ফলের দোকান ঘিরে বচসায় ছিল যার সূত্রপাত, রাত পোহালে তার পরিণতি নেমে এল তুলসী গাছে!
মহেশতলায় সংঘর্ষের ঘটনার পরে হিন্দুত্বের হাওয়া তুলতে ফের পূর্ণ উদ্যমে নেমে পড়ল বিজেপি। দিনভর তুলসী গাছের চারা হাতে নানা জায়গায় ছুটে বেড়ালেন বিজেপি নেতারা। দক্ষিণ ২৪ পরগনার রবীন্দ্রনগর ও লাগোয়া কলকাতা পুলিশের নাদিয়াল থানা এলাকায় অশান্তি সামাল দিতে পুলিশের ‘ব্যর্থতা’ অভিযোগ চলে গেল পিছনের সারিতে। বিজেপি নেতাদের সুর আপাতত একটাই— ‘হিন্দুরা আক্রান্ত’।
মুর্শিদাবাদ ও মহেশতলার ঘটনা নিয়ে আনা মুলতুবি প্রস্তাব খারিজ হওয়ার পরে বৃহস্পতিবার বিধানসভায় বিক্ষোভ দেখিয়ে মিছিল করে রাজভবনে গিয়েছেন বিজেপি বিধায়কেরা। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বে রাজভবনে বিজেপি বিধায়কেরা রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসের হাতে তুলসী গাছ তুলে দিয়েছেন। শুভেন্দুরা আজ, শুক্রবার বিধানসভা চত্বরেও তুলসী গাছ নিয়ে ধর্নার পরিকল্পনা নিয়েছেন।
তুলসী-বিক্ষোভে পিছিয়ে থাকেননি বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারও। মহেশতলায় যাওয়ার চেষ্টা করলে জিঞ্জিরা বাজারে এ দিন তাঁর গাড়ি আটকে দেয় পুলিশ। রবীন্দ্রনগর এলাকায় ১৬৩ ধারা জারি রয়েছে বলে কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিকেই পুলিশ সেখানে যেতে দিতে নারাজ। পুলিশের বাধা পেয়ে সেখান থেকে ফিরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে তুলসী বেদী পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন সুকান্ত। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ওখানে তুলসী মঞ্চ ভাঙা হয়েছে। আমি তুলসী গাছ দিতে গিয়েছিলাম। পুলিশ আমায় আটকেছে। যাঁর পুলিশ, আমি তাঁর কাছেই তুলসী গাছ পৌঁছে দেব। তিনি দায়িত্ব নিয়ে ওখানে তুলসী মঞ্চ প্রতিষ্ঠা করবেন।’’ সুকান্ত, রাজ্য দলের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক জ্যোতির্ময় সিংহ মাহাতো, সমাজ মাধ্যম শাখার আহ্বায়ক সপ্তর্ষি চৌধুরী-সহ বিজেপির নেতা-কর্মীদের অবশ্য কালীঘাট থেকে গ্রেফতার করে লালবাজারে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে তাঁরা ছাড়া পান।
ঘটনাপ্রবাহের প্রক্ষিতে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর মন্তব্য, ‘‘পুলিশের ব্যর্থতা সীমাহীন। কিন্তু সেটা থেকে নজর সরিয়ে তুলসী গাছ নিয়ে হইচই করে বিজেপি আসলে মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রীকেই বাঁচার পথ করে দিচ্ছে।’’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকারও তোপ দেগেছেন, ‘‘পুলিশকে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না। আর কিছু ঘটলেই হিন্দু-মুসলিম নিয়ে চলে আসা হচ্ছে। শিক্ষকদের চাকরি বাতিল বা স্মার্ট মিটার নিয়ে প্রধান বিরোধী দলের প্রতিবাদ নেই বিধানসভায়! বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের এই রাজনীতির বিরুদ্ধে রাজ্যের মানুষকেই বেরিয়ে এসে প্রতিবাদ করতে হবে।’’
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, মহেশতলায় হিংসার প্রতিবাদে বিধানসভা অচল করে দেবেন। মুর্শিদাবাদ ও মহেশতলায় ‘হিন্দুদের উপরে আক্রমণ’ এবং পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ নিয়ে আলোচনার জন্য এ দিন মুলতুবি প্রস্তাব এনেছিল বিজেপি। কিন্তু প্রশ্নোত্তর-পর্বের পরে স্পিকার সেই আলোচনার দাবি খারিজ করে দেন। শুভেন্দু-সহ বিজেপি বিধায়কেরা সরকারের বিরুদ্ধে ‘তোষণে’র অভিযোগে স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। অন্য দিকে, ঘোষণা মতো বিধানসভা ‘সচল’ রাখতে সে সবে আমল না দিয়ে স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় আধ ঘণ্টা উল্লেখ-পর্বের আলোচনা চালিয়ে যান। মধ্যাহ্ন-বিরতি বাতিল করে পরের কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়া হয়। গলায় ত্রিবর্ণ উত্তরীয় আর হাতে ‘ওম’ প্রতীক আঁকা ত্রিকোণ গেরুয়া পতাকা নিয়ে বিরোধীরা স্লোগান দিতে দিতেই সভাকক্ষ ত্যাগ করেন। সে সময় শাসক বেঞ্চের উদ্দেশে ‘চোর’, ‘চোর’ বলতে শোনা যায় তাঁদের। পাল্টা আঙুল তুলে ‘চোর’ বলতে থাকেন সরকার পক্ষের অনেকে। বিধানসভা থেকে রাজভবন যাওয়ার আগে বিরোধী দলনেতার দাবি, “৩০-৩৫ জন পুলিশ-কর্মী জখম। বিশৃঙ্খল জনতা পাথর ছুড়ছে আর পুলিশ সাদা কাপড় দেখাচ্ছে। মহেশতলায় ২০% হিন্দু, ৮০% মুসলিম। আতঙ্কের পরিবেশ। কেন্দ্রীয় বাহিনীর রুটমার্চ করাটা জরুরি।” মহেশতলার অশান্তির ঘটনায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের আর্জি জানিয়ে এ দিনই কলকাতা হাই কোর্টে বিচারপতি সৌমেন সেনের নেতৃত্বাধীন ডিভিশন বেঞ্চের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন বিরোধী দলনেতার আইনজীবী। বিচারপতি সেন মামলা দায়েরের অনুমতি দিয়েছেন।
পরে অধিবেশনের কাজ শেষ করার সময়ে স্পিকার বলেন, ‘‘বিধানসভা অচল করা যায় না। এটা কোনও চ্যালেঞ্জের বিষয়ও হতে পারে না!’’ বিরোধীদের আচরণে ক্ষোভ জানিয়ে পরিষদীয় মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সভাকক্ষে একটি ধর্মীয় সংস্থার পতাকা উড়িয়ে সংবিধানের নির্দেশ উপেক্ষা করেছে বিজেপি।’’ মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসও বিধানসভা ‘সচল’ ছিল দাবি করে কটাক্ষ করেছেন বিজেপিকে।
মহেশতলার ঘটনা প্রসঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ বলেছেন, ‘‘পুলিশ হামলাকারীদের ধরেছে। তাদের কাছ থেকে প্রচুর বিস্ফোরক উদ্ধার হয়েছে। নবীন রায় বলে বিজেপি- আরএসএএসের এক কর্মীকে চিহ্নিত করা হয়েছে। আগেও সে মারামারি করেছে।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘এক ফল বিক্রেতা বাড়ি গিয়েছিল। জেনে-শুনে তার জায়গায় তুলসী গাছ লাগিয়েছে। এতে তো গোলমাল হবেই! বিজেপি এ ভাবেই পাড়ায় পাড়ায় গোলমাল ছড়াতে চাইছে। সকলকে সতর্ক থাকতে হবে।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)