Advertisement
E-Paper

দুনিয়ার সমীহ কুড়িয়ে ঘানায় সাম্রাজ্য বাঙালির

প্রথম বার আফ্রিকার ডাক পেয়ে ‘চাঁদের পাহাড়’-এর নায়কের কথাই মনে পড়েছিল তাঁর। দুঃসাহসের নেশায় যে তুচ্ছ করেছিল বাঁধা গতের জীবন।

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৩:২৯
কলকাতার পাঁচতারা হোটেলে বীরেন্দ্র শাসমল। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।

কলকাতার পাঁচতারা হোটেলে বীরেন্দ্র শাসমল। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।

প্রথম বার আফ্রিকার ডাক পেয়ে ‘চাঁদের পাহাড়’-এর নায়কের কথাই মনে পড়েছিল তাঁর। দুঃসাহসের নেশায় যে তুচ্ছ করেছিল বাঁধা গতের জীবন।

বিভূতিভূষণের শঙ্করের মতো তিনিও ‘অজ পাড়াগাঁয়ের ছেলে’। গরিব চাষির ঘরের ‘মেদ্‌নিপুরি’ যুবক। নিশ্চিন্তির জীবনের চিত্রনাট্য তাঁর জন্যও তৈরি ছিল।

বাজকুলের বীরেন্দ্র শাসমল তবু মজলেন অজানা আফ্রিকার রোম্যান্সে।

আর পাল্টে গেল সব কিছু! ছোটবেলায় খালি পায়ে বেগুন, ঢেঁড়স মাথায় বয়ে বাড়ির কাছে কলাবেড়িয়া বাজারে বিক্রি করেছেন। মাধ্যমিকে সাধারণ ফার্স্ট ডিভিশন। কিন্তু চেন্নাইয়ে মাসির বাড়িতে থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং জয়েন্ট পাশের পরেই বীরেন্দ্রর জীবনটা যেন জেট-গতিতে উড়ান দিল। আইআইএম জোকা, বহুজাতিক সংস্থার চাকরি, ক্যালিফোর্নিয়া, তাইওয়ান— এর মধ্যে চাকরিসূত্রে মুম্বই আর দিল্লি ছুঁয়ে যাওয়া। বছর চারেক আগে ব্রিটিশ টেলিকমের অফার আসে। লন্ডনে থিতু হয়ে পাকা চাকরির।

বীরেন্দ্র থিতু হয়েছেন ঘানায়। আফ্রিকার মাটিতে তিনিও এক দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়েছেন। আন্তর্জাতিক ফোন-কলের চোরাই চক্রের বিরুদ্ধে সেই অভিযানকে স্বীকৃতি দিয়েছেন ঘানার প্রেসিডেন্ট। ঘানা সরকারকে কর বাবদ প্রায় ২৫০০ কোটি টাকা ক্ষতির হাত
থেকে বাঁচিয়েছে বীরেন্দ্রর সংস্থার প্রযুক্তি।

মোটে ছ’জন কর্মী নিয়ে ঘানায় নিজের ছোট্ট আইটি কোম্পানিটা খুলেছিলেন। পরে সেই ‘সুবাহ ইনফোসলিউশন্‌স’-এর ৯০ শতাংশ শেয়ার ঘানার শিল্পপতি জোসেফ আগিয়েপংকে বিক্রি করে দেন বীরেন্দ্র। নিজে রয়ে যান সেই সংস্থারই সিইও-র পদে। শুরু হয় ‘সিমবক্স’ জালিয়াতি বা আন্তর্জাতিক ফোন-কল জালিয়াতি চক্রের বিরুদ্ধে লড়াই।

আফ্রিকায় ফি-মাসে কয়েকশো কোটি টাকার ফোন-কল জালিয়াতির কারবার চলে। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, অন্য দেশ থেকে ঘানায় আইএসডি কল করতে মোটা টাকা খরচ হয়। এই টাকার কিছু অংশ কর বাবদ ঘানা সরকারের প্রাপ্য। তা ফাঁকি দেওয়াটাই জালিয়াতদের খেলা। নির্দিষ্ট টেলিকম রুটে ফোন-কলের যাতায়াত রুখে তা চোরাপথে পৌঁছে দেওয়া হয় গ্রাহকের কাছে। আন্তর্জাতিক কলটিকে কৌশলে ‘লোকাল কল’ হিসেবে দেখানো হয়। লাভের গুড় খেয়ে যায় জালিয়াতরা।

নজরদারি-পরিকাঠামো গড়ে বীরেন্দ্ররা সেটাই রুখে দিচ্ছেন। প্রযুক্তি-বিভ্রাটের জেরে ফোনের সার্ভিস প্রোভাইডারদের যে রাজস্ব ক্ষতি হতো, তা-ও সামলে দিচ্ছেন তাঁরা। বেহাল বিজলি-সড়কের ‘অনুন্নত’ দেশে কাজটা কঠিন ছিল। সব চ্যালেঞ্জ সামলে বছরে ১২০০ কোটি টাকার ব্যবসা করছে ‘সুবাহ’। ছ’জনের টিম এখন আড়াই হাজারের। সিয়েরা লিওন, গিনি-তেও কাজ করছেন বীরেন্দ্ররা।

সেই কাজকে কুর্নিশ জানাচ্ছে বিশ্ব। আন্তর্জাতিক টেলিকম ইউনিয়নের বিশ্ব সম্মেলনে সদ্য উঠে এসেছে বীরেন্দ্র শাসমলের কথা। ইউরোপ বিজনেস অ্যাসেম্বলির সেরা ম্যানেজারের সম্মান, আফ্রিকার অন্যতম সেরা টেলিকম সংস্থার স্বীকৃতিও এখন বাঙালির মুঠোয়।

ঘানার আক্রায় রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রাক্তন মহাসচিব কোফি আন্নানের বাড়িতে তাঁর কাছে শোনা একটি কথা এই বাঙালির জীবনের আপ্তবাক্য— ‘‘জীবনের রাশ নিজের হাতে রাখো। বহু মহাশক্তিধর তোমায় তার মতো চালাতে যাবে। নিজের হৃদয়ের কথা শোনো।’’ বীরেন্দ্রর বলছেন, ‘‘বরাবর ভেবেছি, পরের গোলামি না-করে নিজে কিছু করব। একটি সংস্থার ইক্যুইটি কিনে ১৩ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছিল। তবু হাল ছাড়িনি।’’

দিঘার অদূরে বাজকুলের ছেলে মনে পড়িয়ে দিচ্ছেন মেদিনীপুরেরই ভূমিপুত্র বিজ্ঞানী মণি ভৌমিককে। আমেরিকায় বিজ্ঞান-চর্চায় উৎকর্ষ সাধনের পরে এ দেশে মেধাবী গরিব পড়ুয়াদের বল-ভরসা হয়ে উঠেছেন তিনি। মোহনবাগান-ভক্ত বীরেন্দ্র প্রয়াত বাবার স্মৃতিতে ফি-বছর
গ্রামে ফুটবল প্রতিযোগিতা করেন। গ্রামে বা জেলায় অনেক লোকের কাজ হবে, এমন একটি প্রকল্প এখন ঘুরছে তাঁর মাথায়।

মেদিনীপুরের মুড়ির প্রতি টানও কিন্তু বীরেন্দ্রর জীবন! কলকাতায় ছুটিতে এসে পাঁচতারা হোটেলেও গালে তাঁর ঝালমুড়ি। বললেন, ‘‘আফ্রিকায় সফল ব্যবসার স্ট্র্যাটেজি নিয়ে একটা বই লিখছি। তবে বাংলার জন্যও কিছু করতে একদিন ফিরবই।’’

Telecom Ghana
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy