হলেই সেখানে দাঁড়িয়ে পড়ে ভিড় বাড়াচ্ছে। নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে নিমেষে উড়িয়ে দিচ্ছে দামী সিগারেটের প্যাকেট।

এক জনসভায় গিয়ে দেখা গেল, যথারীতি এমন কিছু যুবকের ভিড়। সঙ্গে ছিলেন সাদা পোশাকের এক পুলিশকর্মী। ভিড়ে দাঁড়ানো নিয়ে তাঁর সঙ্গে সামান্য কথা কাটাকাটির পরেই ভারী গলায় এক যুবকের হুমকি এল, “বেশি কায়দা না-করে সরে পড়ো এখান থেকে!” ভিড়ের মধ্যে ওই যুবকের টি-শার্ট কোমরের উপরে উঠে যাওয়ায় আগ্নেয়াস্ত্রের একটা ঝলক দেখা গিয়েছিল! কথা বাড়িয়ে লাভ ছিল না, পরে বললেন ওই পুলিশকর্মী। তাঁর অভিজ্ঞ চোখ বলে দিয়েছিল, কোমরে আগ্নেয়াস্ত্র গোঁজা এমন যুবক আরও ছিল ভিড়ের মধ্যে!

শহরের এক প্রবীণ নাগরিকের অভিজ্ঞতা, “ভোট তো কতই দেখলাম। কিন্তু এত বাইরের লোকের ভিড় বসিরহাটে আগে কখনও দেখিনি! যখনই রাস্তায় বেরোচ্ছি, দেখছি নতুন নতুন মুখ! কারা এরা, কেন এসেছে কে জানে!”

প্রচারে। বসিরহাটে দীপেন্দু বিশ্বাসের সঙ্গে দেব।

উত্তরটা লুকিয়ে আছে এই মুহূর্তের রাজনৈতিক বাতাবরণে! নামে একটা উপনির্বাচন মাত্র। কিন্তু আসলে চলছে মহাযুদ্ধের প্রস্তুতি! তাই এত লোক-লস্করের আয়োজন। মাত্র কয়েক মাস আগেই রাজ্য জুড়ে লোকসভা ভোটে বিপুল সাফল্যের মাঝে বসিরহাটেও বড় ব্যবধানে জয় পেয়েছিল তৃণমূল। ভোটে গণ্ডগোল, গা-জোয়ারির অভিযোগও ছিল প্রচুর। এত কিছুর মধ্যেও বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে এই বসিরহাট দক্ষিণ বিধানসভা এলাকায় প্রায় ৩২ হাজার ভোটে বিজেপি-র কাছে পিছিয়ে ছিল তৃণমূল। চার মাসে এমন কিছু ঘটেনি, যাতে শাসক দল রাতারাতি সেই ঘাটতি মিটিয়ে ফেলতে পারে। বরং, সারদা-কাণ্ডে সিবিআইয়ের ফাঁস তাদের উপরে রোজ রোজ চেপে বসছে! আর পাল্লা দিয়ে বাড়তে চাইছে বিজেপি। এই অবস্থায় উপনির্বাচনে হার মানে বিড়ম্বনার এক শেষ! সেই সঙ্গে বিজেপি-র বিপদও উঠে আসবে আরও ঘাড়ের উপরে। সুতরাং, হাতে বালা, গালে কাটা, কোমরে অস্ত্র এ হেন বাহিনী ছেয়ে গিয়েছে বসিরহাটে!

মর্যাদার লড়াই বুঝেই তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ বার বসিরহাটের দায়িত্ব দিয়েছেন দলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সভাপতি তথা মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে। নির্দেশ পেয়ে সপ্তাহতিনেক বসিরহাটে সদলবল তাঁবু ফেলে দিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী! জেলার সব তৃণমূল বিধায়কই সেখানে। মুখ্যমন্ত্রী এবং অথর্মন্ত্রী ছাড়া রাজ্যের প্রায় সমস্ত মন্ত্রীই অন্তত এক বার প্রচারে এসেছেন। জ্যোতিপ্রিয়বাবু জানাচ্ছেন, আজ, বৃহস্পতিবার প্রচারের সময় ফুরোতেই দলবল নিয়ে ফিরে যাবেন। এই আশ্বাসে অবশ্য বিশেষ ভরসা নেই বিরোধীদের!

সারদার কলঙ্ক, বিজেপি-র বিপদ এবং গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের কাঁটা এত কিছু সামলাতে মমতা উপনির্বাচনে প্রার্থী বেছেছেন রাজনীতিতে বাইরের লোক কিন্তু বসিরহাটের ‘ঘরের ছেলে’ দীপেন্দু বিশ্বাসকে। প্রাক্তন জাতীয় ফুটবলার দীপেন্দু সারা বসিরহাটে পরিচিত মিঠু নামেই। কলকাতা ময়দানের শেষ দক্ষ বাঙালি স্ট্রাইকারের মর্যাদা পাওয়া মিঠু রাজনীতির মাঠে অবশ্য একেবারেই আনকোরা। কথাবার্তায় রাজনৈতিক শব্দ ব্যবহারে পটু নন। নিজেকে তৃণমূল নেত্রীর প্রতিনিধি এবং বসিরহাটের ভূমিপুত্র বলা ছাড়া মিঠু বাড়তি কথা বলার চেষ্টা করছেন না। এবং সেটাই তৃণমূলের সেরা বাজি! এই বাজারে চেনা রাজনৈতিক মুখ নামিয়ে পার পাওয়া মুশকিল ছিল, বিলক্ষণ জানেন মমতাও!

মিঠুর জয়ের ব্যাপারে ১০০% নিশ্চিত জ্যোতিপ্রিয়বাবু অবশ্য লোকসভার নিরিখে এই বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপি-র এগিয়ে থাকাকে মুখে কোনও গুরুত্ব দিতে রাজি নন! তাঁর বক্তব্য, “একটানা ৩৭ বছর ধরে এই আসনটি সিপিএমের দখলে ছিল। এখানে সিপিএমই প্রধান প্রতিপক্ষ।” তাঁর আরও দাবি, “লোকসভায় দেশ জুড়ে মোদী-হাওয়া ছিল। এখন আর ও সব নেই। শহরে-গ্রামে ঘুরছি। বুঝতে পারছি, এই লড়াইয়ে বিজেপি অপ্রাসঙ্গিক!” খাদ্যমন্ত্রী নিশ্চিত হলেও স্বয়ং মিঠু কিন্তু বলছেন, “আমি ফুটবলার। কোনও দলকেই খাটো করে দেখিনি কোনও দিন। জেতার আগে জিতব বলব না। শুধু জানি, আমাকে জিততে হবে!”

জেতার ব্যাপারে সিংহভাগ নিশ্চিত বিজেপি প্রার্থী শমীক ভটাচার্যও! মোদী-হাওয়া নেই, এ কথা মানতে নারাজ শমীক। তাঁর বরং পাল্টা দাবি, “এখন মোদী-হাওয়ার তীব্রতা আরও বেশি। ভোট যদি ঠিকঠাক হয়, তা হলে জেতা নিয়ে আমার কোনও চিন্তা নেই!” শমীকের যুক্তি, বিজেপি-র পালে হাওয়া আছে বলেই তৃণমূল সর্বশক্তি নিয়ে এই উপনির্বাচনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। অন্যান্য জায়গা থেকে নেতা-মন্ত্রীদের আনাই নয়, যথেচ্ছ টাকা ছড়ানো, ক্লাব কেনা এবং পাশাপাশি মানুষকে হুমকিও দেওয়া হচ্ছে বলে তৃণমূলের বিরুদ্ধে অভিযোগ শমীকের। এই কেন্দ্রে ভোটারদের প্রায় ৫০% সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। এই ভোটে শমীকবাবু কতটা ভাগ বসাতে পারবেন বা আদৌ পারবেন কি না, সেটা অবশ্য বড় প্রশ্ন। যদিও শমীক বলেন, “এখানে আগেও সাম্প্রদায়িক ভোট হয়নি। এ বারেও হবে না।”

এই উপনির্বাচনে ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে সিপিএমও। তৃণমূল বামেদের প্রধান প্রতিপক্ষ মনে করলেও তাঁদের এখানে মূল লড়াই যে বিজেপি-র সঙ্গেই, স্পষ্টই বুঝিয়ে দিচ্ছেন সিপিএম প্রার্থী মৃণাল চক্রবর্তী। তাঁর স্পষ্ট কথা, “এই আসনে আমরা কখনও হারিনি। এই কেন্দ্রের একটি ধারাবাহিকতা আছে। এই নির্বাচন থেকেই রাজ্যে আমরা ঘুরে দাঁড়াব।” লড়াই আরও জমিয়ে দেওয়ার জন্য আছেন কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা অসিত মজুমদারও। দল ছাড়াও ব্যক্তিগত ভাবে তাঁর নিজস্ব কিছু ভোট রয়েছে বলে জানাচ্ছেন বসিরহাটের আইনজীবী অজয় বসুর মতো স্থানীয় মানুষ। কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের বিরুদ্ধে ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে নির্দল হিসাবে লড়াই করে অসিতবাবু প্রায় ৫২ হাজার ভোট টেনেছিলেন! এ বার তৃণমূল এবং বিজেপি-কে ঠেকাতে সিপিএমের একাংশের ভোটও তিনি পাবেন বলে আশা করছেন অসিতবাবু। বাস্তবে তেমন হলে অনেক হিসাবই ওলট-পালট হবে!

তবে আসল হিসাবের জন্য অপেক্ষা ভোটের দিনটারই! এক দিকে যদি হাতে বালা-গালে দাগ বাহিনী থাকে, অন্য দিকে আছে ১৯ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনীও! যুদ্ধের ময়দান আর কাকে বলে!

বুধবার নির্মল বসু এবং রণজিৎ নন্দীর তোলা ছবি।

basirhat byelection dev sukanta sarkar nirmal basu state news latest news online news online latest news latest online news
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy